[ প্রথম পাতা ] 2019-01-19
 
দক্ষ জনশক্তির অভাব
উন্নয়নের সঙ্গে তাল মিলিয়ে তথ্যপ্রযুক্তিসহ সব খাতেই দক্ষ কর্মী সংকট, অনেক ব্যবসা প্রতিষ্ঠান বিদেশ থেকে কর্মী আনছে, বিদেশেও রয়েছে বিপুল চাহিদা
 
জুলকার নাইন

বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে দেশের বিভিন্ন খাতের উন্নয়ন হচ্ছে। তৈরি হচ্ছে পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র থেকে নদীর নিচের টানেল। কিন্তু সাধারণ ব্যবসা প্রতিষ্ঠান বা অন্যান্য প্রতিষ্ঠান পরিচালনার ক্ষেত্রেই দক্ষ কর্মী সংকটে ভুগছে দেশ। দিন দিন এ সংকট বাড়ছে। যেন উন্নয়নের সঙ্গে তাল মিলিয়ে দক্ষ কর্মী সংকট আরও তীব্র হচ্ছে। সংকট মোকাবিলায় অনেক ব্যবসা প্রতিষ্ঠানই দেশের বাইরে থেকে কর্মী আনছে। শুধু দেশেই চাহিদা তা নয়, কর্মীদের দক্ষতার অভাব থাকায় বিদেশে বাংলাদেশের জনশক্তির বাজারও সঙ্কুচিত হচ্ছে। সৌদি আরবের মতো বড় শ্রমবাজার এখন আর অদক্ষ কর্মী নিতে আগ্রহী নয়, তারা চায় দক্ষ কর্মী। দক্ষ শ্রমশক্তির এ সংকট শুধু প্রতিষ্ঠান চালানোর প্রতিবন্ধকতাই তৈরি করছে না, বাংলাদেশের দ্রুত প্রবৃদ্ধি অর্জনেও বাধার সৃষ্টি করছে।

