খবর, Publish: 11/08/2018
৩০৫৩ কোটি টাকার ঋণ সহায়তা অনিশ্চিত
আরিফুর রহমান  :

শিল্প-কারখানার বিকাশ ঘটলেও ভবিষ্যতে মেঘনা নদীর পানি শীতলক্ষ্যার মতো দূষণ হবে না, এমন নিশ্চয়তা দেওয়া যাচ্ছে না। সরকারের পক্ষ থেকে চার রাষ্ট্রদূতকে এই নিশ্চয়তা দিতে না পারায় উন্নয়ন সহযোগীদের কাছ থেকে প্রতিশ্রুত তিন হাজার ৫৩ কোটি টাকা পাওয়া অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে। জার্মানি, ফ্রান্স, ডেনমার্ক ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের রাষ্ট্রদূতরা কয়েক দফা চিঠি দিয়ে আশ্বস্ত হতে চেয়েছিলেন, মেঘনা নদীকে দূষণমুক্ত রাখতে সরকার সব ধরনের ব্যবস্থা গ্রহণ করবে। কিন্তু সরকারের পক্ষ থেকে এখনো বিষয়টি আশ্বস্ত করা হয়নি। অন্যদিকে রাষ্ট্রদূতদের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, আশ্বস্ত না হওয়া পর্যন্ত সরকারের সঙ্গে ঋণচুক্তিতে যাবেন না তাঁরা। ফলে মেঘনা নদীর পানি শোধন করে তা রাজধানীবাসীকে সরবরাহ করার উদ্যোগটি মুখ থুবড়ে পড়েছে। মেঘনা নদীর পানি পরিশোধন করে তা ঢাকাবাসীকে সরবরাহ করার প্রকল্পটি তিন বছর আগে অনুমোদন পেলেও নানা জটিলতায় এখনো কাজ শুরু করতে পারেনি ঢাকা ওয়াসা। কবে নাগাদ শুরু করা যাবে, সেটিও বলতে পারছেন না ওয়াসার নীতিনির্ধারকরা।

অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের (ইআরডি) দেওয়া তথ্য মতে, ঢাকায় বসবাসরত দুই কোটি মানুষকে বিশুদ্ধ পানি সরবরাহের লক্ষ্যে জার্মানির কেএফডাব্লিউ, ফ্রান্সের এএফডি, ডেনমার্কের ডানিডা এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নের ইআইবি বাংলাদেশকে তিন হাজার ৫৩ কোটি টাকা দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেয় ২০১৫ সালে। সায়েদাবাদ পানি শোধনাগার তৃতীয় পর্যায় প্রকল্পে এই টাকা দেওয়ার কথা। তবে শর্ত ছিল, নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁ উপজেলার হরিয়ায় মেঘনা নদীর যেখান থেকে (ডান তীর) পরিশোধনের জন্য পানি সংগ্রহ করা হবে, সেই এলাকাটি দূষণমুক্ত রাখতে সরকারের পক্ষ থেকে সব ধরনের উদ্যোগ গ্রহণ করা হবে। একই সঙ্গে যে চারটি সংস্থা অর্থায়ন করবে, তাদেরকে আশ্বস্ত করতে হবে; মেঘনা নদীর অবস্থা শীতলক্ষ্যা নদীর মতো ব্যবহারের অনুপযোগী হবে না। কিন্তু সরকার তাদের আশ্বস্ত করতে পারেনি। ফলে চারটি সংস্থার সঙ্গে এখনো অর্থায়নের বিষয়ে চুক্তি সই হয়নি।

অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের সচিব কাজী শফিকুল আযম কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘জার্মানি, ফ্রান্স, ডেনমার্ক ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন আমাদের কাছে মেঘনা নদীর পানি দূষণমুক্ত রাখার প্রতিশ্রুতি চেয়েছে। আমরা এখনো তাদেরকে সেটি জানাতে পারিনি। সে জন্য চারটি সংস্থার সঙ্গে আমাদের এখনো ঋণচুক্তি সই হয়নি। আমি ঢাকা ওয়াসার এমডিকে কয়েক দফা বলেছি এর সুরাহা করতে। তিনি আমাকে বলেছেন, দ্রুততম সময়ে সমস্যার সমাধান করা হবে।’

