পাতা -৯, Publish: 13/01/2018
দেশপ্রেম ও প্রবাসীর পাসপোর্ট
ডা. মোহাম্মদ ফ এ হাসান :

আমার পাসপোর্টের মেয়াদ শেষ হয়ে গেছে। নানারকম কর্মব্যস্থতায় এবং টাকার ব্যবস্থা করতে করতে কয়েক মাস কেটে গেল। অবশেষে গত মাসে যখন বাৎসরিক ছুটি পেলাম, পরিবার থেকে বিদায় নিয়ে রওনা হলাম। আমার সঙ্গে যুক্ত হল আরও একজন, যিনি ঠিকমতো এখানকার ভাষা জানেন না, এমনকি ঠিকমতো চোখেও দেখতে পান না। পেলাম আরও কয়েকটি ফোন, যাতে তাদের পাসপোর্টের খোঁজখবর নিয়ে আসি। আর একজন দিলেন তার পুরনো পাসপোর্ট, ফরম এবং টাকা, তার নতুন পাসপোর্টের জন্য আবেদন করতে।

দুপুর সাড়ে ৩টায় বাসে উঠলাম সাও পাওলো শহর থেকে, পরবর্তী দিন সকাল ৭টায় ব্রাজিলের রাজধানী ব্রাসিলিয়াতে পৌঁছলাম। পুরোরাত ঠিকমতো ঘুম হয়নি, এমন কি খাওয়া-দাওয়াও করতে পারিনি। আমাদের ধর্মীয় এবং সংস্কৃতিগত কারণে এখানকার অনেক খাবার আমরা খেতে পারি না। যেমন- বেকন; লিঙ্গুইছা; প্রেজুনতু ইত্যাদি। এগুলো তৈরি হয় শূকর থেকে। সবচেয়ে বিরক্তিকর বিষয়টি হচ্ছে, যেসব খাবার সহজেই সব জায়গায় পাওয়া যায়, এর বেশিরভাগ খাবারের মাঝেই এগুলো ব্যবহার হয়ে থাকে। যাই হউক, সকালে পৌঁছে দেখি বেশিরভাগ দোকান তখনও খুলেনি। না খেয়েই ট্রেন স্টেশনের দিকে যাত্রা করলাম। ট্রেনে করে সেন্ট্রাল বাস টার্মিনালে পৌঁছে দেখলাম কয়েকটি স্ন্যাক বার খোলা। যে খাবারটি আমরা সচরাচর খেয়ে থাকি তাই আমি নিলাম এবং তার সঙ্গে ফ্রেশ আখের রস। খাবার শেষ করেই বাসে করে চলে গেলাম ব্রাজিলের বাংলাদেশ দূতাবাসে। মনে হচ্ছিল নিজের দেশে যাচ্ছি।

হাঁটতে হাঁটতে যখন দেখতে পেলাম বাংলাদেশ দূতাবাস লেখা, কেমন জানি অনুভব হয়েছিল। নিজের দেশের নামটি যখন দেশের বাইরে দেখি কি সেই অনুভূতি হয়, তা শুধু যারা প্রবাসে আছেন তাদেরই জানা। দূতাবাসে পৌঁছানোর পর যিনি আমাদের জন্য গেট খুলে দিয়েছিলেন তিনি ব্রাজিলের বাংলাদেশিদের কাছে একটি পরিচিত নাম। তাকে সবাই সেন্টু ভাই বলে ডাকে।

গিয়ে পেলাম প্যারাগুয়ে থেকে আসা রবিনকে, তিনি একদিন আগে থেকেই ব্রাসিলিয়াতে। এসেছিলেন অনেকের পাসপোর্ট এবং নো ভিসা সংক্রান্ত কাজ নিয়ে। ফরম পূরণ করে জমা দিয়ে অপেক্ষা করছিলাম আমার সিরিয়ালের জন্য, তারই মধ্যে ধীরে ধীরে আরও অনেকে বিভিন্ন রাজ্য থেকে এসে গেলেন। তাদের সঙ্গে কথা বলে জানতে পারলাম, কেউ এসেছেন পারানা থেকে, কেউ এসেছেন সাও পাউলো থেকে। দুজন এসেছেন পারানার এমন প্রান্ত থেকে, দুদিনেরও বেশি লেগেছে বাংলাদেশ দূতাবাসে পৌঁছাতে। এদিকে প্যারাগুয়ে থেকে আসা রবিনের ফিরে যাওয়ার ফ্লাইটের সময় হয়ে গেছে কিন্তু তার কাজ এখনও শেষ হয়নি। তিনি খুবই উদ্বিগ্ন, কেননা ফ্লাইটটি ধরতে না পারলে প্রায় ৪০ হাজার টাকা নষ্ট হয়ে যাবে। শেষ পর্যন্ত তার কাজটি সমাধান করা হল। যারা দেরিতে এসে পৌঁছেছেন, খুবই চিন্তিত সময় কাটাচ্ছিলেন, কেননা কাজটি দিনের মধ্যে শেষ করতে না পারলে, একদিন বেশি থাকতে হবে যা কাজের জন্যও সমস্যা এবং খরচেরও বেপার।

