[ প্রথম পাতা ] 2018-06-14 |
|
|
|
|
চাঙ্গা অর্থনীতি বেড়েছে টাকার প্রবাহ
|
|
|
হারুন-অর-রশিদ :
আসন্ন ঈদুল ফিতর কেন্দ্র করে জমে উঠেছে নগদ টাকার অর্থনীতি। বরাবরই ঈদ উৎসবকালে বাজার, ব্যাংক, যোগাযোগ খাত, বিনোদনকেন্দ্রÑ সর্বত্রই চলে টাকার ওড়াউড়ি। ঈদকেন্দ্রিক গ্রামীণ অর্থনীতিও থাকে অনেক চাঙ্গা। ঈদের বাড়তি চাহিদার কারণে বাজারে টাকার প্রবাহ বেড়ে যায়। এবারও এর ব্যত্যয় ঘটেনি।
ধর্মীয়ভাবে মুসলমানদের সবচেয়ে বড় ধর্মীয় উৎসব ঈদ। তাই নগদ টাকার চাহিদার কারণে একেবারে
নিম্নস্তর থেকে সর্বোচ্চ পর্যায় পর্যন্ত বাজারের নিয়ামক উৎসগুলো এ সময়ে অনেক বেশি সক্রিয় হয়ে ওঠে। ছোট-বড় সব ধরনের ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে বেড়ে যায় অর্থের প্রবাহ। বিদেশি পণ্যগুলোর আমদানিও বাড়ে ব্যাপক হারে। এসব কাজের জন্য বাড়তি অর্থ ও শ্রমের প্রয়োজন হয়। এ জন্য ব্যাংক এবং নিজের জমানো অর্থ বিনিয়োগ করেন উদ্যোক্তারা। এতে বাজার চাঙ্গা হয়। উৎপাদিত পণ্যের বিক্রি বেশি থাকায় কর্মজীবী মানুষের আয়ও ঈদের সময় বাড়ে। তাদের ক্রয়ক্ষমতা অনেক বেশি হয়। ফলে কেনাকাটাও হয় বেশি।
বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসেবে দেখা যায়, ঈদের সময় ব্যাংকের ভল্ট থেকে টাকা বের হয়ে মানুষের পকেটে চলে যায় অনেক বেশি হারে। গত বছর ঈদ পালিত হয় জুন মাসে। ওই জুনে মে মাসের তুলনায় ব্যাংকের বাইরে থাকা টাকার প্রবাহ বাড়ে সাড়ে ১৭ শতাংশ। জুনে ব্যাংকের বাইরে চলে যাওয়া টাকার পরিমাণ এক লাখ ৩৭ হাজার ৫৩১ কোটি টাকা। মে মাসে যা ছিল এক লাখ ১৭ হাজার ১৩৬ কোটি টাকা। মে মাসে এপ্রিলের তুলনায় ব্যাংকের বাইরে যাওয়ার পরিমাণ বাড়ে মাত্র ৩ শতাংশ। ঈদ শেষ হওয়ার পর জুলাইয়ে পকেট থেকে টাকা ব্যাংকে চলে যায়, যার ফলে জুলাইয়ে জুনের তুলনায় বাজারে টাকার পরিমাণ ৮ শতাংশ কমে যায়।
রোজা ও ঈদ উৎসবের অর্থনীতি নিয়ে এফবিসিসিআইয়ের এক সমীক্ষায় বলা হয়, এ সময় ইফতার ও সেহরি উৎসবে যোগ হয় ৪ হাজার ৮০০ কোটি টাকা। পোশাকের বাজারে যোগ হচ্ছে ৩২ হাজার কোটি টাকা। রমজান ও ঈদে অ্যাপায়ন বাবদ অর্থাৎ ভোগ্যপণ্যের বাজারে বাড়তি যোগ হচ্ছে ২৪ হাজার কোটি টাকা। ধনী মানুষের দেওয়া জাকাত ও ফিতরা বাবদ আসছে ৬০ হাজার ৪০০ কোটি টাকা। পরিবহন খাতে অতিরিক্ত যাচ্ছে ৬০০ কোটি টাকা। ঈদকেন্দ্র করে ভ্রমণ ও বিনোদন বাবদ ব্যয় হয় ৪ হাজার কোটি টাকা। এসব খাতে নিয়মিত প্রবাহের বাইরে অতিরিক্ত যোগ হচ্ছে এক লাখ ২৫ হাজার ২০০ কোটি টাকা।
এর বাইরে আরও কয়েকটি খাতের কর্মকা- অর্থনীতিতে যোগ হচ্ছে। এর মধ্যে রয়েছে সাড়ে ২০ লাখ সরকারি কর্মকর্তা ও কর্মচারীর সম্ভাব্য বোনাস বাবদ প্রায় ১২ হাজার কোটি টাকা, দেশব্যাপী ৬০ লাখ দোকান কর্মচারীর বোনাস ৫ হাজার কোটি টাকা, পোশাক ও বস্ত্র খাতের ৭০ লাখ শ্রমিকের সম্ভাব্য বোনাস ৩ হাজার কোটি টাকা, যা ঈদ অর্থনীতিতে বাড়তি আসছে। এ ছাড়া আরও রয়েছে প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্স। ঈদের সময়ে প্রবাসীরা তাদের আত্মীয়স্বজনের কাছে বাড়তি ব্যয় মেটাতে প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা পাঠিয়ে থাকেন। এ হিসাবে আরও বাড়তি আসছে প্রায় ৪ হাজার কোটি টাকা। এসব মিলে ঈদবাজারে বাড়তি যোগ হচ্ছে দেড় থেকে ২ লাখ কোটি টাকা।