প্রতিবন্ধকতা তৈরি হচ্ছে মধ্যম আয়ের দেশ হওয়ার ক্ষেত্রেও। বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) বিভিন্ন গবেষণায় উঠে এসেছে, ২০২৫ সালে সব খাত মিলিয়ে মোট ৭ কোটি ২০ লাখ প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত দক্ষ শ্রমশক্তি প্রয়োজন হবে। তৈরি পোশাক, নির্মাণ, চামড়াজাত, কৃষি প্রক্রিয়াজাত- এ রকম নয়টি খাতে আগামী তিন বছরের মধ্যে, অর্থাৎ ২০২০-২১ অর্থবছরে ৬৫ লাখ দক্ষ শ্রমশক্তি দরকার হবে। ‘বাংলাদেশে শ্রমবাজার এবং দক্ষ মানব সম্পদের ঘাটতি’ শীর্ষক গবেষণা প্রতিবেদন অনুসারে, মোট দেশজ উৎপাদনে (জিডিপি) ৯ খাতের মধ্যে তৈরি পোশাক খাতের অবদান সবচেয়ে বেশি, ১১ দশমিক ৩ শতাংশ। ৭ দশমিক ৭ শতাংশ নিয়ে দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে নির্মাণ খাত। কর্মসংস্থান তৈরিতেও এ দুই খাতের অবদান ভালো। তবে খাদ দুটিসহ কৃষি ও খাদ্য প্রক্রিয়াজাত, পর্যটন, হালকা প্রকৌশল, চামড়াজাত পণ্য, স্বাস্থ্যসেবা, জাহাজ নির্মাণ এবং তথ্যপ্রযুক্তিতে (আইসিটি) দক্ষ শ্রমশক্তির বড় অভাব। প্রতিবেদনে বলা হয়, দক্ষ এমনকি আধা দক্ষ শ্রমশক্তির বেশি অভাব পোশাক খাতে। তৈরি পোশাক খাতে ২০১৫-১৬ অর্থবছরে দক্ষ ২২ লাখ ৫৮ হাজার, আধা দক্ষ ১২ লাখ ৩০ হাজার এবং অদক্ষ কর্মীর চাহিদা ছিল ৬ লাখ ১৮ হাজার। ২০২৫-২৬ অর্থবছরে এই খাতের জন্য ৫০ লাখ ২৭ হাজার দক্ষ লোকের দরকার পড়বে। এ ছাড়া নির্মাণ খাতে ২০১৫-১৬ অর্থবছরে দক্ষ ১০ লাখ ১০ হাজার, আধা দক্ষ ১২ লাখ ৬০ হাজার এবং অদক্ষ ৯ লাখ ১০ হাজার জনের চাহিদা ছিল। ২০২৫-২৬ অর্থবছরে এ খাতের জন্য দক্ষ ১৫ লাখ ৪০ হাজার, আধা দক্ষ ১৯ লাখ ২০ হাজার এবং অদক্ষ ১৩ লাখ ৯০ হাজার জনের দরকার পড়বে। এভাবে মোট নয়টি খাতের ১০ বছরের একটি সম্ভাব্য চিত্র তুলে ধরা হয় বিআইডিএসের প্রতিবেদনে। পোশাক খাতের যেসব বড় কারখানায় জরিপ করা হয়েছে, সেগুলোর ৭০ শতাংশ নিজেদের মতো করে শ্রমিকদের মৌলিক ও অগ্নিনিরাপত্তা বিষয়ে প্রশিক্ষণ দিচ্ছে। তবে আগামী ২০২১ সালের মধ্যে এ খাতের ১৫ লাখ লোকের প্রশিক্ষণ দরকার। কৃষি প্রক্রিয়াজাত কিছু কারখানাও নিজেদের মতো করে কর্মীদের প্রশিক্ষণ দেয়। তবে বেশির ভাগকেই নির্ভর করতে হয় অপর্যাপ্ত সরকারি প্রশিক্ষণ সুবিধার ওপর। দরকার এখন উচ্চপর্যায়ের আনুষ্ঠানিক প্রশিক্ষণের। নির্মাণ খাতে প্রশিক্ষণ হচ্ছে, তবে প্রশিক্ষণ সক্ষমতা যদি প্রতিবছর ১০ শতাংশ করেও বাড়ে, আগামী ১০ বছর পরও পরিস্থিতি একই জায়গায় থাকবে। স্বাস্থ্যসেবা খাতের মধ্যে ডাক্তারের সংখ্যা ভালো থাকলেও অভাব রয়েছে সেবিকার (নার্স)। তবে সব মিলিয়ে এ খাতে ২০২০-২১ অর্থবছরে অন্তত ৪১ হাজার লোকের প্রশিক্ষণের দরকার হবে। পর্যটন খাতে বড় সমস্যা হচ্ছে বাস্তব প্রশিক্ষণের অভাব এবং আইটি ও ইংরেজি ভাষায় দক্ষতার ঘাটতি। ২০২০-২১ অর্থবছরে এ খাতে প্রশিক্ষণ দরকার ১ লাখ ৪৪ হাজার লোকের। শিল্প খাত বড় সমস্যায় ভোগে মধ্যম সারির ব্যবস্থাপকদের আইসিটি জ্ঞানের অভাব নিয়ে এবং এতে শিল্পের প্রত্যাশিত প্রবৃদ্ধি হয় না। প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০২০-২১ অর্থবছরে এ খাতে ১ লাখ লোকের প্রশিক্ষণের দরকার পড়লেও ২০২৫-২৬ অর্থবছরে প্রশিক্ষণের দরকার পড়বে ১০ লাখ ৫৯ হাজার লোকের। চামড়াজাত পণ্যের ক্ষেত্রে প্রশিক্ষণের অবস্থা খুবই খারাপ।

