[ প্রথম পাতা ] 2018-06-14
 
নেতারা এলাকায়
নির্বাচনী ঈদে চাঙ্গা গ্রামীণ অর্থনীতি
একাদশ সংসদ নির্বাচনের আর মাস ছয়েক বাকি। তাই সব রাজনৈতিক দলের নেতারা ছুটছেন নিজ নিজ নির্বাচনী এলাকায়
 
সাখাওয়াত হোসেন :

সংবিধান অনুযায়ী একাদশ সংসদ নির্বাচন হবে আর মাত্র মাস ছয়েক পর। সে হিসাবে ভোটের আগে এটিই শেষ ঈদুল ফিতর। তাই সব রাজনৈতিক দলের নেতারা ছুটছেন নিজ নিজ নির্বাচনী এলাকায়। সম্ভাব্য প্রার্থীদের আনাগোনায় সরগরম হয়ে উঠছে গ্রামীণ জনপদ। ঈদ আয়োজনে যুক্ত হয়েছে নির্বাচনী আমেজ। রমজান মাসজুড়ে ইফতার মাহফিলসহ নানা কৌশলে প্রচার ও গণসংযোগ করলেও শেষ সময়ে এসে ঈদ শুভেচ্ছা-উপঢৌকনের নামে দু'হাতে নগদ টাকা ছড়াচ্ছেন তারা। গরিবদের মধ্যে বিলাচ্ছেন যাকাতের কাপড়, সেমাই-চিনিসহ বিভিন্ন খাদ্যসামগ্রী।

এর ওপর চাকরিজীবী শহুরে মানুষ শেকড়ের টানে প্রিয়জনের সঙ্গে ঈদ আনন্দ ভাগাভাগি করে নিতে বেতন-বোনাসের সঙ্গে সঞ্চয়ের নগদ টাকা নিয়ে ফিরছেন নিজ গাঁয়ে। বিদেশ থেকেও পরিবার-পরিজনের জন্য এসেছে বিপুল প্রবাসী আয়। প্রবাসী ও শহুরে মানুষের যাকাত, ফিতরা ও দান-খয়রাতের অর্থের সিংহভাগই গেছে গ্রামে। সব মিলিয়ে ঈদকে ঘিরে বেড়েছে টাকার লেনদেন, ফলে চাঙ্গা গ্রামীণ অর্থনীতি।

অর্থনীতিবিদরা জানান, ঈদ উপলক্ষে চাকরিজীবী ও শ্রমজীবী মানুষের প্রাপ্ত বোনাসের একটি বড় অংশই যায় গ্রামে। এছাড়া ঈদ উপলক্ষে গ্রামীণ কিছু পণ্যের চাহিদা শহরে বাড়ে। এসব পণ্যের সঙ্গে সংশিস্নষ্টদের আয়ও বাড়ে, যা গ্রামীণ অর্থনীতিকে সরগরম করে তোলে।

তৈরি পোশাক শিল্প মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএর তথ্য মতে, এ শিল্পে ৪০ লাখ শ্রমিক কাজ করেন। এসব শ্রমিকের ৯৫ শতাংশই গ্রাম থেকে আসা। যার ৭০ শতাংশই ঈদের ছুটিতে গ্রামের বাড়ি যান। তাই কয়েক মাস আগ থেকেই তারা টাকা জমাতে থাকেন ঈদের জন্য। এর সঙ্গে বেতন- বোনাসের পুরো অর্থই খরচ হয় ঈদকে ঘিরে।

বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে পাওয়া তথ্যানুযায়ী, এবার ঈদুল ফিতরকে সামনে রেখে প্রবাসীরা প্রচুর প্রবাসী আয় দেশে পাঠিয়েছে। সারা বছর প্রবাসী আয়ের খরা থাকলেও মে মাসে রেকর্ড পরিমাণ প্রবাসী আয় এসেছে। সদ্য বিদায়ী মে মাসে প্রবাসীরা ব্যাংকিং চ্যানেলে ১৪৮ কোটি ২৮ লাখ ডলারেরও বেশি প্রবাসী আয় পাঠিয়েছেন, যা একক মাস হিসাবে গত ৫ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ। এছাড়াও জুন মাসের শুরম্ন থেকেই প্রচুর প্রবাসী আয় আসছে, যার সিংহভাগই গেছে গ্রামে।

