[ শেষের পাতা ] 2018-01-13
 
পণ্যের শুল্কায়নে কাঙ্ক্ষিত গতি আসেনি
 
বিশ্ববাণিজ্যে অবস্থান শক্তিশালী করার অন্যতম শর্ত আমদানি-রফতানি প্রক্রিয়ায় সময় কমিয়ে আনা। কিন্তু এক্ষেত্রে এখনো কাঙ্ক্ষিত সাফল্য অর্জন করতে পারেনি বাংলাদেশ। অবকাঠামো দুর্বলতা ও যন্ত্রপাতি সংকটে চট্টগ্রাম বন্দরে পণ্য খালাসে যেমন বিলম্ব হচ্ছে, তেমনি চট্টগ্রাম কাস্টমসেও আমদানি পণ্যের শুল্কায়ন প্রক্রিয়ায় লেগে যাচ্ছে অতিরিক্ত সময়। এতে আমদানিকারকদের ব্যয়বৃদ্ধির পাশাপাশি বহির্বিশ্বেও সুনাম ক্ষুণ্ন হচ্ছে বাংলাদেশের।

বাংলাদেশে আমদানি-রফতানি পণ্যের সিংহভাগেরই শুল্কায়ন হয় চট্টগ্রাম কাস্টম হাউজে। দেশের সর্ববৃহত্ এ রাজস্ব আহরণকারী প্রতিষ্ঠানটির শুল্কায়ন প্রক্রিয়া নিয়ে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) এক পরিসংখ্যান বিশ্লেষণে দেখা গেছে, ২০১৫ সালের জুলাইয়ে চট্টগ্রাম কাস্টমসে আমদানিকারকের পক্ষ থেকে মোট ২৯ হাজার ৯০টি আগামপত্র (চালান) দাখিল করা হয়। এর মধ্যে একদিনে শুল্কায়ন করা গেছে এমন চালানের সংখ্যা ছিল ২০ হাজার ৬৬৯, যা ওই মাসের মোট চালানের ৭১ শতাংশ। কিন্তু এর দুই বছর পরে এসে একদিনে শুল্কায়ন সম্পন্নের হার না বেড়ে উল্টো কমেছে। ২০১৭ সালের জুলাইয়ে চট্টগ্রাম কাস্টমসে দাখিল করা ৪১ হাজার ৯৫৫টি আগামপত্রের মধ্যে ২৭ হাজার ৭৬৫টি বা ৬৬ শতাংশের শুল্কায়ন সম্পন্ন হয়েছে একদিনে। গত মাসের (ডিসেম্বর) চিত্রও প্রায় একই রকম। এ সময়ে দাখিল হওয়া ৩৯ হাজার ৫১১টি আগামপত্রের মধ্যে ২৬ হাজার ৬৬৭টি বা ৬৭ শতাংশের শুল্কায়ন একদিনে সম্পন্ন হয়।

একদিনে শুল্কায়ন সম্পন্ন হওয়া আগামপত্রের হার কমলেও শুল্কায়ন প্রক্রিয়ায় চারদিনের বেশি সময় লেগে যাওয়া আগামপত্রের হার বাড়ছে। এনবিআরের পরিসংখ্যান বলছে, ২০১৫ সালের জুলাইয়ে ১৫ শতাংশ আগামপত্রের শুল্কায়নে চারদিনের বেশি সময় লেগেছিল চট্টগ্রাম কাস্টমসে। কিন্তু ২০১৭ সালের জুলাইয়ে এসে এমন আগামপত্রের হার বেড়ে দাঁড়ায় ২১ শতাংশ।

চট্টগ্রাম চেম্বারের সভাপতি মাহবুবুল আলম এ প্রসঙ্গে বণিক বার্তাকে বলেন, ‘পণ্য আমদানিতে বাণিজ্য ব্যয় হ্রাসের জন্য শুল্কায়ন প্রক্রিয়ার সময় কমিয়ে আনার কোনো বিকল্প নেই। উন্নত বিশ্ব, এমনকি সার্কভুক্ত বিভিন্ন দেশেও আমদানি পণ্যের শুল্কায়ন প্রক্রিয়া একদিনেই সম্পন্ন করার ক্ষেত্রে বেশ সাফল্য আছে, যেটা বাংলাদেশে এখনো নেই। স্বল্প সময়ের মধ্যে আমদানি পণ্য খালাস ও বাজারজাতকরণ ভোক্তাদের স্বার্থেই জরুরি।’

চট্টগ্রাম কাস্টমস কর্তৃপক্ষের দাবি, পণ্যের শুল্কায়ন প্রক্রিয়া বিলম্বের জন্য কেবল কাস্টমস নয়, অন্য অনেকগুলো পক্ষও দায়ী। কাস্টমসের শুল্কায়ন কার্যক্রমে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে সম্পৃক্ত রয়েছে চট্টগ্রাম বন্দর, কোয়ান্টাম, বিএসটিআই, পরমাণু শক্তি কমিশন, বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ, বিজিএমইএ, বাংলাদেশ অর্থনৈতিক অঞ্চল কর্তৃপক্ষ, ইপিজেড, বাংলাদেশ রপ্তানী প্রক্রিয়াকরণ কর্তৃপক্ষ, পরিবেশ অধিদপ্তর ও বিস্ফোরক অধিদপ্তর। শুল্কায়নের আগে সুনির্দিষ্ট পণ্যের ক্ষেত্রে এসব প্রতিষ্ঠানের ছাড়পত্র দ্রুত পাওয়া না গেলে শুল্কায়ন কার্যক্রমে বিলম্ব ঘটে। বর্তমানে আমদানি-রফতানি প্রক্রিয়ার সঙ্গে জড়িত অন্য সংস্থাগুলোকে নিয়ে ওয়ান স্টপ সার্ভিস না থাকাটাও শুল্কায়ন প্রক্রিয়া বিলম্বের অন্যতম কারণ।