পরিকল্পনা কমিশনের তথ্য মতে, সায়েদাবাদ পানি শোধনাগার তৃতীয় প্রকল্পটি জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) সভায় অনুমোদন পায় ২০১৫ সালের ১ সেপ্টেম্বর। প্রকল্পটি বাস্তবায়নে মোট খরচ ধরা হয়েছে চার হাজার ৫৯৭ কোটি টাকা। এর মধ্যে চারটি সংস্থা ঋণ দিচ্ছে তিন হাজার ৫৩ কোটি টাকা। বাকি এক হাজার ৫১৪ কোটি টাকা রাষ্ট্রীয় কোষাগার থেকে জোগান দেওয়া হবে। প্রকল্পের আওতায় ৫৩ কিলোমিটার অপরিশোধিত পানি সরবরাহ লাইন নির্মাণ করা হবে। পরিশোধিত পানির বিতরণ লাইন নির্মাণ করা হবে ৫৪ কিলোমিটার। ২০২০ সালে প্রকল্পের কাজ শেষ করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল ঢাকা ওয়াসা। কিন্তু প্রকল্পটি অনুমোদনের পর তিন বছর পার হলেও এ পর্যন্ত প্রকল্পের কাজই শুরু করা যায়নি। ফলে নির্ধারিত সময়ে প্রকল্পের কাজ শেষ হবে না। এতে বাড়ানো হবে প্রকল্পের মেয়াদ। একই সঙ্গে প্রকল্পের খরচও। আর বাড়তি ঋণের বোঝা বইতে হবে সরকারকে। প্রকল্পের সুফল পাওয়া থেকেও বঞ্চিত হচ্ছে সাধারণ মানুষ।

প্রকল্প পরিচালক কামরুন নাহার লাইলি কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘অর্থায়ন জটিলতায় আমরা এখনো প্রকল্পের কাজ শুরু করতে পারিনি। উন্নয়ন সহযোগীদের কাছ থেকে যে টাকা পাওয়ার কথা, তা এখনো ছাড় হয়নি। আশা করছি, শিগগিরই চুক্তি সই হবে। আমরা দ্রুতই প্রকল্পের কাজ শুরু করতে পারব।’

কালের কণ্ঠ’র অনুসন্ধানে দেখা গেছে, চার রাষ্ট্রদূতের যে উদ্বেগ তা হলো নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁ উপজেলায় হরিয়ায় যেখান থেকে পানি সংগ্রহ করা হবে, সেখানে আমান গ্রুপের একটি অর্থনৈতিক অঞ্চলসহ বেশ কয়েকটি শিল্প-কারখানা গড়ে উঠছে। উন্নয়ন সহযোগীদের আশঙ্কা, ভবিষ্যতে অর্থনৈতিক অঞ্চলে প্রতিষ্ঠিত বিভিন্ন কারখানার বর্জ্য গিয়ে পড়বে মেঘনা নদীতে। এতে পানির গুণগত মান নষ্ট হয়ে যাবে। এতে ওই পানি আর রাজধানীবাসীকে সরবরাহ করা সম্ভব হবে না। আমান গ্রুপের সঙ্গে বিষয়টি নিয়ে ঢাকা ওয়াসার কর্মকর্তাদের আলোচনা হয়েছে। কিন্তু কোনো সুরাহা হয়নি। প্রধানমন্ত্রীর এসডিজি বাস্তবায়নবিষয়ক সমন্বয়ক আবুল কালাম আজাদ বিষয়টি সুরাহার আশ্বাসও দিয়েছিলেন। কিন্তু জটিলতা কাটেনি। আমান গ্রুপের অনুরোধ ছিল, হরিয়ায় এলাকা বাদ দিয়ে অন্য কোথাও থেকে পানি সংগ্রহ করতে। ঢাকা ওয়াসার বক্তব্য হলো, আমান গ্রুপের অর্থনৈতিক অঞ্চলটি অন্যত্র সরিয়ে নেওয়া হোক। কিন্তু দুই পক্ষই অনেক এগিয়ে যাওয়ায় কারো পক্ষেই আর সরে যাওয়া সম্ভব নয়।