ব্যবসায়ীরা জানান, প্রতিবছরই ঈদ অর্থনীতির আকার ১০-১৫ শতাংশ হারে বাড়ছে। ফলে অর্থনীতিও চাঙ্গা হয়ে উঠছে।
এদিকে ঈদকেন্দ্রিক গ্রামের টাকার প্রবাহ বাড়ে সবচেয়ে বেশি। দেশের জনগোষ্ঠীর বড় একটি অংশের বাস গ্রামে। তাই ঈদের মতো বড় উৎসবে শহরের মতো গ্রামেও থাকে উৎসবমুখর পরিবেশ। আর এ উৎসব দ্বিগুণ করে দেয় নাড়ির টানে বাড়ি ফেরা শহরমুখী মানুষের। নানা মাধ্যমে দেশের বিভিন্ন শহরে বসবাসরতরা স্বজনদের জন্য অর্থ গ্রামে পাঠাচ্ছেন। প্রবাসীরা পরিবার-পরিজনের জন্য রেমিট্যান্স পাঠাচ্ছেন। সব মিলিয়ে ঈদ ঘিরে গ্রামে বাড়ছে টাকার প্রবাহ। ফিতরা ও জাকাত এই রমজানেও বিতরণ করা হয়। এটি গ্রামের একেবার অসচ্ছল মানুষের হাতেও টাকা যাবে। এ ছাড়া সরকারি-বেসকারি সব পেশাজীবীর বেতনের বাইরে প্রাপ্ত বোনাসের একটি বড় অংশই ব্যয় হবে গ্রামে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাবে দেখা যায়, এবার ঈদের আগে মে মাসে রেকর্ড পরিমাণ রেমিট্যান্স এসেছে। ৪৬ বছরের মধ্যে একক মাসে সর্বোচ্চ ১৪৮ কোটি ডলার রেমিট্যান্স এসেছে। এক বছরের ব্যবধানে রেমিট্যান্স বৃদ্ধির হার সাড়ে ১৭ শতাংশ।
বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিসংখ্যানে দেখা যায়, গত বছরের জুনে দৈনিক গড় লেনদেন সাড়ে ১৮ শতাংশ বেড়ে হাজার কোটি টাকা অতিক্রম করে। পরের মাস জুলাইয়ে এই লেনদেন সাড়ে ২৪ শতাংশ কমে যায়।
সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) গবেষণা পরিচালক ড. খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, ঈদ উপলক্ষে চাকরিজীবী ও শ্রমজীবী সব মানুষই বোনাস পান। এর বড় অংশই গ্রামে যায়। রেমিট্যান্স পাঠানোর পরিমাণও বাড়ছে। ঈদ উপলক্ষে গ্রামীণ কিছু পণ্যের চাহিদা শহরে বাড়ে। এসব পণ্যের সঙ্গে সংশ্লিষ্টদের আয়ও বাড়ে। সব মিলিয়ে বাড়তি অর্থ উৎসব কেন্দ্র করে গ্রামে যাচ্ছে।
তৈরি পোশাকশিল্প মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএর তথ্যমতে, এ শিল্পে ৪০ লাখ শ্রমিক কাজ করেন। এসব শ্রমিকের ৯৫ শতাংশই গ্রাম থেকে আসা। যার ৭০ শতাংশই ঈদের ছুটিতে গ্রামের বাড়ি যায়। তাই যাওয়ার কয়েক মাস আগে থেকেই তারা টাকা জমাতে থাকে ঈদ কেন্দ্র করে। এবার ঈদে শ্রমিকরা জুন মাসের বেতনসহ বোনাস নিয়ে বাড়ি যাবেন। যার সম্পূর্ণ অর্থ ঈদ ঘিরে খরচ হবে।
ঈদের আগের কেনাকাটায় বিকল্পব্যবস্থা ব্যাংকিং লেনদেন যেমন বাড়ে, তেমনি ঈদের আগে-পরে ছুটি থাকায় গ্রামে গিয়েও মানুষ প্রয়োজনীয় টাকা উত্তোলন করেন। এসব টাকার প্রায় পুরোটাই গ্রামে খরচ হয়। গত বছরে ঈদের আগে এটিএম বুথ, পয়েন্ট সেল ও ই-কমার্সে মে মাসে ১১ হাজার ৬০৩ কোটি টাকা লেনদেন হয়। ঈদ উপলক্ষে জুনে তা বেড়ে হয় ১২ হাজার ৯৫২ কোটি টাকা।
অর্থনীতিবিদরা বলছেন, ঈদোৎসব ঘিরে বিভিন্ন খাতে বিপুল অঙ্কের অর্থ হাতবদল হয়, যা অর্থনৈতিক কর্মকা- চাঙ্গা করে তোলে। এর মধ্যে ঈদুল ফিতরে সবচেয়ে বেশি অর্থ ব্যয় হয় নতুন পোশাক ক্রয়ে। মার্কেটগুলোতে ছেলেমেয়েসহ সবার পোশাক বেচাকেনা এই অর্থের অন্যতম উৎস। |