[ অনলাইন ] 2021-11-28
 
প্রবাসী শ্রমিকদের মজুরি বাড়বে কীভাবে
 
পারস্য উপসাগরীয় অঞ্চলে দক্ষিণ এশিয়ার কায়িক শ্রমিকদের মধ্যে বাংলাদেশি শ্রমিকদের মজুরি সবচেয়ে কম। সম্প্রতি বিশ্বব্যাংক ও নোম্যাডের এক প্রতিবেদনের তথ্যানুসারে, এ অঞ্চলে বাংলাদেশি শ্রমিকদের গড় মাসিক মজুরি মাত্র ২০৩ ডলার। অথচ পাকিস্তানি শ্রমিকদের গড় মজুরি ২৭৬ ডলার, ভারতীয়দের ৩৯৬ ডলার, চীনাদের ৫৩৩ ডলার আর ফিলিপিনোদের ৫৬৪ ডলার।

বাংলাদেশি শ্রমিকদের কম মজুরি পাওয়ার এই সংবাদ প্রকাশিত হওয়ার পর সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে অনেকে অভিজ্ঞতার আলোকে নানা মন্তব্য করেন। তাঁদের বক্তব্যের সার কথা হলো—মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন বড় বিমানবন্দরে প্রচুর ফিলিপিনো ডিউটি ফ্রি দোকানে কাজ করেন। নেপালিরাও আছেন সেখানে। কিন্তু অধিকাংশ বাংলাদেশি সেখানে পরিচ্ছন্নতাকর্মী হিসেবে কাজ করেন। শিক্ষা ও প্রশিক্ষণে পিছিয়ে থাকাই এর মূল কারণ। শ্রমিক কত মজুরি পাবেন তা নির্ভর করে মূলত শ্রমিকের দক্ষতা ও দর-কষাকষির সক্ষমতার ওপর। দর-কষাকষির সক্ষমতা আবার নির্ভর করে শিক্ষা ও প্রশিক্ষণের ওপর।

বাংলাদেশ ব্যাংকের এক জরিপ অনুযায়ী, বাংলাদেশ থেকে বিদেশে যাওয়া শ্রমিকদের ৬২ শতাংশ অদক্ষ ও ৩৬ শতাংশ আধা দক্ষ, অর্থাৎ মাত্র ২ শতাংশ দক্ষ। এ তথ্য আমাদের শঙ্কিত করে তোলে। শিক্ষাগত যোগ্যতার সাপেক্ষেও একই চিত্র মেলে—প্রবাসী শ্রমিকদের মধ্যে প্রাথমিক, নিম্নমাধ্যমিক, মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক পাসের হার যথাক্রমে ২৪ দশমিক ৯, ২৬ দশমিক ২, ২৩ দশমিক ২ ও ১২ দশমিক ২ শতাংশ। অর্থাৎ ৮৬ শতাংশ প্রবাসী শ্রমিকের পড়াশোনার দৌড় উচ্চমাধ্যমিক পর্যন্ত। বাংলাদেশে যে বিদেশিরা কাজ করেন, তাঁদের সঙ্গে আমাদের শ্রমিকদের শিক্ষাগত যোগ্যতার পার্থক্য আকাশ-পাতাল। 

অনেক সময় দেখা যায়, বাংলাদেশে কর্মরত একজন বিদেশি কর্মী গড়ে যে বেতন পান, বিদেশে কর্মরত ১০০ বাংলাদেশি শ্রমিকের বেতনও তাঁর সমান নয়। প্রবাসে বাংলাদেশি শ্রমিকদের মধ্যে নারীর সংখ্যা ১ লাখ ২১ হাজার ৯২৫, যা মোট সংখ্যার ১২ দশমিক ৯ শতাংশ। বলার অপেক্ষা রাখে না যে তাঁরা সবচেয়ে বেশি নিগৃহীত হচ্ছেন এবং অনেকে মেয়াদ শেষের আগেই দেশে ফিরে আসতে বাধ্য হচ্ছেন।

আরেকটি সমস্যা হচ্ছে, আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার বেড়ে যাওয়ায় অদক্ষ শ্রমিকের চাহিদা কমতে শুরু করেছে। এ অবস্থায় বিদেশে দক্ষ ও প্রশিক্ষিত শ্রমিক পাঠানোর দিকেই মনোযোগ বাড়াতে হবে। সৌদি আরবসহ কয়েকটি দেশে যে শ্রমিকেরা যান, তাঁরা স্থানীয় ভাষা না জানায় নানা সমস্যার সম্মুখীন হন। এসব সমস্যা কিছু প্রশিক্ষণের মাধ্যমে সমাধান করা সম্ভব নয়, শিক্ষাব্যবস্থায় প্রয়োজনীয় পরিবর্তন আনা দরকার। নতুন পাঠ্যসূচি এই বাস্তবতার আলোকেই প্রণয়ন করা হয়েছে।

