[ শেষের পাতা ] 2018-01-13
 
মালদ্বীপে বাংলাদেশীদের ঘাটে ঘাটে বিপদ
হাইকমিশনের ভূমিকা প্রশ্নবিদ্ধ; অবৈধ পথে মালদ্বীপ যাওয়ার হিড়িক
 
মনির হোসেন :

বিশ্বে দ্বীপরাষ্ট্র হিসেবে পরিচিত মালদ্বীপে পাড়ি জমানো বেশির ভাগ শ্রমিক বর্তমানে নানা সমস্যায় জর্জরিত। আদমপাচারকারী সিন্ডিকেটের খপ্পরে অবৈধ পথে দেশটিতে যাওয়ায় তাদের যেন বিপদ পিছু ছাড়ছে না। এর ওপর আবার দেশটিতে নিযুক্ত বাংলাদেশ হাইকমিশনের শ্রম বিভাগের কর্মকর্তাদের অসহযোগিতার কারণে শ্রমিকদের ঘাটে ঘাটে বিপদ দেখা দিচ্ছে।

ভুক্তভোগী ও প্রতারিত শ্রমিকদের অভিযোগÑ মালদ্বীপে যারা পাড়ি দিয়েছেন তাদের মধ্যে শতকরা ৭০ ভাগ কর্মীই পাসপোর্টসহ নানাবিধ সমস্যার মধ্যে আছেন। এসব অসহায় কর্মী বিপদ থেকে উদ্ধার পেতে হাইকমিশনের দ্বারস্থ হলেও তারা কাক্সিক্ষত সেবার বদলে আরো বেশি হয়রানির শিকার হচ্ছেন। কেউ কেউ দেশে ফিরতে দিনের পর দিন অপেক্ষা করে অসুস্থ হয়ে পড়ছেন। তার পরও পাচ্ছেন না ট্রাভেল পাস। এর কারণে দেশে ফেরাও অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে অনেকের। তবে হাইকমিশনে দালালদের কদর বেশি বলে অভিযোগ রয়েছে। এ দিকে দেশটিতে অবৈধ পথে বাংলাদেশী যাওয়ার সংখ্যা বেড়ে যাওয়ায় দালালদের উৎপাতও বেড়েছে। বেড়েছে মুক্তিপণসহ নানবিধ অপরাধও।

সম্প্রতি মালদ্বীপের রাজধানী মালেতে বাংলাদেশ হাইকমিশনের সামনে থেকে হারুনুর রশীদ নামে এক ব্যক্তিকে অপহরণকারীরা চোখ বেঁধে গাড়িতে তুলে অজ্ঞাত স্থানে নিয়ে আটকে রাখেন। তার ছেলে রাজিব বিষয়টি জানতে পেরে থানায় মামলা করেন। অভিযোগ পেয়ে পুলিশ অপহরণকারী দলের প্রধান কবিরসহ দু’জনকে গ্রেফতার করে রিমান্ডে নেয়। এ ঘটনার জেরে অপহৃত হারুনুর রশীদ হাইকমিশন থেকে দেশে ফিরতে ট্রাভেল পাস নিতে গেলে লেবার উইংয়ের কর্মকর্তা আল মামুন পাঠান গড়িমসি করছেন। এ কারণে হার্টের রোগী হারুন এক মাসেও দেশে ফিরতে পারেননি। হারুনকে দেশে ফিরতে দেয়ার জন্য পরে অপহরণ মামলার তদন্তকারী পুলিশ কর্মকর্তা মামুনকে অনুরোধ জানান। প্রবাসীকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রীর ব্যক্তিগত কর্মকর্তা (পিএস) মুহসীন চৌধুরীসহ অনেকেই হস্তক্ষেপ করেন। কিন্তু তিনি কারো কথাই শুনছেন না। বরং তিনি অপহরণকারীদের পক্ষ নিয়ে উল্টো হারুন ও তার ছেলেকে হুমকিধমকি দিয়ে যাচ্ছেন বলে অভিযোগ উঠেছে।

গতকাল মালদ্বীপে নিযুক্ত লেবার উইংয়ের কর্মকর্তা আল মামুনের সাথে যোগাযোগ করা হলে তাকে পাওয়া যায়নি। পরে লেবার কাউন্সিলর টি কে এম মুশফিকুর রহমানের বক্তব্য নেয়ার চেষ্টা করা হয়। তাকেও পাওয়া যায়নি। যদিও শুক্র ও শনিবার দেশটির সাপ্তাহিক ছুটির দিন।

প্রবাসীকল্যাণ মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, ২০১৭ সালের ৯ ডিসেম্বর মালের বাংলাদেশ হাইকমিশনে কাজ শেষে বাসায় ফিরতে গাড়ির জন্য অপেক্ষা করছিলেন ময়মনসিংহ ভালুকার আংগারগারা গ্রামের বাসিন্দা হারুনুর রশীদ। কিন্তু তিনি কিছু বুঝে ওঠার আগেই ছয়-সাতজন দুর্বৃত্ত তাকে মারধর করে গাড়িতে তুলে অজ্ঞাত স্থানে নিয়ে যায়। খবর পেয়ে তার ছেলে রাজীব ১০ ডিসেম্বর থানায় মামলা করেন। পুলিশ অভিযোগ পেয়ে ৫২ বছর বয়সী হারুনকে একটি ফ্ল্যাট থেকে অক্ষত অবস্থায় উদ্ধার করে। এ সময় জড়িত সন্দেহে এজাহারভুক্ত আসামি বাংলাদেশী কথিত অপহরণকারী দলের প্রধান কবিরসহ দুইজনকে গ্রেফতার করে পুলিশ। পরে রিমান্ডে নিয়ে অপহরণ রহস্য উদঘাটনে জিজ্ঞাসাবাদ শুরু করে। বিষয়টি মালদ্বীপের জাতীয় পত্রিকা ও অনলাইনেও প্রকাশিত হয়। পরে কবির ও তার সহযোগী জামিনে মুক্তি পান। এরপরই হারুনের দেশে ফেরার ব্যাপারে জটিলতা দেখা দেয়।

