[ শেষ পাতা ] 2020-08-11
 
সম্ভাবনার শ্রমবাজারে বহুমুখী চ্যালেঞ্জ
 
করোনা থাবায় বিশ্বের শ্রমবাজার বিপর্যস্ত। কর্মহীন হয়ে পড়েছেন কোটি কোটি মানুষ। প্রবাসী বাংলাদেশিদের অনেকে বাধ্য হয়ে দেশে ফিরছেন। অনেকে ফেরার অপেক্ষায় রয়েছেন। তবে এর মধ্যে আশার খবর যুক্ত হচ্ছে শ্রমের নতুন বাজার সৃষ্টি হচ্ছে। দেশের শ্রমবাজার দীর্ঘ বছর মধ্যপ্রাচ্যের ওপরে নির্ভরশীল হলেও ইউরোপ ও আমেরিকার দেশগুলোয় নতুন সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে। সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন, কম্বোডিয়া একটি সম্ভাবনাময় বাজার। সুযোগ রয়েছে রোমানিয়া, পোল্যান্ড, ক্রোয়েশিয়ায়ও। এ ছাড়া ম্যাকাও, হংকং, জাপান, কোরিয়া, সিঙ্গাপুর, থাইল্যান্ডেও শ্রমবাজার সম্প্রসারণের সুযোগ থাকছে।

বাজার সৃষ্টির ক্ষেত্রে যতটা না সহজ তার চেয়েও বহুগুণ চ্যালেঞ্জ রয়েছে এসব বাজারে প্রবেশে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, করোনা-পরবর্তীকালে এসব বাজারে শ্রমিকের চাহিদা তৈরি হবে। শ্রমবাজারে প্রবেশ করা গেলেও ধরে রাখতে নানা ধরনের চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হতে হবে।

প্রথম চ্যালেঞ্জ হচ্ছে ওইসব দেশের চাহিদা অনুযায়ী শ্রমিক সরবরাহ। এ ক্ষেত্রে প্রয়োজন বর্তমান বাস্তবতায় জনশক্তি তৈরি করা। দেশগুলোর চাহিদা জেনে এখন থেকে দক্ষ জনশক্তি তৈরিতে মনোনিবেশ করতে হবে। করোনায় অযথা সময় নষ্ট না করে বাজার খোঁজার পাশাপাশি সমূহ প্রয়োজনীয় জনবল তৈরির অবকাঠামো গড়ে তুলতে হবে।

সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, বর্তমানে বিশ্বের ১৭৪টি দেশে বাংলাদেশ থেকে জনশক্তি রপ্তানি হয়। প্রতিবছর প্রায় ৮ লাখ শ্রমিক এসব দেশে যায়। এসব জনশক্তির প্রায় ৮৫ শতাংশে যায় মধ্যপ্রাচ্যে।

একতরফা এককেন্দ্রিক নির্ভরশীল হওয়া অর্থনীতির জন্য সুখবর নয় বলে মনে করেন বিশ্বব্যাংক ঢাকা অফিসের উপদেষ্টা ও সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন। তিনি মনে করেন, অর্থনীতির ব্যালান্সের জন্য শ্রমবাজার বিকেন্দ্রীকরণ হওয়া দরকার। এককেন্দ্রিক হওয়ার ফলে অর্থনীতিতে যে কোনো সময় বিপর্যয় নেমে আসার আশঙ্কা থাকে। এ অবস্থায় সবার আগে প্রয়োজন নতুন নতুন বাজার খোঁজা। পাশাপাশি চাহিদা অনুযায়ী প্রয়োজন দক্ষ জনশক্তি তৈরি করা। তিনি বলেন, বিশ্বের উন্নত দেশগুলোর বাজারে প্রবেশ করতে হবে। এটি সম্ভব হলে শ্রমিকরা বেশি বেতনে কাজ করতে পারবেন। ফলে রেমিট্যান্সের পরিমাণ বাড়বে।

