রাজস্ব আয় বাড়ানো ও সমাজে বৈষম্য কমাতে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) আগামী অর্থবছরের বাজেটে উত্তরাধিকার কর চালুর কথা ভাবছে বলে জানিয়েছেন সংস্থাটির চেয়ারম্যান মোশাররফ হোসেন ভূঁইয়া। করের আওতা বাড়াতে দেশের জেলা-উপজেলা পর্যায়ে অফিস স্থাপন এবং নির্বাচনের প্রার্থীদের রিটার্ন দাখিল বাধ্যতামূলক করার চেষ্টা চলছে বলেও জানিয়েছেন তিনি।
গতকাল বৃহস্পতিবার 'কেমন চাই জাতীয় বাজেট ২০১৯-২০' শীর্ষক এক গোলটেবিল বৈঠকের প্রধান অতিথির বক্তব্যে এনবিআর চেয়ারম্যান এসব পরিকল্পনার কথা জানান। দি ইনস্টিটিউট অব চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্টস অব বাংলাদেশ (আইসিএবি) ও দৈনিক প্রথম আলো যৌথভাবে রাজধানীর কারওয়ান বাজারের সিএ ভবনে এ বৈঠকের আয়োজন করে। অনুষ্ঠানটি সঞ্চালনা করেন আইসিএবির প্রেসিডেন্ট এএফ নেসারউদ্দিন।
উত্তরাধিকার কর হচ্ছে পিতামাতা বা অন্য কারোর থেকে উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া সম্পদের ওপর কর। যুক্তরাজ্য, কানাডা, অস্ট্রেলিয়াসহ বিভিন্ন দেশে এ ধরনের কর চালু রয়েছে। বাংলাদেশে উত্তরাধিকার সূত্রে সম্পদ প্রাপ্তিতে কোনো কর দিতে হয় না।
মোশাররফ হোসেন ভূঁইয়া বলেন, জনবলের ঘাটতির কারণে করের আওতা প্রত্যাশিতভাবে বাড়ানো সম্ভব হচ্ছে না। জনবল নিয়োগের একটি প্রস্তাব তৈরি করে তা অনুমোদনের জন্য জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হচ্ছে। প্রস্তাবটি অনুমোদন হলে এনবিআর জেলা-উপজেলা পর্যায়ে অফিস খুলবে। তিনি বলেন, রাজস্ব আহরণে বিভিন্ন খাতকে সুযোগ দেওয়াও এক ধরনের বাধা। বিদ্যুৎ উৎপাদন বাড়ানোর জন্য যে পরিমাণ কর ছাড় দিতে হয়েছে, তা ব্যাপক। এলএনজি আমদানিতে ভোক্তা পর্যায়ে ভ্যাট ছাড়া সব ধরনের করে ছাড় দেওয়া হয়েছে। এখন বিভিন্ন খাত থেকে করপোরেট কর কমিয়ে করের আওতা বাড়ানোর পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে। যা-ই করা হোক, মোট রাজস্ব আয় কমানো যাবে না। গতবার করপোরেট কর ২ দশমিক ৫ শতাংশ কমানো হয়েছে। তার সুফল একটি নির্দিষ্ট গোষ্ঠী পেয়েছে। সামগ্রিক অর্থনীতি তার কোনো সুফল পায়নি।
তিনি অডিট ফার্মগুলোকে সততার সঙ্গে কাজ করার আহ্বান জানিয়ে বলেন, সুবিধা নিতে চাইলেও কর দেওয়ার বিষয়ে আগ্রহী নয় কেউ। অডিট ফার্মগুলো বহুজাতিক কোম্পানির অডিট যেভাবে করে, দেশি কোম্পানির অডিট সেভাবে হয় না। কোনো অডিট ফার্ম ঠিকমতো সব হিসাব চাইলে কোম্পানি সেই ফার্মকে দিয়ে অডিট করাচ্ছে না। এক্ষেত্রে আইসিএবিকে দায়িত্ব নিতে হবে। কারণ অধিকাংশ কোম্পানির প্রকৃত অডিট রিপোর্ট এনবিআরের কাছে আসে না। এ কারণে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত কোম্পানির কর হার কম হলেও অধিকাংশ কোম্পানি তালিকাভুক্ত হতে চায় না। তিনি বলেন, তৈরি পোশাক খাতের রফতানি আয়ে উৎসে কর কমিয়ে দেওয়া হয়েছে। ধারণা করা হয়েছিল, রফতানিকারকদের করপোরেট কর থেকে রাজস্ব আহরণ বাড়বে। কিন্তু অধিকাংশ কোম্পানি দেখাচ্ছে যে, তাদের করযোগ্য আয়ই হয়নি। তিনি বলেন, এখন অনেকে সম্পদ কর আরোপের পরামর্শ দিচ্ছেন। সেটা করলে দেখা যাবে সম্পদই প্রদর্শন করছে না। তিনি বলেন, গত বছরের বাজেটের সময় এনবিআরের পক্ষ থেকে যে কোনো নির্বাচনের প্রার্থীদের মনোনয়নপত্রের সঙ্গে রিটার্ন দাখিলের কপি দেওয়া বাধ্যতামূলক করার প্রস্তাব করা হয়েছিল। সেটা করা সম্ভব হয়নি। যারা নির্বাচনে অংশ নেন, তাদের অনেকের ট্যাক্স ফাইল নেই। কিন্তু নির্বাচনের খরচ তো সবাই দেখছে। এসব ব্যক্তিকে করের আওতায় আনতে হবে। এনবিআরের কর্মকর্তাদের দুর্নীতি প্রসঙ্গে বলেন, আগেও এনবিআরে দুর্নীতি হতো, এখনও হচ্ছে। কখনও কখনও সামান্য কমে বা বাড়ে। স্বয়ংক্রিয় ব্যবস্থাসহ সরকারি বিভিন্ন উদ্যোগের ফলে দুর্নীতি ধাপে ধাপে কমে আসছে।
সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা রাশেদা কে চৌধুরী বলেন, শিক্ষায় বিনিয়োগ বাড়লে দক্ষ মানবসম্পদ পাওয়া যাবে। বিএসইসির সাবেক চেয়ারম্যান ফারুক আহমেদ সিদ্দিকী বলেন, পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত কোম্পানির কর কমানোর দরকার নেই। বরং অন্য কোম্পানিগুলো বেশি কর হওয়া সত্ত্বেও কেন পুঁজিবাজারে আসছে না, তা দেখতে হবে। সিপিডির নির্বাহী পরিচালক ফাহমিদ খাতুন করবহির্ভূত আয় সীমা বাড়ানো, ই-টিআইএনধারীদের রিটার্ন দাখিলে উদ্বুদ্ধ করা ও সম্পদ কর আরোপের প্রস্তাব করেন। অনুষ্ঠানে স্বাগত বক্তব্য দেন প্রথম আলোর সহযোগী সম্পাদক আব্দুল কাইয়ুম।