এ বিষয়ে চট্টগ্রাম কাস্টমসের অতিরিক্ত কমিশনার মোহাম্মদ শফি উদ্দিন বলেন, ‘অন্য কোনো সংস্থার কোনো ধরনের সংশ্লিষ্টতা থাকলে তাদের ছাড়পত্র নিয়েই পণ্যের শুল্কায়ন কার্যক্রম শেষ করতে হয়। সেক্ষেত্রে সময়ক্ষেপণ হয় বেশি। আবার চালান পরীক্ষা-নিরীক্ষার কাজও থাকে।’

উদ্যোক্তা ও আমদানিকারকরা জানান, বিশ্ববাণিজ্যে প্রতিযোগিতায় টিকে থাকা, জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার বাড়ানো ও প্রত্যক্ষ বিদেশী বিনিয়োগের ক্ষেত্র প্রস্তুত করার জন্য অথরাইজড ইকোনমিক অপারেটরস (এইও), রিস্ক ম্যানেজমেন্ট মডিউল (আরএমএম) ও ন্যাশনাল ট্রেড ম্যানেজমেন্ট পোর্টাল (এনটিএমপি) বাস্তবায়ন খুবই জরুরি। এসব সুবিধা নিশ্চিত করা গেলে বন্দরের অভ্যন্তরে পণ্য পরীক্ষণে সময় অনেক কমে আসবে। এতে শুল্কায়ন কার্যক্রমও দ্রুত সম্পন্ন করা যাবে। টাইমরিলিজ স্টাডি বা সময়মতো পণ্য খালাসসহ অবাধ ব্যবসা-বাণিজ্যের সুবিধার্থে জাপানে অনুষ্ঠিত ‘রিভাইজড কিয়োটো কনভেনশনে’ এশিয়ার বিভিন্ন দেশের মধ্যে একটি চুক্তিও হয়েছিল।

প্রিমিয়ার সিমেন্ট লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ আমিরুল হক বলেন, ‘রিভাইজড কিয়োটো কনভেনশন’ ও ওয়ার্ল্ড কাস্টমস অর্গানাইজেশনের ‘সেফ ফ্রেমওয়ার্ক অব স্ট্যান্ডার্ডস’ চুক্তিতে বাংলাদেশ কয়েক বছর আগেই স্বাক্ষর করেছে। এখন সেগুলো দ্রুত বাস্তবায়নের দিকে যেতে হবে। পৃথিবীর বহু দেশ এসব চুক্তি বাস্তবায়নের সুফল ভোগ করছে এখন। ব্যবসা ও বিনিয়োগবান্ধব পরিবেশ সৃষ্টিতে দ্রুত পণ্য খালাস করতেই হবে আমাদের।

দেশে প্রতি বছরই ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রসার ঘটছে। চট্টগ্রাম কাস্টমসের তথ্যমতে, ২০১৫-১৬ অর্থবছরে ২৭ হাজার আগামপত্রের বিপরীতে চট্টগ্রাম বন্দর থেকে পণ্য খালাস হয় ৫ কোটি ৮৩ লাখ টন। ২০১৬-১৭ অর্থবছরে ১০ লাখ ৪৩ হাজারটি আগামপত্রের বিপরীতে খালাস হয় ৬ কোটি ৬৫ লাখ টন পণ্য। সে হিসাবে আগামপত্র ছাড়করণে প্রবৃদ্ধি হয়েছে ১৩ শতাংশ। প্রতি বছর আমদানির পরিমাণ বাড়লেও সে তুলনায় গতি আসেনি শুল্কায়ন কার্যক্রমে।

এ বিষয়ে এনবিআরের প্রথম সচিব মোহাম্মদ এহতেশামুল হক বলেন, আগামপত্র দাখিল হওয়ার পর শুল্কায়ন প্রক্রিয়া কীভাবে আরো দ্রুত সম্পন্ন করা যায়, তা নিয়ে প্রতিনিয়তই পরিকল্পনা ও কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে । অথরাইজড ইকোনমিক অপারেটরস, রিস্ক ম্যানেজমেন্ট মডিউল ও সিঙ্গেল উইন্ডোর মতো বেশকিছু বড় গুরুত্বপূর্ণ পদ্ধতি বাস্তবায়নের মধ্য দিয়ে শুল্কায়নের সময়সীমা কমানো হবে।
Print Close  
Print Close  
News Source
            Top
            Top
 
Home / About Us / Benifits /Invite a Friend / Policy
Copyright © Hawker 2009-2010, Allright Reserved