প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের সচিব ড. আহমেদ মুনিরুছ সালেহীন আমাদের সময়কে বলেন, নতুন বাজার খুঁজে পাওয়াটাই হচ্ছে বড় চ্যালেঞ্জ। আমরা সেদিকেই জোর দিয়েছি। যেখানে যতটুকু সুযোগ দেখছি সেখানেই ঢোকার চেষ্টা করছি। আমরা বাজার পরীক্ষা করছি। তিনি বলেন, সৌদি রাষ্ট্রদূত বলেছেন, সুদানে কৃষিভিত্তিক বাজার তৈরি হবে। এ ছাড়াও ক্রোয়েশিয়ায় নতুন বাজার সৃষ্টি হবে বলে জানা গেছে। সব জায়গায় পরীক্ষা করছি। তিনি বলেন, আমাদের অগ্রপশ্চাৎ বিবেচনা করে মাঠে নামতে হবে। অনেকেই অনেক কথা বলেন; কিন্তু আমাদের দেখতে হবে শ্রমিকদের নিরাপত্তা, তাদের স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনা। এ ছাড়াও শ্রমের অধিকার ও মানবাধিকারের বিষয়ও বিবেচনায় রাখতে হবে। তিনি বলেন, কম্বোডিয়া, পূর্ব এশিয়ার কয়েকটি দেশ এবং পোল্যান্ড, জার্মানিসহ বেশ কয়েকটি দেশে নতুন বাজার সৃষ্টি হওয়ার সুযোগ রয়েছে। সত্যিকার অর্থে করোনার আঘাতে কাজে অনেক গতি কমেছে। আমরা কোথাও যেতে পারছি না, তারাও আমাদের দেশে আসতে পারছে না। এসব ক্ষেত্রে সরেজমিন প্রয়োজন। আমরা নিজেরা প্রস্তুতি নিচ্ছি। বিদ্যমান বাস্তবতায় যতটুকু করার দরকার তা-ই করছি। বিশেষ করে যারা ফিরে এসেছেন তাদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হচ্ছে। আত্মকর্মসংস্থান তৈরির প্রশিক্ষণের পাশাপাশি ফিরে গেলে যেন স্বপদে কাজ পায় সে জন্য চেষ্টা করা হচ্ছে। আমরা মনে করছি শিগগিরই এই পরিস্থিতি থেকে মুক্তি পাব।

জনশক্তি কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর (বিএমইটি) মহাপরিচালক মো. শামছুল আলম আমাদের সময়কে বলেন, বিমান চলাচল বন্ধ থাকায় আমরা কোনো দেশে যেতে পারছি না। সে ক্ষেত্রে কোন দেশ থেকে কেমন চাহিদা আসবে সে বিষয়ে অ্যাম্বাসিগুলোর কাছ থেকে মতামত চাওয়া হয়েছে। সেগুলো স্টাডি করে দেখতে হবে। তিনি বলেন, এখনো সঠিকভাবে জানা যায়নি বিভিন্ন দেশের চাহিদা সম্পর্কে। তবে আমরা প্রস্তুত আছি। প্রশিক্ষণ চালিয়ে যাচ্ছি। বর্তমান পরিস্থিতি মাথায় নিয়ে কাজ করছি। বাকিটা পরিবেশ স্বাভাবিক হওয়ার ওপর নির্ভর করবে। তিনি আরও বলেন, বিশ্বের বিভিন্ন দেশে মেডিক্যাল টেকনোলজিস্ট নার্সসহ সংশ্লিষ্টদের বিভাগের জনবলের বেশ চাহিদা হয়েছে। এমনকি আমাদের দেশেও নার্সের চাহিদা বেড়েছে। কিন্তু এগুলো হঠাৎ করে তৈরি করা সম্ভব না।

এ ছাড়াও আমাদের দেশে বেসরকারি প্রতিষ্ঠান থেকে যে নার্স বের হয় তার মান নিয়ে অনেক প্রশ্ন আছে। আন্তর্জাতিক বাজারে যদি আমরা নার্স দিতে চাই সে ক্ষেত্রে তারা পরীক্ষা নেবে। সেখানে আমাদের নার্সদের পাস করা কঠিন হবে। এর ফলে আমাদের দরকার প্রশিক্ষিত নার্স। একই সঙ্গে কৃষি ক্ষেত্রে ব্যাপক জনবলের চাহিদা হবে। আমরা সে অনুযায়ী প্রশিক্ষণের চেষ্টা করছি।

শামছুল আলম আরও বলেন, আমরা ১৭৪টি দেশে লোক পাঠাচ্ছি। বর্তমান প্রেক্ষিতে নতুন ট্রেড আসতে পারে। কাজের ধরনেও পরিবর্তন আসতে পারে। আমরা এসব নিয়ে কাজ করছি।

জনশক্তি রপ্তানিকারকদের সংগঠন বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব ইন্টারন্যাশনাল রিক্রুটিং এজেন্সিসের (বায়রা) মহাসচিব শাহিন আহমেদ চৌধুরী নোমান আমাদের সময়কে বলেন, বিশ্বের অর্থনীতির পরিস্থিতি কী হবে তা আমরা কেউই জানি না। জানুয়ারির পর থেকে স্থবির অবস্থা বিরাজ করছে। আমরা কেউ জানি না করোনা-পরবর্তী বিশ্ব অর্থনীতির পরিস্থিতি কী হবে। মূলত এই পরিস্থিতি স্বাভাবিক না হওয়া পর্যন্ত কোনো কিছুই বলা যাচ্ছে না। আমাদের দুধরনের শ্রমবাজার রয়েছেÑ একটি হচ্ছে ট্র্যাডিশনাল বিশাল বাজার, আরেকটি নতুন বাজার।