দুপুরের খাবারের পর আমার কাছে দেয়া কাজগুলো নিয়ে আমি কথা বলছিলাম এবং দেখিয়েছিলাম, তারা আমাকে লিখিতভাবে ক্ষমতা দিয়েছে তাদের কাজের প্রতিনিধিত্ব করার জন্য, কিন্তু আমার কাছে দেয়া কাজগুলো গ্রহণ করা হয়নি। কারণ হিসেবে বললেন, আমরা এভাবে আগে আপনাদের অনেক কাজ করে দিয়েছি। এ নিয়ে বাংলাদেশের পত্রিকায় লেখালেখি হয়েছে, আমরা টাকা নিয়ে এগুলো করেছি, যা আমাদের সম্মান ক্ষুণ্ণ করেছে। এর পর থেকে আমরা নিয়ম করেছি, যার কাজ তাকে স্বশরীরে এসে জমা দিতে হবে এবং এসে গ্রহণ করতে হবে। আমি আমার কাজ শেষ করে, সঙ্গের লোকটিকে নিয়ে চলে গেলাম বাস টার্মিনালে। গিয়ে দেখি বিকালের সব বাস চলে গেছে, শুধু রয়েছে রাতের বাসগুলো। সবগুলোর ভাড়া যাচাই করতে গিয়ে সিদ্ধান্ত নিতে কিছুটা দেরি হয়ে গেল। শেষ পর্যন্ত নরমালে যাওয়ার সিদ্ধান্তই নিলাম। নরমালের ভাড়া ছিল ব্রাজিলের মুদ্রায় ২৬০, শুয়ে যাওয়ার ভাড়া ছিল তারচেয়েও বেশি। সারা রাত, সকাল শেষে দুপুর ঘনিয়ে সাড়ে ৩টায় সাও পাউলো শহরে পৌঁছেছিলাম।

যারা জানতেন যে আমি বাংলাদেশের দূতাবাসে গিয়েছি তাদের খবর জানার জন্য সবাই ফোন করতে লাগলেন। যেমন- কিভাবে যেতে হয়, কত টাকা খরচ হয়, কতক্ষণ সময় লাগে ইত্যাদি। তার কয়েকদিন পর একজন বাংলাদেশ দূতাবাসে গিয়েছিলেন নতুন পাসপোর্টের জন্য, ফিরে এসে বিষণ্ণ হয়ে বলছিলেন, ‘এ মাসে আমি আর বাড়িতে টাকা পাঠাতে পারুম না’।

যেখানে ব্রাজিলের আইন অনুযায়ী যে কোনো প্রাপ্তবয়স্ক ব্যক্তিকে ক্ষমতা প্রদান করা যায় তার পক্ষ হয়ে কাজ করার জন্য অথবা কোনো পেশাধারী কোম্পানিকে নিয়োগ করা যায়। এখানে অন্যান্য দূতাবাস কুরিয়ারের মাধ্যমে দূরবর্তী স্থানে বসবাসকারীদের সেবা দিয়ে থাকেন। বাংলাদেশ দূতাবাসেও এ সেবাটি চালু ছিল, আমি নিজেও এ সেবাটি কোনো এক সময় পেয়েছিলাম। কান কথার ওপর ভিত্তি করে একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রচলিত সেবা, যার মাধ্যমে মানুষ উপকৃত হচ্ছিল তা বন্ধ করে দেয়া কতটুকু যুক্তিসঙ্গত?

আমি যে শহরে আছি, সে শহর থেকে যদি কাউকে বাংলাদেশ দূতাবাসে যেতে হয়, তাহলে তাকে তিন দিনের জন্য কাজ থেকে ছুটি নিতে হয়। দু’রাত বাসে ঘুমাতে হয়, খাওয়া-দাওয়া এবং গোসল হয়ে যায় দুর্বিষহ এবং তাকে সর্বনিম্ন খরচ করতে হবে বাংলাদেশের মুদ্রায় প্রায় ১৬৩৮০ টাকা। আবার যখন পাসপোর্ট আনতে যেতে হয় তখন ১৬৩৮০ টাকা এবং পাসপোর্ট ফি প্রায় ৯৮৮০ টাকা। একটি পাসপোর্ট করতে প্রায় সর্বমোট ৪২৬৪০ টাকা এবং ছয়দিন কাজ থেকে ছুটি নেয়া। ব্রাজিল একটি বড় দেশ। ব্রাজিল এমনও প্রান্ত আছে যেখান থেকে গিয়ে পাসপোর্ট করাতে খরচ হতে পারে ১ লাখ টাকার মতো।

তাদের এই পরিশ্রমের উপার্জন বাংলাদেশের অনেক পরিবারের প্রদান চালিকাশক্তি এবং যা আমাদের দেশের অর্থনীতি উন্নয়নে কিছু হলেও ভূমিকা রাখে। এখানে প্রায় ৫০০০ বাংলাদেশি বসবাস করছেন, তাদের বিভিন্ন কাজে বাংলাদেশ দূতাবাসে যেতে হয়। বাংলাদেশের এই দূতাবাসটি দক্ষিণ এবং সেন্ট্রাল আমেরিকার একমাত্র দূতাবাস। তাই এই দূতাবাসের ভূমিকা এবং প্রয়োজনীয়তা অনেক বেশি।

কর্তৃপক্ষ আপনাদের ফিরে দেখার অপেক্ষায়, অনেক মানুষ সেবা এবং অনেক পরিবার কতগুলো টাকা থেকে বঞ্চিত হয়। ব্রাজিলের বাংলাদেশি প্রবাসীরা এই বিষয়টির প্রতি আপনাদের ফিরে দেখার প্রত্যাশা করছে।

লেখক : সভাপতি এবং প্রতিষ্ঠাতা সদস্য, বাংলাদেশ কমিউনিটি ব্রাজিল (ঈইই)