শিল্পনীতিতে কুটির, অতিক্ষুদ্র, ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পের (সিএমএসএমই) একটি সার্বিক গ্রহণযোগ্য সংজ্ঞা থাকা প্রয়োজন। এজন্য মাইক্রো ও ক্ষুদ্র শিল্পের জন্য একটি নীতিমালা এবং মাঝারি শিল্পের জন্য পৃথক নীতিমালা প্রণয়নের প্রস্তাব করেছেন খাতসংশ্লিষ্টরা। এতে কুটির, মাইক্রো ও ক্ষুদ্র উদ্যোক্তারা নীতিমালার সুবিধা সহজে গ্রহণ করতে পারবেন বলে মনে করছেন তারা।
গতকাল ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি (ডিসিসিআই) আয়োজিত ‘শিল্পনীতির সীমাবদ্ধতা ও সম্ভাবনা’ শীর্ষক ওয়েবিনার থেকে এমন আহ্বান জানানো হয়েছে। ওয়েবিনারে প্রধান অতিথি ছিলেন শিল্পমন্ত্রী নূরুল মজিদ মাহমুদ হুমায়ূন। বিশেষ অতিথি ছিলেন বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজ বিভাগের অধ্যাপক ড. আতিউর রহমান এবং পল্লী কর্মসহায়ক ফাউন্ডেশনের (পিকেএসএফ) চেয়ারম্যান ড. কাজী খলীকুজ্জামান আহমেদ। সম্মানিত অতিথি ছিলেন এসএমই ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান ড. মো. মাসুদুর রহমান।
অনুষ্ঠানে স্বাগত বক্তব্যে ঢাকা চেম্বার সভাপতি শামস মাহমুদ বলেন, গত তিন দশকে বাংলাদেশের শিল্প খাত প্রবৃদ্ধি অর্জন করলেও তা ছিল মূলত রফতানিমুখী তৈরি পোশাক খাতনির্ভর। তবে শিল্প খাতের বহুমুখীকরণে চামড়া, পাট, কৃষিপণ্য প্রক্রিয়াজাত, জাহাজ নির্মাণ, লাইট ইঞ্জিনিয়ারিং, ফার্মাসিউটিক্যাল প্রভৃতি শিল্পের বিকাশের লক্ষ্যে প্রয়োজনীয় নীতি সহায়তা একান্ত আবশ্যক।
ডিসিসিআই সভাপতি বলেন, প্রয়োজনীয় গবেষণা ও বিনিয়োগের অভাবে দেশের উদ্যোক্তাদের প্রতিযোগিতার বাজারে টিকে থাকতে বেশ সমস্যার মুখোমুখি হতে হচ্ছে। তিনি শিল্পনীতিতে দেশের ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প বিকাশের লক্ষ্যে আরো বেশি প্রাধান্য দেয়ার পাশাপাশি চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের সুযোগ কাজে লাগানোর জন্য উদ্ভাবন ও প্রযুক্তিগত উন্নয়নের লক্ষ্যে শুল্ক ও নীতি সহায়তা দেয়ার প্রস্তাব করেন।
প্রধান অতিথির বক্তব্যে শিল্পমন্ত্রী বলেন, সিএমএসএমইতে পৃষ্ঠপোষকতা প্রদানের মাধ্যমে নতুন উদ্যোক্তা তৈরি, বৃহত্তর শিল্পের ব্যাকওয়ার্ড লিংকেজকে বলিষ্ঠকরণ, কর্মসংস্থান সহায়ক প্রবৃদ্ধি এবং গ্রামীণ ও শহুরে বসবাসকারীদের মাঝে বৈষম্য হ্রাস করার লক্ষ্যে আসন্ন শিল্পনীতি প্রণয়ন করা হবে।
মন্ত্রী বলেন, সংশ্লিষ্ট অংশীজনদের আলোচনার ভিত্তিত্তে যে শিল্পনীতি প্রণয়ন করা হবে। তা ব্যবসার পরিবেশ উন্নয়ন এবং ব্যবসা পরিচালনার সূচকসহ অন্যান্য সূচকে বাংলাদেশের অবস্থান আরো উন্নত করবে, যা দেশী ও বিদেশী বিনিয়োগ আকর্ষণে সক্রিয় ভূমিকা রাখবে।