এদিকে জাতীয় সংসদ নির্বাচনে মনোনয়নপ্রত্যাশী প্রার্থী এবং বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের প্রথম সারির নেতারা নির্বাচনী ঈদকে ঘিরে কী পরিমাণ টাকা নিজ নিজ নির্বাচনী এলাকায় নিয়ে গেছেন তার সঠিক পরিসংখ্যান না থাকলেও তা আনুমানিক দেড় হাজার কোটি টাকার কম নয় বলে মনে করেন অর্থনীতিবিদরা। তাদের ভাষ্য, ৩০০ আসনের মধ্যে অন্ত্মত ২০০ আসনে গড়ে দুজন করে ৪০০ বিত্তশালী রাজনীতিবিদ রয়েছেন। যারা এবারের ঈদকে ঘিরে দান-খয়রাত-বকশিশ ও শুভেচ্ছা উপহার দেয়ার মধ্য দিয়ে এলাকায় নিজের শক্তিশালী অবস্থান গড়ে দলীয় মনোনয়ন পাওয়ার সর্বোচ্চ চেষ্টা চালাচ্ছেন। আবার তাদের পক্ষে ঘনিষ্ঠজন ও বিশেষ সুযোগ-সুবিধাভোগীরাও অনেকে গোপনে-প্রকাশ্যে বিপুল টাকা উড়াচ্ছেন। এককথায় নির্বাচনী ঈদকে ঘিরে গ্রামে টাকার প্রবাহ সাধারণ সময়ের চেয়ে কয়েক গুণ বেড়েছে।

স্থানীয়রা জানান, গ্রামীণ অর্থনীতির এ চাঙ্গাভাবে বেশ কিছুদিন স্থায়ী হবে এমন আশায় শহরে দিনমজুর কিংবা রিকশা চালিয়ে অর্থ উপার্জনকারী ভাসমান শ্রমিকরা অনেকে বেশ কিছুটা সময় হাতে নিয়েই ঘরে ফিরেছেন। তাদের অনেকেই নির্বাচনের আগপর্যন্ত্ম গ্রামে থেকেই প্রচার-প্রচারণার মাঠ থেকে আয় উপার্জনের পথ খুঁজে নেবেন। ঈদকে ঘিরে যার মহড়া কোথাও কোথাও এখনই শুরম্ন হয়ে গেছে।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, প্রকাশ্যে দাপটের সঙ্গে নির্বাচনী তৎপরতা চালাচ্ছেন ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের মন্ত্রী-এমপি ও সম্ভাব্য প্রার্থীরা। অনেকে আবার মনোনয়ন লড়াইয়ে 'বিজয়ী' হতে চাইছেন মাঠ দখল করে। তাদের অনেকে দীর্ঘদিন এলাকায় না গেলেও এবার ঈদ করছেন গ্রামে। দলের নেতাকর্মীদের দিচ্ছেন ঈদের বকশিশ, পাঞ্জাবি-পায়জামার মতো উপঢৌকন। ছবি সংবলিত পোস্টার, ডিজিটাল ব্যানার এবং দেয়াল লিখনের মাধ্যমে ঈদের শুভেচ্ছা জানাচ্ছেন তারা। তবে মামলা-হামলার ভয়ে অনেকটা নিভৃতে কৌশলে গণসংযোগ চালাচ্ছেন বিরোধীদলীয় নেতারা। ২০১৪ সালে দশম সংসদ নির্বাচন বর্জন করলেও এবার নির্বাচনে অংশগ্রহণের সার্বিক প্রস্তুতি নিয়েছে বিএনপি। জাতীয় পার্টিসহ অন্যান্য ছোট রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীরাও সরব। ঈদ বকশিশেও তারাও খরচ করছেন দু'হাতে।
রাজনৈতিক সূত্রগুলো জানায়, বিভিন্ন সংস্থার জরিপে জনপ্রিয়তা প্রমাণে ব্যর্থ হলে দলীয় সংসদ সদস্যরা মনোনয়ন হারাবেন। এগিয়ে থাকবেন গ্রহণযোগ্যরা- আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরের এমন ঘোষণার পর ক্ষমতাসীন দলের রাজনীতিকরা নিজ নিজ অবস্থান শক্তিশালী করতে উঠেপড়ে লেগেছেন। আর ঈদকেই তারা এর সফলতা অর্জনের অন্যতম টার্গেট হিসেবে নিয়েছেন।

