[ পাতা ৪ ] 2020-08-11 |
|
|
|
|
রপ্তানিতে স্বস্তি বজায় থাকবে?
|
|
|
জাকির হোসেন:
আগস্টের শুরুতেই দুটি পরিসংখ্যান করোনাকালেও অর্থনীতিতে কিছুটা স্বস্তি এনে দিয়েছে। প্রথমটি হলো- ব্যাংকিং চ্যানেলে প্রবাসী বাংলাদেশিদের পাঠানো বৈদেশিক মুদ্রা বা রেমিট্যান্স। জুলাই মাসে রেমিট্যান্স এসেছে ২৬০ কোটি ডলার। এর আগে কখনও একক মাসে ২০০ কোটি ডলার রেমিট্যান্স আসেনি। এর পরপরই পাওয়া যায় জুলাই মাসের পণ্য রপ্তানি আয়ের পরিসংখ্যান, যার পরিমাণ ৩৯১ কোটি ডলার। দেশের মুদ্রায় অন্তত ৩৩ হাজার কোটি টাকা। একক মাস হিসেবে গত ১৩ মাসের মধ্যে যা সর্বাধিক।
জুলাই মাসে প্রবৃদ্ধি হয়েছে বলেই কি আমরা ধরে নেব, নিকট ও মধ্য মেয়াদে কোনো অনিশ্চয়তা বা ঝুঁকি নেই? অবশ্যই আছে। আমরা যদি একটু পেছনে তাকাই তাহলে দেখতে পাই, করোনা সংক্রমণের আগেও রপ্তানি আয়ে স্বাভাবিক গতি ছিল না। গত অর্থবছরের ১২ মাসের মধ্যে ১০ মাসেই আগের অর্থবছরের একই সময়ের চেয়ে রপ্তানি আয় কমেছে। করোনার আগে রপ্তানি কমে যাবার মূল কারণ ছিল, যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের মধ্যে বাণিজ্যযুদ্ধ নিয়ে বিশ্ববাণিজ্যে অনিশ্চয়তা। বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থা সম্প্রতি ওয়ার্ল্ড ট্রেড স্ট্যাটিস্টিক্যাল রিভিউ-২০২০ নামে যে রিপোর্ট প্রকাশ করেছে, তাতে বলা হয়েছে ২০১৯ সালে বিশ্বে তৈরি পোশাকের বাণিজ্য হয়েছে ৪৯ হাজার ২০০ কোটি ডলারের। আগের বছরের চেয়ে শূন্য দশমিক ৪ শতাংশ কম। এই পরিসংখানের সঙ্গে করোনার সম্পর্ক নেই। বলে রাখা ভালো, তৈরি পোশাক রপ্তানিতে বাংলাদেশ দ্বিতীয় অবস্থান ধরে রেখেছে এবং ভিয়েতনাম বাংলাদেশের ঘাড়ে নিঃশ্বাস ফেলছে। ভিয়েতনাম কিছুদিনের মধ্যেই ইউরোপীয় ইউনিয়নে মুক্ত বাণিজ্য চুক্তির (এফটিএ) আওতায় পণ্য রপ্তানি শুরু করবে। ফলে করোনা সংক্রমণ কমে যাওয়া মানেই রপ্তানি অনেক বেড়ে যাবে এমন নিশ্চয়তা নেই।
এবার করোনার প্রভাব প্রসঙ্গে আসি। বিশ্বব্যাপী করোনাভাইরাসের সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়লে গত মার্চ থেকে তৈরি পোশাকের ক্রেতারা প্রচুর রপ্তানি আদেশ বাতিল বা স্থগিত করতে থাকেন। পোশাক রপ্তানিকারকদের সংগঠন বিজিএমইএর হিসাবে ক্রেতারা মোট ৩১৮ কোটি ডলার মূল্যের রপ্তানি আদেশ বাতিল বা স্থগিত করেন। এপ্রিল মাসে মাত্র ৫২ কোটি ডলারের রপ্তানি হয়, যার মধ্যে তৈরি পোশাক ছিল ৩৭ কোটি ডলারের। মে মাসে রপ্তানি আয় ১৭৩ কোটি ডলারে উন্নীত হয় এবং জুনে তা ২৭১ কোটি ডলারে দাঁড়ায়। জুলাইতে এসে জুনের তুলনায় ১২০ কোটি ডলার বা ৪৪ শতাংশ বেড়েছে। আর গত বছরের জুলাইয়ের চেয়ে বেড়েছে ১ শতাংশেরও কম।
এই ঘুরে দাঁড়ানোর পেছনে কী কী কারণ কাজ করতে পারে? প্রথমত, বাতিল বা স্থগিত রপ্তানি আদেশের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ পুনর্বহাল হয়েছে। পুনর্বহালের পুরোটা এমনি এমনি হয়নি। শ্রমিকদের জীবিকার বিষয়টি মানবিক বিবেচনায় উপস্থাপন করে বিজিএমইএ নেতৃত্বের আহ্বানের পাশাপাশি আন্তর্জাতিক পর্যায়ে যারা শ্রমিকদের জন্য কাজ করে (যেমন- আইএলও) তাদের এবং সংবাদমাধ্যমের ভূমিকা ছিল। সব মিলিয়ে ক্রেতারা একধরনের চাপ অনুভব করেছে। তবে অনেক ক্ষেত্রে রপ্তানিকারকদের দামে ছাড় দিতে হয়েছে। টিকে থাকার জন্য নতুন অর্ডারের জন্যও তারা তেমন দরকষাকষি করতে