তিন বছর পরই এ খাতে প্রশিক্ষণের দরকার পড়বে ১ লাখ ৮ হাজার এবং তার পাঁচ বছর পর দরকার পড়বে ১ লাখ ৫০ হাজার লোকের। অথচ এর অতি সামান্য এখন হচ্ছে। জানা যায়, দক্ষ বাংলাদেশি কর্মীর অভাব থাকায় মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানিগুলোর বাইরে দেশীয় বিভিন্ন কোম্পানি এখন বিদেশিদের দিকে ঝুঁকছে। বাংলাদেশে গার্মেন্ট কম্পোজিট টেক্সটাইল মিল, ওভেন ও নিটওয়্যার ইন্ডাস্ট্রি, সোয়েটার ফ্যাক্টরি, বায়িং হাউস, মার্চেন্ডাইজিং, বেসরকারি বিদ্যুৎ কেন্দ্র, আন্তর্জাতিক ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান, ফ্যাশন হাউস, খাদ্য উৎপাদন ও বিপণনকারী কোম্পানি, মোবাইল ফোন কোম্পানি, এয়ারলাইনস, ফার্নিচার কোম্পানি, পোলট্রি খাদ্য উৎপাদক প্রতিষ্ঠান, চামড়াজাত প্রতিষ্ঠান, বহুজাতিক তেল-গ্যাস কোম্পানি, মিডিয়া রিসার্চ প্রতিষ্ঠান ও বিজ্ঞাপনী সংস্থাসহ বিভিন্ন মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানিতে প্রায় ১০ লাখ বিদেশি কাজ করছেন। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি নাগরিক ভারতীয়। এর পরই রয়েছে শ্রীলঙ্কা, চীন, কোরিয়া, পাকিস্তান, থাইল্যান্ড, ফিলিপাইনসহ আফ্রিকা, ইউরোপ-আমেরিকার বিভিন্ন দেশের নাগরিক। কোম্পানিতে পাঁচ বাংলাদেশি কর্মকর্তার মোট বেতনের চেয়েও বেশি বেতন ও সুযোগ-সুবিধা পেয়ে থাকেন একেকজন বিদেশি কর্মকর্তা। বাংলাদেশ এমপ্লয়ার্স অ্যাসোসিয়েশনের সাবেক প্রেসিডেন্ট ব্যবসাযী নেতা ফজলুল হক বলছেন, দেশে মিড লেভেল ও টপ লেভেলের প্রফেশনালদের বড ধরনের ঘাটতি রয়েছে। প্রচলিত শিক্ষা ব্যবস্থায় শিক্ষিত হয়ে আসা কর্মীরা চাহিদা মেটাতে পারছে না। ফলে বাধ্য হয়ে বিদেশ থেকে এসব কর্মী আমদানি করতে হচ্ছে। তিনি বলেন, কর্মীদের পেশাগত দক্ষতার অভাবের পাশাপাশি ভাষাগত দক্ষতারও অভাব রয়েছে। বিশেষ করে ইংরেজি ভাষার দক্ষতা এবং পেশাগত কৌশলের ঘাটতি রয়েছে। কারিগরি শিক্ষার অভাবটাই প্রকট। আমাদের এখানে ইউনিভার্সিটিগুলোতে যে ডিগ্রি দেওয়া হচ্ছে সেগুলো বেশিরভাগই আমাদের ইন্ডাস্ট্রিকে ফোকাস করে দেওয়া হচ্ছে না। তাদের ফোকাসটা অন্য জায়গায়। ফলে যেরকম গ্রাজুয়েটের দরকার সেরকম আমরা পাচ্ছি না। বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) গবেষক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম হোসেনের মতে, একদিকে দেশের ভিতরে বেকার এবং শিক্ষিত বেকারের সংখ্যা যেখানে প্রকট সেখানে দেশ থেকে অর্থ চলে যেতে দেখতে হচ্ছে। তবে দেশের ভিতরে যারা গ্রাজুয়েট হচ্ছেন, তারাও উপযুক্ত মানসম্পন্ন নন। তাদের দক্ষতার অভাব রয়েছে। তিনি বলেন, আমরা একদিকে গ্রাজুয়েশন শেষ করাদের এক-তৃতীয়াংশকে বেকার দেখতে পাচ্ছি, অন্যদিকে দেশের ভিতরেই বিদেশিদের কাজ করতে দেখছি এবং তারা দেশ থেকে অর্থ নিয়ে যাচ্ছেন। একদিকে এমপ্লয়াররা প্রফেশনাল লোক খুঁজছেন, দেশের ভিতরে পাচ্ছেন না। অন্যদিকে বিদেশি প্রফেশনালরা আমাদের এখানে কাজ করছেন, আমাদের জায়গাগুলো তাদের দিয়ে দিতে হচ্ছে, এটা খুবই দুর্ভাগ্যজনক।
Print Close  
Print Close  
News Source
            Top
            Top
 
Home / About Us / Benifits /Invite a Friend / Policy
Copyright © Hawker 2009-2010, Allright Reserved