গতকাল মালদ্বীপ থেকে টেলিফোনে হারুনুর রশীদের ছেলে রাজীব নয়া দিগন্তকে বলেন, আমার বাবাকে অপহরণকারীদের হাত থেকে উদ্ধার করতে পারলেও এক মাসেও দেশে ফেরাত পারিনি। বাবা হার্টের রোগী। তার দেশে ফিরতে হলে ট্রাভেল পাস দরকার। হাইকমিশনে লোক পাঠিয়েছি। কিন্তু লেবার উইং কর্মকর্তা আল মামুন পাঠান স্যার দিতে চাচ্ছেন না। আমি নাকি তাকে টেলিফোনে হুমকি দিয়েছি। আমাকে আগে হাইকমিশনে যেতে হবে। এখন বলছেন মামলা নিষ্পত্তি হোক। তিনি বলেন, পুলিশ গিয়ে তাকে অনুরোধ করেছে। প্রবাসীকল্যাণ মন্ত্রীর পিএস স্যারের কথা বলেছি। তিনি কারো কথাই শুনছেন না।

এক প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, বাবাকে দেশে পাঠাতে হলে তিন পাতার ট্রাভেল পাস দরকার। ২০ ইউএস ডলারে এটি হাইকমিশন থেকে দেয়া হয়। কিন্তু যারা দেশে ফিরতে চাচ্ছেন তারা কেউ দালাল ছাড়া ফিরতে পারছেন না। প্রতি পাসপোর্ট, টিকিট ও অন্যান্য খরচ মিলিয়ে প্যাকেজ হিসেবে দালালরা ছয় হাজার মালদ্বীপ রুপি নিচ্ছে। অপহরণকারী কবির প্রসঙ্গে বলেন, কবিরসহ বাংলাদেশী একটি সিন্ডিকেট তৈরি করেছে। যারা অবৈধভাবে এ দেশে আসছে তাদের ভয়ভীতি দেখিয়ে নগদ কামাই করাই তাদের কাজ। এখানে এরা অনেক বছর ধরে আছে। বিয়ে এ দেশে করেছে। তাদের বিরুদ্ধে কেউ কথা বললেই গুম করার চেষ্টা করে। কেন কবির আপনার বাবার ওপর ক্ষিপ্তÑ জানতে চাইলে তিনি বলেন, কবীর বলে, আমার বাবার কাছে নাকি চর লাখ টাকা পাবে।

এ দিকে মালদ্বীপের একটি রিসোর্ট থেকে রুস্তম ও জয়নাল নামের দুই বাংলাদেশী গতকাল নয়া দিগন্তকে টেলিফোনে বলেন, তারা মালদ্বীপে থাকলেও তাদের প্রতিটি মুহূর্ত কাটে অনিশ্চয়তায়। কাজ করার পরও রিসোর্টের মালিক ঠিকমতো বেতন দেয় না। কোনো কোনো মালিক দুই-তিন মাস খাটানোর পর বলে, ‘তুই চলে যা’। না গেলে পুলিশে ধরিয়ে দেয়ার ভয় দেখায়। তবে যারা কোম্পানি, ফিশিংয়ের নামে আসছেন তাদের সমস্যা হয় না। তারা মাস শেষে বেতন পান লাখ টাকার মতো।
জনশক্তি কর্মসংস্থান ব্যুরোর এক কর্মকর্তা নয়া দিগন্তকে বলেন, মালদ্বীপের নামে কিছু বহির্গমন ছাড়পত্র দেয়া হচ্ছে। তবে একশ্রেণীর দালাল অবৈধ পথে বিমানবন্দর দিয়ে প্রতিদিন লোক পাঠাচ্ছে। দালালেরা আড়াই লাখ টাকার চুক্তিতে টুরিস্ট ভিসায় প্রথমে ঢাকা থেকে শ্রীলঙ্কায় নিয়ে যাচ্ছে। সেখান থেকে আবার ভিসা লাগিয়ে মালদ্বীপে নিয়ে যাচ্ছে। এমন অবৈধ শ্রমিকের সংখ্যা শতকরা ৭০ ভাগ। এখন শ্রীলঙ্কা ছাড়াও ভারতের রুট দিয়ে অবৈধ লোক পাঠানো হচ্ছে বলে অভিযোগ করেন তিনি। তাদের মতে, যারা অবৈধ পথে যাচ্ছেন তারাই রয়েছেন পাসপোর্ট করা, নতুন পাসপোর্ট নবায়নসহ নানা ধরনের বিপদে। এই সংখ্যা অর্ধলক্ষাধিক হবে বলে তিনি মনে করছেন।
Print Close  
Print Close  
News Source
            Top
            Top
 
Home / About Us / Benifits /Invite a Friend / Policy
Copyright © Hawker 2009-2010, Allright Reserved