শেষের পাতা, Publish: 14/06/2018
মোবাইল হ্যান্ডসেট সংযোজন শিল্পে নতুন উদ্বেগ
বাজেটে কর কাঠামোতে পরিবর্তন
কর কাঠামোয় পরিবর্তনের কারণে দেশের মোবাইল হ্যান্ডসেট সংযোজন শিল্প বড় ধরনের সংকটে পড়বে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। বিশেষ করে অস্থিতিশীল হয়ে যাবে দেশের স্মার্টফোন বাজার। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এর ফলে হাইটেক পার্কসহ পুরো তথ্যপ্রযুক্তি খাতে দেশি-বিদেশি বিনিয়োগ হুমকির মুখে পড়বে। এর আগেও অস্থিতিশীল কর কাঠামোর জন্য তথ্যপ্রযুক্তি খাতে অনেক সম্ভাবনাময় কারখানা বন্ধ হয়ে গেছে। একইভাবে মোবাইল হ্যান্ডসেট সংযোজন শিল্পও বন্ধ হয়ে যাবে। ফলে শতভাগ আমদানিনির্ভর দেশ হয়েই থাকতে হবে বাংলাদেশকে। প্রস্তাবিত বাজেটের কর কাঠমো বৈধ আমদানির চেয়ে চোরাচালানকে উৎসাহিত করবে বলেও বিশেষজ্ঞদের অভিমত। আর শিল্পোদ্যোক্তারা বলছেন, কর কাঠামোর অযৌক্তিক পরিবর্তনের ফলে এখনই প্রায় ৫০০ কোটি টাকার বিনিয়োগ এবং প্রায় আড়াই হাজার তথ্যপ্রযুক্তিভিত্তিক শিল্প কর্মীর কর্মসংস্থান অনিশ্চয়তার মধ্যে পড়েছে।
২০১৮-১৯ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে দেখা যায়, দেশে মোবাইল হ্যান্ডসেট সংযোজন এবং উৎপাদনের কর সংক্রান্ত জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের প্রজ্ঞাপনটি গত বছর জারি করা ১৩২ নম্বর প্রজ্ঞাপনের অনুরূপ। যেখানে মোবাইল হ্যান্ডসেট সংযোজন ও উৎপাদনকে একই কাঠামোতে রেখে কর কাঠামোর দুটি টেবিল রয়েছে। এ কাঠামো অনুযায়ী দেশে সংযোজন কারখানা থাকলে ভ্যাট ও অন্যান্য করসহ ১৮ শতাংশ এবং আমদানির ক্ষেত্রে ৩০ শতাংশ কর নির্ধারিত রয়েছে। কোনো সংযোজনের কারখানার সঙ্গে সংশ্নিষ্ট যন্ত্রাংশ তৈরির সক্ষমতা থাকলে সে কারখানার ক্ষেত্রে কর আরও কমে ১৩ শতাংশ হবে।
অপরদিকে প্রস্তাবিত অর্থবছরে নতুন আর একটি প্রজ্ঞাপন (নম্বর ১৬৮) জারি করেছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের ভ্যাট বিভাগ। 'মোবাইল হ্যান্ডসেট' উৎপাদনের সঙ্গে সংশ্নিষ্ট কারখানাগুলোকে ভ্যাট অব্যাহতি দেওয়ার জন্য জারি করা এ প্রজ্ঞাপনে নির্দিষ্ট কয়েকটি শর্তে শুধু উৎপাদন কারখানাকে ভ্যাট অব্যাহতি দেওয়ার কথা বলা হয়েছে। সংযোজন কারখানাকে ভ্যাট অব্যাহতি দেওয়া হয়নি- ফলে ১৫ শতাংশ হারে ভ্যাট দিতে হবে সংযোজন কারখানাগুলোকে। এ প্রজ্ঞাপন অনুযায়ী এখন থেকে আমদানির জন্য মোট কর দিতে হবে ৩১ শতাংশ। আর দেশে সংযোজনের জন্য দিতে হবে ৩৪ শতাংশ। শিল্পোদ্যোক্তারা বলছেন, পৃথিবীর কোথাও কর কাঠামোতে এভাবে আমদানির চেয়ে সংযোজন বা উৎপাদনের ক্ষেত্রে কর বেশি ধার্য করার নজির নেই।