শিক্ষা খাতে বাংলাদেশের বরাদ্দ দক্ষিণ এশিয়ায় সবচেয়ে কম—জিডিপির মাত্র ২ দশমিক ১ শতাংশ। অথচ ইউনেসকো বা জাতিসংঘের পরামর্শ হচ্ছে, শিক্ষা খাতে জিডিপির ৪ থেকে ৬ শতাংশ বরাদ্দ দেওয়া হয়। তবে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের বাইরেও কিছু মন্ত্রণালয় শিক্ষামূলক কার্যক্রম পরিচালনা করে। তারাও এই খাতে কিছু বরাদ্দ পায়। সে কারণে ওই অর্থ হিসাবের মধ্যে আসে না বলে জানা যায়। বৈশ্বিক অভিজ্ঞতায় দেখা যায়, যেসব দেশ শিক্ষায় বেশি বরাদ্দ দেয়, তারাই অন্যদের চেয়ে এগিয়ে যায়।

এদিকে বাংলাদেশ স্বল্পোন্নত দেশের কাতার থেকে বেরিয়ে আসবে ২০২৬ সালে। তারপর হয়তো দেনদরবার করে আরও কিছুদিন অগ্রাধিকারমূলক কিছু সুবিধা পাওয়া যাবে। সেই পরিস্থিতিতে বৈশ্বিক পরিসরে প্রতিযোগিতা করতে হবে। ফলে তখন আর অদক্ষ ও কম মজুরির শ্রমিকদের দিয়ে চলবে না। প্রতিযোগিতা করতে দক্ষ শ্রমিকের দরকার হবে।

সরকার নতুন যে পাঠ্যসূচি প্রণয়ন করেছে, তা অনেকটা এই উদ্দেশ্যেই। মূলত মুখস্থ করে পরীক্ষার হলে উগরে দেওয়ার রীতি থেকে শিক্ষার্থীদের বের করে আনাই এর মূল উদ্দেশ্য। লক্ষ্য হচ্ছে, শিক্ষার্থীদের প্রয়োজনীয় দক্ষতা রপ্ত করানো। সে লক্ষ্যে তৃতীয় শ্রেণি পর্যন্ত কোনো ধরনের পরীক্ষা থাকবে না। 

এ ছাড়া এসএসসি ছাড়া আর কোনো বোর্ড পরীক্ষাও থাকবে না। তবে বছরজুড়ে শিক্ষার্থীদের জ্ঞান ও সক্ষমতার পরীক্ষা নেওয়া হবে। উচ্চবিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের গ্রাফিকস ডিজাইন, কাঠের কাজ, গাড়ি মেরামত, শিশুর যত্নআত্তি, পানির লাইন মেরামত—এসব কোর্সের মধ্য থেকে দুটি বাধ্যতামূলক করা হবে। শেখানো হবে কোডিং। আর সরকার আরও কারিগরি বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন করবে।

তবে বাস্তবতা হলো, এর জন্য বিনিয়োগ বাড়ানোর পাশাপাশি শ্রেণিকক্ষে পাঠদান নিশ্চিত করতে শিক্ষকদের প্রশিক্ষিত করতে হবে। কারণ হিসেবে সৃজনশীল ব্যবস্থার ব্যর্থতার প্রসঙ্গ টানা যায়। অনেক ঢাকঢোল পিটিয়ে সৃজনশীল পদ্ধতি চালু করার পরও দেখা গেল, যে লাউ সে-ই কদু। 

কথা ছিল, এ পদ্ধতিতে মুখস্থনির্ভরতা বা প্রাইভেট টিউশনের ওপর নির্ভরশীলতা কমে আসবে। কিন্তু বাস্তবে তার উল্টো ঘটল। শিক্ষকদের প্রস্তুতি না থাকাটা যার প্রধান কারণ। আরেকটি কারণ হলো, শিক্ষকদের প্রাইভেট টিউশন। এ বাণিজ্য টিকিয়ে রাখতে শিক্ষকদের বড় অংশ শ্রেণিকক্ষে এই সৃজনশীল পদ্ধতিতে পাঠদানে আগ্রহী নয়।

প্রাথমিক শিক্ষায় অন্তর্ভুক্তিতে বাংলাদেশ দক্ষিণ এশিয়ার প্রতিবেশীদের ছাড়িয়ে গেলেও গুণগত মানের দিক থেকে এখনো অনেকটাই পিছিয়ে। বিশ্বব্যাংকের তথ্যানুসারে, ১০ বছর বয়সী শিশুর অর্ধেকের বেশি বিদ্যালয়ে পড়াশোনা করলেও পড়ার দক্ষতার দিক থেকে পিছিয়ে আছে। আর ১৫ থেকে ২৪ বছর বয়সী কিশোর-তরুণদের এক-তৃতীয়াংশের বেশি শিক্ষা, প্রশিক্ষণ বা কাজে নেই। 

কোভিডের কারণে দীর্ঘদিন বিদ্যালয় বন্ধ থাকার কারণে পরিস্থিতির আরও অবনতি হয়েছে। কিন্তু এখন সামনে এগোনোর সময়। শিক্ষার মানোন্নয়নে মনোযোগ দিয়ে শিক্ষার্থীদের চিন্তাশক্তি ও যুক্তিবোধ শাণিত করতে হবে। আমাদের পার্শ্ববর্তী দেশ ভারত আজ পৃথিবীর সবচেয়ে বড় সিইও সরবরাহকারী দেশ। সে জন্য তাঁদের আয়ও বেশি। অন্যদিকে আমাদের দেশের মানুষ মূলত কায়িক শ্রম দিতে বিদেশে যাচ্ছেন। তাই তাঁদের আয় কম।