পারছেন না। যাই হোক, পুনর্বহালের পাশাপাশি নতুন অর্ডারও পাওয়া যাচ্ছে। দ্বিতীয়ত, কভিড-১৯ এর কারণে মাস্ক, পিপিই এবং মেডিকেল টেক্সটাইলের চাহিদা বেড়েছে এবং এই বর্ধিত বাজারে বাংলাদেশের রপ্তানিকারকরা ঢুকতে পেরেছেন। কিছু উদ্যোক্তা করোনা সুরক্ষা সামগ্রী উৎপাদনে নতুন বিনিয়োগ করেছেন। তৃতীয়ত, পোশাক কারখানার শ্রমিকদের বেতন দিতে স্বল্প সুদের ঋণ জোগানে সরকার গঠিত পাঁচ হাজার কোটি টাকার প্রণোদনা তহবিলের কারণে অনেক কারখানা সচল রাখা সম্ভব হয়েছে। আরও কিছু কারণ রয়েছে। যেমন- করোনা সংক্রমণ কমে আসায় বিশ্বব্যাপী অবদমিত চাহিদার কিছুটা পুনরুদ্ধার হয়েছে। অনেক জায়গায় রিটেইল স্টোর সীমিত পরিসরে কিংবা পুরোপুরি খুলেছে। অনলাইনে বিক্রি ব্যাপক বেড়েছে।
এখন বড় প্রশ্ন হলো- জুলাইতে রপ্তানি আয় যে ঘুরে দাঁড়িয়েছে, তা কি আগামীতে বহাল থাকবে? অবস্থা পর্যালোচনায় মনে হচ্ছে, দ্বিতীয় দফায় করোনার আঘাত না এলে এবং এর টিকা আবিস্কার ও প্রয়োগের ক্ষেত্রে অগ্রগতির ওপর অনেক কিছুই নির্ভর করছে। পোশাক খাতের বড় রপ্তানিকারকদের কেউ কেউ বলছেন, তারা উৎপাদন ক্ষমতার ৬০ থেকে ৭০ শতাংশ ব্যবহার করছেন, যা দুই-তিন মাস আগে ৩০ শতাংশের মতো ছিল। সুতরাং, পরিস্থিতির যে উন্নতি হয়েছে বা হচ্ছে, তা বলা যায়। তবে আত্মতুষ্টির খুব বেশি কারণ নেই। কারণ, আন্তর্জাতিক অনেক পরিস্থিতির ওপর আমাদের কোনো হাত নেই। তবে কৌশলী হলে এবং যথাযথ প্রস্তুতি নিলে অনেক সময় মন্দা পরিস্থিতির মধ্যেও টিকে থাকা যায়। আশির দশকে বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক মন্দার সময়েও বাংলাদেশ অনেকটাই নিরাপদে ছিল।
তাহলে কী কী করা যেতে পারে? জুলাই মাসের রপ্তানি পরিসংখ্যানের একটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য হলো- তৈরি পোশাক রপ্তানি আয় গত বছরের একই মাসের তুলনায় দুই শতাংশ কমলেও সার্বিকভাবে বেড়েছে শূন্য দশমিক ৫৯ শতাংশ। এর মানে অন্যান্য কিছু খাতে রপ্তানি বেড়েছে। পরিমাণে কম হলেও কৃষিপণ্য রপ্তানি বেড়েছে ৩২ শতাংশ। রাসায়নিক পণ্য রপ্তানি বেড়েছে ৪৪ শতাংশ। হস্তশিল্প রপ্তানি বেড়েছে ৫৭ শতাংশ। ওষুধ রপ্তানি বেড়েছে ৪৯ শতাংশ। এ রকম বড় প্রবৃদ্ধি হয়েছে পাট ও পাটপণ্য, কার্পেট, হোম টেক্সটাইল, প্রকৌশলসহ আরও কিছু পণ্যে। সরকারের সংশ্নিষ্ট মন্ত্রণালয় ও বিভাগ এসব পণ্যের রপ্তানিকারকদের সঙ্গে বসতে পারে। এসব খাতে রপ্তানির অঙ্ক আরও কীভাবে বাড়ানো যায় তার জন্য সময়াবদ্ধ কর্মপরিকল্পনা হাতে নেওয়া যেতে পারে।
এবার আসি বাজার বহুমুখীকরণ প্রসঙ্গে। এই মুহূর্তে বাংলাদেশের জন্য এক্ষেত্রে বড় প্রাপ্তি চীনের বাজারে বাংলাদেশের প্রায় সব পণ্যে শুল্ক্কমুক্ত সুবিধা। আমরা যদি চীনের পণ্য আমদানির ১ শতাংশও দখলে নিতে পারি তাহলে সেদেশে রপ্তানির পরিমাণ হবে ২৫ বিলিয়ন ডলার, যা গত অর্থবছরে বাংলাদেশের বর্তমান সার্বিক রপ্তানির প্রায় ৭০ শতাংশ। চীন গত মাস থেকে এই সুবিধা কার্যকর করেছে। সুতরাং দেরি না করে চীনের বাজারে নতুন সুযোগ কাজে লাগাতে অর্থবহ কর্মকৌশল ঠিক করতে হবে।
সবশেষে বলব, করোনা সংক্রমণ কমে এলেও এর প্রভাব থাকবে অনেক দিন। করোনার কারণে বিশ্বে কিছু পণ্যের চাহিদা বাড়বে। বাংলাদেশকে ওই বর্ধিত চাহিদার অংশে ভাগ বসাতে হবে। এর জন্য প্রস্তুতি নিতে দেরি করলে অন্যরা এগিয়ে যাবে। কারণ কেউ বসে নেই।
|