অধ্যাপক ড. আতিউর রহমান বলেন, রফতানিমুখী পণ্যের বহুমুখীকরণ ও দক্ষ মানবসম্পদ তৈরির বিষয়টি এখন বেশ প্রকট হয়েছে এবং এ অবস্থার উত্তরণে বিশেষ করে কৃষি খাত ও এসএমই খাতের উদ্যোক্তারা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারেন।
এসএমইদের সংজ্ঞায়নে বেশ সমস্যা রয়েছে, যা নিরসন করা একান্ত আবশ্যক বলে মন্তব্য করেন অধ্যাপক ড. আতিউর রহমান। এজন্য তিনি বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চলগুলোয় ছোট ও মাঝারি উদ্যোক্তাদের জন্য আলাদা অঞ্চল স্থাপন করার প্রস্তাব করেন। এছাড়া প্রণোদনার টাকা ফেরত দেয়ার সময়সীমা অন্তত দুই বছর বাড়ানোর জন্য সরকারের প্রতি আহ্বান জানান ড. আতিউর রহমান। বিশেষ করে এসএমইদের জন্য প্রণোদনার প্যাকেজে বরাদ্দের পরিমাণ আরো বাড়ানোর প্রস্তাব করেন তিনি।
ড. কাজী খলীকুজ্জামান আহমেদ বলেন, দক্ষ মানবসম্পদের জন্য শিক্ষা ও শিল্প ব্যবস্থার সমন্বয় বাড়াতে হবে এবং শিল্প খাতের জন্য কী ধরনের দক্ষ মানবসম্পদের প্রয়োজন, তা নিরূপণ করে দক্ষতা বৃদ্ধিতে কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে।
গ্রামীণ অর্থনীতি টিকিয়ে রাখার জন্য প্রণোদনার প্যাকেজ সবার কাছে পৌঁছানোর বিষয়টি নিশ্চিতকরণে সবার প্রতি আহ্বান জানান এবং এ লক্ষ্যে সব সংস্থার সমন্ব্বয় বাড়ানোর ওপর জোরারোপ করেন খলীকুজ্জামান।
ড. মো মাসুদুর রহমান বলেন, আমাদের অর্থনীতিতে এসএমই খাতের অবদান প্রায় ২৫ শতাংশ। যেখানে প্রতিবেশী ভারতে এর পরিমাণ প্রায় ৬০ শতাংশ। এজন্য সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনায় এসএমই খাতের উন্নয়নে সমন্বিত নীতিমালা প্রণয়নের কোনো বিকল্প নেই বলে মনে করেন তিনি।
বাংলাদেশ ব্যাংকের এসএমই অ্যান্ড স্পেশাল প্রোগ্রামস বিভাগের মহাব্যবস্থাপক হোসনে আরা শিখা বলেন, ই-কমার্স ও এফ-কমার্স খাতের উদ্যোক্তাদের অনেকেরই ট্রেড লাইসেন্স নেই। ফলে তাদের ঋণসহায়তা দেয়া সম্ভব হচ্ছে না। এ অবস্থায় এ খাতের উদ্যোক্তাদের ট্রেড লাইসেন্স ব্যতিরেকে ঋণসহায়তা দেয়া যায় কিনা, সে বিষয়ে সংশ্লিষ্টদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন তিনি।
বিল্ডের চেয়ারপারসন ও ঢাকা চেম্বারের সাবেক সভাপতি আবুল কাসেম খান মনে করেন, শিল্পনীতিতে সব খাতকে সুনির্দিষ্টভাবে গুরুত্ব প্রদান ও সংজ্ঞায়ন করা প্রয়োজন। পাশাপাশি শিল্পনীতি প্রণয়নে একটি সুনির্দিষ্ট ডাটা বেজ প্রণয়ন করার মত প্রকাশ করেন তিনি।
ওয়েবিনারে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন রিসার্চ অ্যান্ড পলিসি ইন্টিগ্রেশন ফর ডেভেলপমেন্টের নির্বাহী পরিচালক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজের অধ্যাপক ড. মো. আবু ইউসুফ এবং বক্তব্য দেন বিসিকের চেয়ারম্যান মো. মোশতাক হাসান এনডিসি।