মোবাইল আমদানিকারকদের সংগঠন বিএমপিআই সভাপতি ও স্যামসাংয়ের স্মার্টফোন সংযোজন কারখানা স্থাপনকারী প্রতিষ্ঠান ফেয়ার ইলেকট্রনিক্সের ব্যবস্থাপনা পরিচালক রুহুল আমিন আল মাহবুব সমকালকে বলেন, গত অর্থবছরের বাজেটে বাস্তবসম্মত কর কাঠামো এবং সহায়ক নীতির কারণে দেশে এক বছরের মধ্যেই পাঁচটি মোবাইল হ্যান্ডসেট সংযোজন ও উৎপাদন কারখানা স্থাপিত হয়। এতে প্রায় ৫০০ কোটি টাকার বিনিয়োগ এবং প্রায় আড়াই হাজার তথ্যপ্রযুক্তিনির্ভর কর্মীর কর্মসংস্থান হয়েছে। কিন্তু প্রস্তাবিত বাজেটে ভ্যাট সংক্রান্ত সরকারি প্রজ্ঞাপনের শর্তাবলি বহাল থাকলে বর্তমান বাস্তবতায় দেশে নতুন কোনো হ্যান্ডসেট উৎপাদন বা সংযোজনকারী কারখানা স্থাপন নিরুৎসাহিত হবে এবং এখন যেসব কারখানা স্থাপনা করা হয়েছে সেগুলোও পরিচালনা অসম্ভব হয়ে পড়বে। তিনি বলেন, ভ্যাট অব্যাহতির প্রজ্ঞাপনে যেসব শর্ত দেওয়া হয়েছে সেগুলো অবাস্তব এবং অযৌক্তিক। তথ্যপ্রযুক্তি খাতের কোনো বিশ্বখ্যাত ব্র্যান্ডই এখন নিজেরা যন্ত্রাংশ উৎপাদন করে না। কারণ একেকটি যন্ত্রাংশ উৎপাদনের জন্য পৃথকভাবে বিপুল বিনিয়োগ করে আলাদা কারখানা তৈরি করতে হয়। এ জন্য পৃথক প্রতিষ্ঠান থেকে যন্ত্রাংশ নিয়ে সেগুলো কারখানায় সংযোজন করা হয়। এ অবস্থায় প্রজ্ঞাপনের বাস্তবতা বিবর্জিত অযৌক্তিক শর্ত দেশি-বিদেশি বিনিয়োগকারীদের মধ্যে তীব্র হতাশার জন্ম দিয়েছে।
ট্রানশন বাংলাদেশ লিমিটেডের প্রধান রেজওয়ানুল হক বলেন, প্রজ্ঞাপনের শর্তে এমন সব যন্ত্রাংশের উৎপাদনের শর্ত দেওয়া হয়েছে যেগুলো বিশ্বের মাত্র দু-তিনটি প্রতিষ্ঠান উৎপাদন করে এবং এ মুহূর্তে বাংলাদেশের উৎপাদনের কোনো বাস্তবতাই নেই। বরং হ্যান্ডসেট সংযোজন কারখানাগুলো বিস্তৃত হলে যন্ত্রাংশ তৈরির পৃথক কারখানা স্থাপনে নতুন বিনিয়োগ আসত। এই প্রজ্ঞাপনের কারণে সে সুযোগও বন্ধ হয়ে যাবে।
তথ্যপ্রযুক্তি বিশেষজ্ঞ সুমন আহমেদ সাবির বলেন, কর কাঠামোতে অবাস্তব শর্তের কারণে এর আগেও দেশে তথ্যপ্রযুক্তি ভিত্তিক অনেক কোম্পানি বন্ধ হয়ে গেছে। এক সময় দেশে উন্নতমানের ইউপিএস তৈরির কারখানা স্থাপিত হলেও শুধু ভ্রান্ত করনীতির কারণে সেগুলো বন্ধ হয়ে গেছে। মোবাইল হ্যান্ডসেট সংযোজনের ক্ষেত্রেও তাই করা হচ্ছে। ফলে দেশে উন্নত প্রযুক্তির মোবাইল হ্যান্ডসেট উৎপাদনের সম্ভাবনা অঙ্কুরেই বিনষ্ট হবে এবং পুরো খাত আমদানিনির্ভর হয়ে পড়বে। তিনি আরও বলেন, সংযোজন কারখানা নিরুৎসাহিত করে আমদানিতে আরও এক শতাংশ সারচার্জ বৈধ পথে আমদানি নয়, বরং চোরাচালানকে উৎসাহিত করবে।