এখন সারা পৃথিবীতে নিয়োগদাতারা কর্মীদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি যে দুটি গুণ খোঁজেন, তা হলো বিশ্লেষণী দক্ষতা, সমস্যা সমাধান ও যোগাযোগ দক্ষতা। প্রযুক্তিভিত্তিক এক কোম্পানির প্রধান নির্বাহীর ভাষ্য—একজন নিয়োগপ্রার্থী পাবলিক পরীক্ষায় জিপিএ-৫ পেয়েও যদি কোম্পানির বাস্তব সমস্যা সমাধানে দক্ষ না হন, তাহলে তো চলবে না। অর্থাৎ শিক্ষার উদ্দেশ্য এখন নিছক জ্ঞানার্জন নয়, সমস্যা সমাধান করাও তার উদ্দেশ্য। তবে জ্ঞানার্জনের সঙ্গে সমস্যা সমাধানের বিরোধ নেই।

বাস্তবতা হলো, আধুনিক জগতের এসব চাহিদা পূরণের সমাধান আমাদের পাঠ্যক্রমে নেই। কেউ যদি ইংরেজিমাধ্যম (ভার্সন নয়) ও বাংলামাধ্যমের পাঠ্যক্রম তুলনা করেন, তাহলেই ব্যাপারটা পরিষ্কার হয়ে যাবে। তবে সরকারের প্রাক্‌-প্রাথমিক শিক্ষাক্রমে বেশ পরিবর্তন নিয়ে আসা হয়েছে। সেই পাঠ্যক্রম ঠিকঠাক অনুসৃত হলেও শিক্ষণ জোরদার হতো। জেলা বা উপজেলা সদরে তা কিছুটা হলেও ইউনিয়ন পর্যায়ের পরিস্থিতি একেবারেই নাজুক। সেখানে কে কী করল তা দেখার কেউ নেই। আর যে দেশে প্রাথমিক পর্যায়ের শিক্ষক নিয়োগে দুর্নীতি হয়, সেখানে শিক্ষকেরা পাঠদানের চেয়ে ঘুষের টাকা তুলতেই বেশি ব্যস্ত থাকবেন, সেটাই স্বাভাবিক। 

আর এই পাঠ্যসূচি পড়ানোর মতো প্রশিক্ষণ শিক্ষকদের নেই। ফলে প্রত্যেক স্তরের শিক্ষার্থীদের মধ্যেই শিক্ষণের ঘাটতি দেখা যায়। স্বল্পশিক্ষিত যে মানুষেরা বিদেশে শ্রমিক হিসেবে কাজ করতে যাচ্ছেন, তাঁরাও এই শিক্ষাব্যবস্থার ফসল। প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণও সেভাবে পান না তাঁরা। ফলে যা হওয়ার তাই হয়, তাঁরা বিদেশে গিয়ে কম মজুরিতে কায়িক শ্রম করেন।

নতুন এই পাঠ্যসূচি ২০২৫ সাল থেকে বাস্তবায়ন শুরু হবে। সম্প্রতি দ্য ইকোনমিস্টের এক প্রতিবেদনে এই পাঠ্যসূচির প্রশংসা করা হয়েছে। বলা হয়েছে, বাংলাদেশ শিক্ষার মানোন্নয়নে প্রাণপণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। উচ্চবিদ্যালয়ের জন্য যে পাঠ্যসূচি করা হয়েছে, তাতে দক্ষতার ঘাটতি অনেকটাই মেটানো যাবে, আমরা এখন তেমন আশাই করি। তবে সবকিছু নির্ভর করছে বাস্তবায়নের ওপর।

শ্রমভিত্তিক ও অনানুষ্ঠানিক খাতনির্ভর অর্থনীতির জন্য খুব বেশি শিক্ষিত-প্রশিক্ষিত মানুষের প্রয়োজন হয় না, বাংলাদেশই এর প্রকৃষ্ট উদাহরণ। কোভিডের সময় দেখা গেল, এই অনানুষ্ঠানিক খাতের মানুষের জীবন সবচেয়ে অরক্ষিত। তাঁদের আয় কমেছে সবচেয়ে বেশি, অনিশ্চয়তাই তাঁদের নিত্যসঙ্গী। ফলে এ পরিস্থিতির উত্তরণে অর্থনীতি ও শিক্ষায় গুণগত পরিবর্তন দরকার। আর এলডিসি উত্তরণের পর প্রতিযোগিতামূলক বাজারে টিকে থাকতে গেলে এই অদক্ষ মানুষদের দিয়ে যে চলবে না, তা এখন সবাই বলছেন। এখন সেটা অনুধাবনের সময় এসেছে।
Print Close  
Print Close  
News Source
            Top
            Top
 
Home / About Us / Benifits /Invite a Friend / Policy
Copyright © Hawker 2009-2010, Allright Reserved