মুক্তিযুদ্ধকালীন বাংলাদেশের প্রথম সরকার গঠনের স্মৃতিবিজড়িত স্থান মেহেরপুরের বৈদ্যনাথতলা (বর্তমান মুজিবনগর)। ৮০ একর জমি অধিগ্রহণ করে প্রায় তিনশ কোটি টাকা ব্যয়ে বৈদ্যনাথতলায় নির্মাণ করা হচ্ছে মুক্তিযুদ্ধ স্মৃতিকেন্দ্র। নতুন করে আরো এক হাজার কোটি টাকা বরাদ্দের প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে। মুজিবনগরকে আন্তর্জাতিক মানের মুক্তিযুদ্ধ পর্যটন কেন্দ্র গড়ে তোলার জন্য যা যা করণীয় সবই করবে বর্তমান সরকার। প্রধানমন্ত্রীর বরাত দিয়ে এমন কথা জানিয়েছেন মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক। সম্প্রতি মুজিবনগরে পরিদর্শনে গিয়ে তিনি এ তথ্য দেন।
জনপ্রশাসন প্রতিমন্ত্রী, মেহেরপুর-১ (সদর ও মুজিবনগর) আসনের সংসদ সদস্য ফরহাদ হোসেন ইত্তেফাককে বলেন, মুজিবনগরকে আন্তর্জাতিক মানের মুক্তিযুদ্ধ পর্যটন কেন্দ্র হিসেবে গড়ে তুলতে প্রধানমন্ত্রী এক হাজার কোটি টাকা বরাদ্দের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। সে অনুযায়ী প্রকল্প ডিজাইন সম্পন্ন হয়েছে। ইতোমধ্যে প্রকল্পটি পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে। এটি একনেকের বৈঠকে পাস হলে কাজ শুরু হবে। তিনি আরো জানান, প্রধানমন্ত্রী ঘোষণা রয়েছে প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করতে আরো বেশি টাকা লাগলে তাও দেওয়া হবে।
এদিকে প্রতিবছর ১৭ এপ্রিলকে ঘিরে বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের অধীনে প্রায় অর্ধকোটি টাকা খরচ করে সংস্কার কাজ করা হয়। অথচ সমন্বয়ের অভাবে রক্ষণাবেক্ষণের জন্য কোনো উদ্যোগ এখনো গ্রহণ করা হয়নি। বেশ কিছু স্থাপনায় ইতিহাস বিকৃত হয়েছে। পুরনো প্রকল্পের মধ্যে ৪৭ কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত মুক্তিযুদ্ধে সেক্টর ভিত্তিক বাংলাদেশ মানচিত্র নির্মাণকাজ শেষ হয়ে আট বছর পেরিয়ে গেলেও এখনো উদ্বোধন করা হয়নি। মানচিত্রে পুরো বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকালীন চিত্র ফুটে উঠলেও মুজিবনগরের শপথ নেওয়ার কোনো চিত্র সেখানে স্থান পায়নি। মানচিত্রের বাইরে নির্মিত বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণের ভাস্কর্যসহ অন্য ভাস্কর্যগুলো অতি নিম্নমানের সামগ্রী দিয়ে তৈরি এবং মূল নকশা অনুযায়ী না হওয়ায় সেগুলো ভেঙে ফেলে নতুন করে তৈরি করার জন্য আরো তিন কোটি টাকার প্রকল্প পাস করা হয়েছে।
বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণের ভাস্কর্যসহ অন্য ভাস্কর্যগুলো মাঝে মধ্যেই ভেঙে পড়ে। অনেকগুলোর ভেতরে রডের বদলে চিকন তার দেওয়ার অভিযোগ পাওয়া গেছে। ফলে শিলাবৃষ্টি বা ঝড় হলে সেগুলো ভেঙে যায়। কয়েকদফা সেগুলো সংস্কারও করা হয়েছে। এ ছাড়া প্রতিবছর ঐতিহাসিক মুজিবনগর দিবসকে ঘিরে সংস্কারসহ দৃষ্টিনন্দন করে তোলা হয়। তবে মানচিত্রসহ বেশকিছু প্রকল্পের কাজ ২০১১ সালে শেষ হলেও এখন পর্যন্ত সেগুলো উদ্বোধন করা হয়নি। উদ্বোধনের আগেই সেগুলো নষ্ট হয়ে পড়েছে। মেহেরপুরের স্থানীয় ১২ আনসার সদস্য বাংলাদেশের প্রথম সরকারের নেতৃবৃন্দকে গার্ড অব অনার প্রদান করেন। কিন্তু আটজন আনসার সদস্য দেখিয়ে করা হয়েছে ভাস্কর্য।
২৫ মার্চের হত্যাযজ্ঞ, সিলেটের তেলিয়াপাড়ায় ১১ জন সেক্টর কমান্ডারদের গোপন বৈঠক, পাক বাহিনীর আত্মসর্মপণসহ অন্য ভাস্কর্যগুলো বিবর্ণ হয়ে পড়েছে। শহীদ মিনারে হামলার যে চিত্র কক্ষতে তৈরি করা হয়েছে তার সবগুলো দেয়ালেই ফাটল ধরেছে। কমেপ্লক্সে ছাড়াও ঐতিহাসিক আম্রকাননের গাছ পরিচর্যার অভাবে মারা গেছে। ওই স্থলে নতুন কোনো গাছ রোপণও করা হয়নি। বাগানটি ঘুরে দেখা গেছে প্রায় ৩০ থেকে ৩৫টি গাছ মরে গেছে।
আন্তর্জাতিক মানের করে ১৭ এপ্রিল ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের প্রথম সরকারের শপথ গ্রহণের স্থান, ঐতিহাসিক ঘটনা প্রবাহের স্মৃতি, মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ ও চেতনাসমৃদ্ধ তথ্য ও নিদর্শন দেশবাসী ও তথা ভবিষ্যত্ প্রজন্ম এবং বিদেশিদের কাছে মূর্ত করে তুলতেই এক হাজার কোটি টাকার প্রকল্প। যার মধ্যে সারা দেশের মুক্তিযুদ্ধের চিত্র, একটি দৃষ্টিনন্দন লেক, বঙ্গবন্ধুর ম্যুরাল এবং নতুন প্রজন্মকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় সমৃদ্ধ করতে শপথের স্থান করা হবে। নতুন করে ১৭ ফুট উচ্চতার ৭ মার্চের বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্যসহ বেশকিছু ভাস্কর্য অ্যাক্রোলিক ফাইবার দিয়ে নির্মাণের জন্য প্রস্তাব করা হয়।
মেহেরপুরের জেলা প্রশাসক মো. আতাউল গনি বলেন, ঐতিহাসিক মুজিবনগর দিবস পালনে সকল প্রস্তুতি সম্পন্ন হয়েছে। প্রকল্প ভিত্তিক সংস্কার কাজ স্ব স্ব বিভাগের দায়িত্বে থেকে করা হয়েছে। নতুন করে এক হাজার কোটি টাকার প্রকল্পটি চূড়ান্তের পথে রয়েছে। মেহেরপুর গণপূর্ত বিভাগের উপ-বিভাগীয় প্রকৌশলী শফিকুল ইসলাম জানান, এবার ১৭ এপ্রিলকে ঘিরে প্রায় ৪০ লাখ টাকা ব্যয়ে বিভিন্ন ভাস্কর্য সংস্কার করা হয়েছে। মেহেরপুর জেলা ছাত্রলীগের সভাপতি আব্দুস সালাম বাঁধন বলেন, শুধু মুজিবনগর উপজেলায় এই দিনটি সাধারণ ছুটি ঘোষণা করা হয়েছে। আমাদের দাবি এ দিবসটিকে যথাযথ গুরুত্ব দিয়ে সারা দেশে সরকারি ছুটি ঘোষণা করা হোক।