আমান গ্রুপের নির্বাহী পরিচালক রবিউল হক কালের কণ্ঠকে বলেন, ঢাকা ওয়াসা যে জায়গা দিয়ে পাইপলাইন বসানোর নকশা করেছে, সেটি আমান অর্থনৈতিক অঞ্চলের ঠিক মাঝখানে। ঢাকা ওয়াসার এই উদ্যোগের কারণে আমাদের অর্থনৈতিক অঞ্চলের সমস্যা হচ্ছে। সরকার সারা দেশে যে ১০০টি অর্থনৈতিক অঞ্চল করার উদ্যোগ গ্রহণ করেছে, এটি তার একটি। আর ঢাকা ওয়াসার কর্মকর্তা ও প্রকল্প পরিচালক কামরুন নাহার লাইলি বলছেন, ‘প্রকল্পটি রাজধানীবাসীর জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এটি বাস্তবায়ন করতে না পারলে ঢাকায় সুপেয় পানি সরবরাহ করা কঠিন হবে। তাই প্রকল্প এলাকা অন্যত্র সরানোর সম্ভাবনা নেই।’

চলতি বছর ৩০ এপ্রিল প্রধানমন্ত্রীর এসডিজি বাস্তবায়নবিষয়ক সমন্বয়ক আবুল কালাম আজাদের কাছে চার রাষ্ট্রদূতের পাঠানো চিঠিতে বলা হয়েছে, মেঘনা নদীকে দূষণমুক্ত রাখতে এখনো উদ্যোগ গ্রহণ না করায় তাঁরা উদ্বিগ্ন। একই সঙ্গে মেঘনা নদীর দূষণ রোধে সরকার কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করবে, এমন প্রতিশ্রুতি চাওয়া হয়েছে ওই চিঠিতে। সবশেষে গত মাসে চার রাষ্ট্রদূতের পক্ষে জার্মানি দূতাবাসের ডেপুটি হেড অব কো-অপারেশন ক্যারেন ব্লুম আবারও আবুল কালাম আজাদের কাছে পাঠানো আরেক চিঠিতে মেঘনা নদীর দূষণ রোধে সরকারের নেওয়া পদক্ষেপের কথা জানাতে অনুরোধ করেছেন। সেটি এখনো জানানো হয়নি।

ঢাকা ওয়াসার দেওয়া তথ্য মতে, ঢাকা শহরে প্রতিদিন পানির গড় চাহিদা ২২০ কোটি লিটার, যার ৭৮ শতাংশ আসে ভূগর্ভস্থ উৎস থেকে। বাকিটা ভূ-উপরিভাগের পানি। ২০৩৫ সালের মধ্যে পানির চাহিদা বেড়ে দৈনিক ৬০০ কোটি লিটারে দাঁড়াবে। ভূগর্ভস্থ উৎস থেকে পানি তোলায় প্রতিবছর পানির স্তর দুই থেকে তিন মিটার নিচে নেমে যাচ্ছে। এমন বাস্তবতায় সরকার ভূগর্ভস্থের পরিবর্তে উপরিভাগের পানি ব্যবহারের ওপর জোর দিচ্ছে। তারই ধারাবাহিকতায় সায়েদাবাদ পানি শোধনাগার তৃতীয় পর্যায়ের প্রকল্পটি হাতে নেওয়া হয়। প্রকল্পটি বাস্তবায়ন হলে দৈনিক ৪৫০ মিলিয়ন লিটার পানি সরবরাহ করা সম্ভব হবে। অর্থায়ন জটিলতায় জনগুরুত্বপূর্ণ প্রকল্পটি স্থবির হয়ে পড়েছে।