শাহিন আহমেদ বলেন, কম্বোডিয়া একটি সম্ভাবনাময় বাজার। রোমানিয়া, পোল্যান্ড, ক্রোয়েশিয়া ম্যাকাও, হংকং, জাপান, কোরিয়া, সিঙ্গাপুর থাইল্যান্ডের সম্ভাবনা উঁকি দিচ্ছে। আমরা বিশ্বাস করি, করোনা-পরবর্তীকালে ইউরোপের বড় ধরনের একটা চাহিদা হবে। আমরা মধ্যপ্রাচ্যের ওপর নির্ভরশীল হয়ে গেছি। প্রতিবছর সাত থেকে আট লাখ শ্রমিক বাজারে প্রবেশ করে। এর মধ্যে প্রায় ৮৫ শতাংশ যায় মধ্যপ্রাচ্যে। আমরা যদি আস্তে আস্তে ইউরোপ ও আমেরিকার দেশগুলোয় প্রবেশ করতে পারি তা হলে মধ্যপ্রাচ্যের ওপর নির্ভরশীলতা কমে যাবে। তা ছাড়া ওইসব দেশে মধ্যপ্রাচ্যের চেয়ে বেতন অনেক ভালো। আমাদের জন্য ভ্যালুয়েশন বেড়ে যাবে। তবে নতুন বাজারের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ রয়েছে। নতুন বাজারে প্রবেশ করতে হলে প্রস্তুতির বিষয় রয়েছে। এসব বাজারে ট্র্যাডিশনাল বাজারের মতো জনশক্তি পাঠালে চলবে না, দক্ষ জনশক্তি তৈরিতে জোর দিতে হবে। ভাষা এবং ওই দেশের কৃষ্টি-কালচার সম্পর্কে জানার পাশাপাশি সংশ্লিষ্ট কাজের দক্ষতা বাড়াতে হবে। তিনি বলেন, সরকারি-বেসরকারি মিলে প্রায় ১৩০টি ট্রেনিং সেন্টার রয়েছে। কাজের ধরন অনুযায়ী আরও ৫০-৬০টি নতুন ট্রেনিং সেন্টার করার উদ্যোগ নিয়েছে মন্ত্রণালয়।

শাহিন আহমেদ আরও বলেন, ইথনিক সেন্টারে কেবল বিল্ডিং বানানো হবে না, এখানে বিশ্বমানের মানসম্মত ট্রেনিংয়ের ব্যবস্থা করতে হবে। সেটা হতে হবে বর্তমান বিশ্বের চাহিদা অনুযায়ী। ট্রেনিং সেন্টারগুলোকে ঢেলে সাজাতে হবে। পাশাপাশি বিশেষায়িত ট্রেনিং সেন্টার তৈরি করতে হবে। এ জন্য বিদেশি প্রশিক্ষণের পাশাপাশি প্রযুক্তি আনা যায়। এভাবে সমন্বয় করে কাজ করলে শ্রমবাজার ইফেক্টিভ হবে এবং ভ্যালু অ্যাড হবে। তিনি বলেন, করোনা উন্নতি না হলে কোনো কিছুই করা সম্ভব না। তবে করোনা পরবর্তীকালে আমরা যাতে পিছিয়ে না যাই সে ক্ষেত্রে এখনই প্রস্তুতি গ্রহণ করতে হবে। এ জন্য পরিকল্পনা করে এগোতে হবে। অর্থায়ন করে অবকাঠামো তৈরি করা দরকার। এর মাধ্যমে শ্রমবাজার খুললেই তাড়াতাড়ি লোক পাঠাতে পারব। আমরা যদি এখন বাজার খোলার অপেক্ষায় থাকি তা হলে আমরা পিছিয়ে পড়ব। করোনা-পরবর্তীকালে গতানুগতিক চাহিদা থাকবে না। এখানে স্বাস্থ্য খাতে প্রচুর চাহিদা আসবে। পাশাপাশি কৃষি ক্ষেত্রে চাহিদা থাকবে। স্বাস্থ্য খাতে বড় বিনিয়োগ হবে। সুযোগ ধরতে হলে আমাদের স্বাস্থ্য বিষয়ে দক্ষ জনবল তৈরি করতে হবে।
Print Close  
Print Close  
News Source
            Top
            Top
 
Home / About Us / Benifits /Invite a Friend / Policy
Copyright © Hawker 2009-2010, Allright Reserved