মনোনয়নপ্রত্যাশী অনেকে যাকাতের বড় অংশই এবারের নিজস্ব নির্বাচনী এলাকায় খরচ করছেন। তারা নিজ উপস্থিতিতে যাকাত বিতরণ করছেন। এমনকি কেউ কেউ গভীর রাতে বাড়ি বাড়ি ঘুরে দলের নিষ্ঠাবান দরিদ্র নেতাকর্মীদের হাতে যাকাতের শাড়ি-লুঙ্গি ও নগদ টাকা পৌঁছে দিচ্ছেন। সব মিলিয়ে গ্রামের একেবার অসচ্ছল মানুষের হাতেও নগদ টাকা যাবে।

বলা যায় এবার ঈদ উপলক্ষে 'নির্বাচনের বাতাস' গ্রামগঞ্জের পুরো চিত্রই পাল্টে দিয়েছে। বাজার-হাটে সর্বত্রই নির্বাচনী শোরগোল। ক্ষমতাসীন দলের নেতাদের মধ্যে এই শোরগোল সবচেয়ে বেশি। নির্বাচনী এলাকায় জনপ্রিয়তা নিয়ে গোয়েন্দারা কী রিপোর্ট দিয়েছে, কোন মিডিয়ায় কোন নেতা প্রার্থী হতে পারেন বলে আগাম বার্তা দিয়ে রিপোর্ট করেছে, কোন নেতার প্রতি কেন্দ্রীয় কোন নেতার আশীর্বাদ বা বিরোধ রয়েছে, কারা প্রার্থী হওয়ার জন্য দৌড়ঝাঁপ করছেন, কারা প্রার্থী হয়ে আসছেন, মনোনয়ন দৌড়ে কোন দলের কোন নেতা-নেত্রী বেশি এগিয়ে, কারা গ্রাম ও গ্রামের মানুষের প্রতি আন্ত্মরিক, এমন নানা বিষয়ে তর্কবিতর্ক ও চুলচেরা বিশেস্নষণ চলছে গ্রামের হাটবাজার ও জনসমাবেশে।

গ্রামাঞ্চলের সূত্রগুলো জানায়, এতদিন মনে হতো গ্রামের রাজনীতিতে শুধুই আওয়ামী লীগ আর নৌকা। বিএনপি ও ধানের শীষের লোকজন ছিল নীরব। তবে পরিস্থিতি এখন অনেকটাই পাল্টেছে। প্রতিকূল রাজনৈতিক আবহাওয়ার কারণে এতদিন বিএনপির মাঠপর্যায়ের নেতাকর্মীদের পিছুটান লক্ষ করা গেলেও সম্প্রতি তাদের মাঝে চাঙ্গাভাব বিরাজ করছে। বিশেষ করে ঈদকে সামনে রেখে গ্রামাঞ্চলে এর জোরালো প্রভাব দেখা গেছে।

অন্যদিকে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের মধ্যেও ঈদ নিয়ে নির্বাচনী উৎসব ভাব লক্ষণীয়। সংসদের এমপি এবং গুরম্নত্বপূর্ণ পদে সক্রিয়দের পাশাপাশি দীর্ঘদিন যারা এলাকাবিমুখ ছিলেন; নেতাকর্মীর ভয়ে যে এমপিরা এলাকায় আসতে ভয় পেতেন; তারা নির্বাচনী ঈদে নিজ নিজ এলাকায় পা রাখছেন। এলাকায় প্রভাব রয়েছে, এমন নেতাদের কাছে টানতে তাদের বকশিশের পরিমাণ একটু বেশি দিচ্ছেন। সে টাকায় গ্রামাঞ্চলের মার্কেটগুলোতে কেনাকাটা হচ্ছে।

