[ শিল্প বাণিজ্য ] 2018-07-12
 
এগার মাসে বাণিজ্য ঘাটতি দেড় লাখ কোটি টাকা
 
আমদানি ব্যয় বাড়লেও সে অনুযায়ী রপ্তানি আয় না বাড়ায় বাণিজ্য ঘাটতি বাড়ছে। ২০১৭-১৮ অর্থবছরের ১১ মাসে (জুলাই-মে) দেশের বাণিজ্য ঘাটতি গত অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় দ্বিগুণ হয়েছে। মে মাস শেষে মোট বাণিজ্য ঘাটতি দাঁড়িয়েছে এক হাজার ৭২২ কোটি ৮০ লাখ ডলার যা বাংলাদেশি মুদ্রায় প্রায় দেড় লাখ কোটি টাকা। যা গত ২০১৬-১৭ অর্থবছরের একই সময়ে ছিল ৯৩৬ কোটি ৩০ লাখ ডলার। সে হিসাবে এক বছরের ব্যবধানে বাণিজ্য ঘাটতি বেড়েছে ৭৮৬ কোটি ৫০ লাখ ডলার। বাংলাদেশ ব্যাংকের হালনাগাদ প্রতিবেদনে এ তথ্য পাওয়া গেছে।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, রপ্তানি আয়ের চেয়ে আমদানি ব্যয় যতটুকু বেশি, তার পার্থক্যই বাণিজ্য ঘাটতি। দেশে পদ্মা সেতু, মেট্রোরেল, রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ কাজ চলছে। এসব বড় প্রকল্পের কাজ শুরু হওয়ায় প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম আমদানি বেড়ে গেছে। এছাড়াও শিল্পের জন্য প্রয়োজনীয় মূলধনীয় যন্ত্রপাতি ও কাঁচামাল আমদানি বেড়েছে। এসব কারণেই বাণিজ্য ঘাটতি বাড়ছে। তবে এ ঘাটতি মেটানো হয় রেমিট্যান্স ও বিদেশি বিনিয়োগ দিয়ে। এ খাতেও নিম্নগতি ছিল বেশকিছু দিন। ফলে বৈদেশিক লেনদেনের চলতি হিসাবের ভারসাম্যে (ব্যালান্স অফ পেমেন্ট বা বিওপি) ঋণাত্মক হয়ে পড়েছে। বাণিজ্য ঘাটতি বেড়ে যাওয়ায় বৈদেশিক মুদ্রা ব্যবস্থাপনায় চাপে পড়েছে। এছাড়া আমদনি বাড়লেই বাজারে ডলারের দাম বেড়ে যায়। ইতোমধ্যে ডলারের তুলনায় টাকা অনেক দুর্বল হয়েছে। যার প্রভাব পড়ে আমদানি ও শিল্প পণ্যের দামে। এতে ভোক্তার ক্রয় ক্ষমতা কমে যাচ্ছে। চাপ সৃষ্টি হচ্ছে মূল্যস্ফীতিতে। এ অবস্থা বিদ্যমান থাকা দেশের সামগ্রিক অর্থনীতির জন্য ভালো বলে মনে করছেন না তারা।

বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান মনসুর বলেন, গত অর্থবছরজুড়েই আমদানি বাড়ছিল। শেষ দিকে এসে আরও বেড়েছে। সব মিলিয়ে এবার আমদানি ব্যয় ৬০ বিলিয়ন ডলারের মতো হবে। আর বাণিজ্য ঘাটতি ২০ বিলিয়ন ডলারের মাইলফলক ছুঁতে পারে। তিনি বলেন, আমদানির যে উল্লম্ফন যেটা মূলত রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্পসহ বড় বড় কয়েকটি প্রকল্পের প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম আমদানির কারণে। এছাড়া চাল, জ্বালানি তেল, ক্যাপিটাল মেশিনারি এবং শিল্পের কাঁচামাল আমদানি বাড়ার কারণেও আমদানি ব্যয় বাড়ছে বলে মনে করেন তিনি।

আমদানি বাড়ায় অর্থনীতিতে কী ধরনের প্রভাব পড়বে- এ প্রশ্নের জবাবে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) সাবেক কর্মকর্তা আহসান মনসুর বলেন, স্বাভাবিকভাবে আমদানি বাড়াকে অর্থনীতিতে ইতিবাচক হিসেবেই দেখা হয়ে থাকে। ক্যাপিটাল মেশিনারি, শিল্পের কাঁচামাল আমদানি বাড়া মানে বিনিয়োগ বাড়া। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, অনেক সময়ই আমরা শুনি যে, এক পণ্য আমদানির নামে অন্য পণ্য আমদানি হচ্ছে।

এক বছরের ব্যবধানে বাণিজ্য ঘাটতি বেড়েছে ৭৮৬ কোটি ৫০ লাখ ডলার। শিল্পের জন্য প্রয়োজনীয় মূলধনীয় যন্ত্রপাতি ও কাঁচামাল আমদানি বাড়ায় বাণিজ্য ঘাটতি বাড়ছে

অনেক সময় শূন্য কন্টেইনারও আসছে। আবার ওভার ইনভয়েসের (আমদানি করা পণ্যের বেশি মূল্য দেখিয়ে) মাধ্যমে অর্থ পাচার করছেন অনেকে। সে কারণেই এই আমদানি বাড়াকে আমি শুধু ইতিবাচক দিক হিসেবে দেখছি না, উদ্বিগ্নও খানিকটা।

বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদন অনুযায়ী, মে মাস শেষে ইপিজেডসহ রপ্তানি খাতে বাংলাদেশ আয় করেছে তিন হাজার ৩২৯ কোটি ৬০ লাখ ডলার। এর বিপরীতে আমদানি বাবদ ব্যয় করেছে পাঁচ হাজার ৫২ কোটি ৪০ লাখ ডলার। এ হিসাবে বাণিজ্য ঘাটতির দাঁড়িয়েছে এক হাজার ৭২২ কোটি ৮০ লাখ ডলার। যা বর্তমান বিনিময় হার (৮৪ টাকা) অনুযায়ী এক লাখ ৪৪ হাজার ৭১৫ কোটি টাকার বেশি। আলোচিত সময়ে, আমদানি বেড়েছে ২৫ দশমিক ৫২ শতাংশ। এর বিপরীতে রপ্তানি বেড়েছে মাত্র ৭ দশমিক ৭৯ শতাংশ। অন্যদিকে রেমিট্যান্স বেড়েছে ১৭ দশমিক ০৯ শতাংশ। ফলে চলতি হিসাবে ঘাটতি বড় হয়েছে।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, চলতি হিসাবে উদ্বৃত্ত থাকার অর্থ হলো নিয়মিত লেনদেনে দেশকে কোন ঋণ করতে হচ্ছে না। আর ঘাটতি থাকলে সরকারকে ঋণ নিয়ে তা পূরণ করতে হয়। সেই হিসাবে উন্নয়নশীল দেশের চলতি হিসাবে উদ্বৃত্ত থাকা ভালো। কিন্তু গত কয়েক বছর উদ্বৃত্তের ধারা অব্যাহত থাকলেও গত অর্থবছরে ঋণাত্মক ধারায় চলে গেছে। এপ্রিলেও এ ধারা অব্যাহত রযেছে।

বিশ্লেষণে দেখা গেছে, ২০১৪-১৫ ও ২০১৫-১৬ অর্থবছরে চলতি হিসাবে উদ্বৃত্ত ছিল। এতে বৈদেশিক দায় পরিশোধে সরকারকে বেগ পেতে হয়নি। কিন্তু ২০১৬-১৭ অর্থবছরের ১৪৮ কোটি ডলার (-) ঋণাত্মক হয়। যা এখনো অব্যাহত রয়েছে। ২০১৭-১৮ অর্থবছরের মে মাস শেষে ৯৩৭ কোটি ৯০ লাখ ডলার ঋণাত্মক হয়েছে। এর আগের অর্থবছরে একই সময়ে ঋণাত্মক ছিল ২২১ কোটি ৬০ লাখ ডলার। আলোচিত সময়ে সেবাখাতে বেতনভাতা বাবদ বিদেশিদের পরিশোধ করা হয়েছে ৮২০ কোটি ডলার। আর বাংলাদেশ এ খাতে আয় করেছে মাত্র ৪১১ কোটি ৯০ লাখ ডলার। এ হিসাবে ১১ মাসে সেবায় বাণিজ্যে ঘাটতি দাঁড়িয়েছে ৪০৮ কোটি ডলারে। যা গত ২০১৬-১৭ অর্থবছরের একই সময়ে ছিল (ঘাটতি) ৩০০ কোটি ডলার।

প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৭-১৮ অর্থবছরের জুলাই-মে সময়ে মধ্য ও দীর্ঘ মেয়াদে বিদেশি ঋণ গ্রহণ বেড়েছে। আলোচ্য সময়ে আর্থিক হিসাবে দেখা যাচ্ছে, এ ধরনের ঋণ এসেছে ৩৪৮ কোটি ডলার, যা আগের একই সময়ের তুলনায় ৮২ দশমিক ৬৬ শতাংশ বেশি। বিদেশি ঋণ বাড়লেও বিদেশি বিনিয়োগ কম এসেছে। এ সময় ১৬০ কোটি ডলারের নিট বিনিয়োগ এসেছে, যা গত অর্থবছরের একই সময়ের চেয়ে ৪ দশমিক ১৮ শতাংশ কম। অন্যদিকে শেয়ারবাজারে বিদেশি বিনিয়োগ কিছুটা বেড়েছে। জুলাই থেকে মে সময়কালে শেয়ারবাজারে ৩৫ কোটি ৮০ লাখ ডলারের বিদেশি বিনিয়োগ এসেছে। গত অর্থবছরের একই সময়ে যা ছিল ৩২ কোটি ৪০ লাখ ডলার। আর সরাসরি বিদেশি বিনিয়োগ (এফডিআই) দেশে এসেছে মোট ২৬০ কোটি ৭০ লাখ ডলার। যা গত অর্থবছরের একই সময়ের চেয়ে ৭ দশমিক ৩৬ শতাংশ কম। গত অর্থবছরের একই সময়ে এফডিআই ছিল ২৮১ কোটি ৪০ লাখ ডলার।

শেয়ারবাজারে বিদেশি বিনিয়োগও সামান্য বেড়েছে। চলতি অর্থবছরের আলোচিত মাসে নিট পোর্টফোলিও বিনিয়োগ হয়েছে ৩৫ কোটি ৫০ লাখ ডলার। গত অর্থবছরের একই সময়ে ছিল ৩৪ কোটি ৫০ লাখ ডলার।
Print Close  
Print Close  
News Source
            Top
            Top
 
Home / About Us / Benifits /Invite a Friend / Policy
Copyright © Hawker 2009-2010, Allright Reserved