ঈদকে ঘিরে এরইমধ্যে মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে গ্রামে আর্থিক লেনদেনও প্রায় ২০ শতাংশ বেড়েছে। এছাড়া আত্মীয়স্বজন ও বন্ধু-বান্ধবের মাধ্যমে গ্রামে টাকা পাঠানোসহ বিকল্প অন্যান্য ব্যবস্থাতেও লেনদেন মে মাসের শেষভাগ থেকেই বেড়ে চলেছে। যা ঈদের এক-দুদিন আগ পর্যন্ত্ম অব্যাহত থাকবে। এসব টাকার প্রায় পুরোটাই ঈদের আগেই গ্রামে খরচ হয়।

অর্থনীতিবিদরা বলছেন, ঈদোৎসব ঘিরে বিভিন্ন খাতে বিপুল অঙ্কের অর্থ হাতবদল হয়, যা অর্থনৈতিক কর্মকা- চাঙ্গা করে তোলে। এর মধ্যে ঈদুল ফিতরে সবচেয়ে বেশি অর্থ ব্যয় হয় নতুন পোশাক ক্রয়ে। কেননা গ্রামাঞ্চলের মানুষের একটি বড় অংশই জামা-কাপড় কেনেন ঈদকে কেন্দ্র করে।

এদিকে ঈদকে কেন্দ্র করে গ্রামীণ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলোতে এমনিতেই পণ্য উৎপাদনের ধুম পড়ে। এর সঙ্গে এবার নির্বাচনী প্রচার-প্রচারণার অনুষঙ্গ যোগ হওয়ায় এগুলোর বাড়তি চাহিদা তৈরি হয়েছে। কেননা মনোনয়নপ্রত্যাশী অনেকে শহর থেকে পোশাক-শাড়ি-লুঙ্গি না কিনে স্থানীয় কুটির শিল্প থেকেই তা সংগ্রহ করছে। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, টাঙ্গাইলের তাঁতের শাড়ির চাহিদা অন্যান্য ঈদের চেয়ে এবার অন্ত্মত ২০ ভাগ বেড়েছে। যার একটি বড় অংশ স্থানীয় জনপ্রতিনিধি, রাজনৈতিক নেতা ও মনোনয়নপ্রত্যাশীরা অর্ডার দিয়েছে। এ চাহিদা মেটাতে ওই এলাকায় তাঁত মালিক ও তাঁতিদের ১০ রোজার পর থেকেই ঘুম নেই।

বগুড়া, সিরাজগঞ্জ অঞ্চলের লুঙ্গি ও তাঁতের কাপড়ের কাটতিও এবার অন্যান্য ঈদের চেয়ে অনেক বেশি। সংশিস্নষ্টরা জানান, পাইকারি ব্যবসায়ী ছাড়াও বিপুল সংখ্যক জনপ্রতিনিধি, রাজনীতিবিদ ও নির্বাচনে মনোনয়নপ্রত্যাশী এবার বড় দাগে শাড়ি-লুঙ্গির অর্ডার দিয়েছেন। যা তারা স্থানীয়ভাবে বিলি করবেন বলে জানিয়েছেন। এতে তাদের কাজের চাপ ভীষণভাবে বেড়েছে। নরসিংদীর বাবুরহাট ও নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জের কুটির শিল্পগুলোতেও একই অবস্থা চলছে। এসব পণ্য বিক্রির টাকা গ্রামেই থেকে যাওয়ায় গ্রামীণ অর্থনীতি অন্য যেকোনো সময়ের চেয়ে কয়েকগুণ শক্তিশালী বলে জানান ব্যবসায়ীরা।
Print Close  
Print Close  
News Source
            Top
            Top
 
Home / About Us / Benifits /Invite a Friend / Policy
Copyright © Hawker 2009-2010, Allright Reserved