দক্ষিণ আফ্রিকায় দেখা দেওয়া করোনার নতুন ধরন ‘ওমিক্রন’ ঠেকাতে বাংলাদেশসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশ আবারও ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞায় যাচ্ছে। ধরনটির ভয়াবহতা তুলে ধরে সতর্কতা জারির পাশাপাশি স্বাস্থ্যবিধির ব্যাপারে নতুন করে নির্দেশনা জারি করছে। দেশগুলো তাদের প্রবেশপথে আগতদের স্ক্রিনিং টেস্টসহ সার্বিক পরিস্থিতির ওপর কঠোর নজরদারি আরও জোরদার করেছে।
এমনকি করোনার টিকা প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠানগুলোও করোনার নতুন ধরনের ওপর নজর রাখছে। ওমিক্রনের কারণে ইতোমধ্যেই তৈরি টিকায় কোনো পরিবর্তন আনতে হবে কি না, সে বিষয়ক তথ্য-উপাত্তের জন্য অপেক্ষা করছে প্রতিষ্ঠানগুলো। এসব প্রতিষ্ঠান উদ্ভূত ভ্যারিয়েন্টের উপযোগী টিকা বানিয়ে তা সরবরাহ করা যাবে বলেও আশ্বাস দিয়েছে। বাংলাদেশও দক্ষিণ আফ্রিকায় দেখা দেওয়া করোনার নতুন ধরন ওমিক্রনের বিস্তার ঠেকাতে সতর্কতার সঙ্গে পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছে। নানা ধরনের সতর্কতামূলক উদ্যোগ নিতে শুরু করেছে। বিশেষ করে দক্ষিণ আফ্রিকার সঙ্গে যোগাযোগ স্থগিত করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে বাংলাদেশ। পাশাপাশি নতুন ধরনে আক্রান্ত দেশগুলো থেকে আগতদের কঠোরভাবে পরীক্ষা করার নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। এ ব্যাপারে ইতোমধ্যেই স্বাস্থ্য অধিদপ্তর স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়সহ সংশ্লিষ্ট অন্য মন্ত্রণালয়গুলোকে তাদের উদ্বেগের কথা জানিয়েছে।
এ ব্যাপারে গতকাল শনিবার স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক সুইজারল্যান্ডের জেনেভায় অনুষ্ঠেয় ‘ওয়ার্ল্ড হেলথ অ্যাসেম্বলি সেকেন্ড স্পেশাল সেশনে’ অংশ নিতে যাত্রাকালে এক অডিও বার্তা দেন। সেখানে তিনি জানান, করোনার নতুন ধরন ‘ওমিক্রনের’ বিষয়ে তারা অবহিত হয়েছেন। এই ভাইরাসটি খুবই আগ্রাসী। এ কারণে আফ্রিকার সঙ্গে বাংলাদেশের যোগাযোগ এখন স্থগিত করা হচ্ছে।
অডিও বার্তায় স্বাস্থ্যমন্ত্রী বলেন, নতুন ভাইরাসটি করোনার অন্যান্য ধরনের তুলনায় কিছুটা বেশি আগ্রাসী হলেও দেশের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় এটি নিয়ে তৎপর রয়েছে। সব বিমানবন্দর, স্থলবন্দরসহ দেশের সব প্রবেশপথে স্ক্রিনিং আরও জোরদার করার জন্য নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। একই সঙ্গে সারা দেশেই স্বাস্থ্যবিধি কঠোরভাবে মেনে চলতে ও মাস্ক পরতে উদ্বুদ্ধ করতে সব জেলা শহরের প্রশাসনকে নির্দেশনা দেওয়া হচ্ছে।
ভাইরাসটি নিয়ে বেশি আতঙ্কিত না হয়ে দেশবাসীকে কঠোর স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার অনুরোধ জানিয়ে স্বাস্থ্যমন্ত্রী বলেন, বিশ্বের আক্রান্ত অন্যান্য জায়গা থেকেও যারা আসবে, তাদের বিষয়েও সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে। কোনোভাবেই স্ক্রিনিং ছাড়া যেন আক্রান্ত দেশের কোনো ব্যক্তি দেশে প্রবেশ করতে না পারে, সে ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।
উদ্বেগ জানিয়েছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর, আক্রান্ত দেশের নাগরিকদের কোয়ারেন্টাইনের প্রস্তাব : দক্ষিণ আফ্রিকার করোনার নতুন ধরন নিয়ে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর তাদের উদ্বেগের কথা সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও বিভাগকে জানিয়েছে। ধরনটির বিস্তার ঠেকাতে স্বাস্থ্য বিভাগসহ সরকারের বিভিন্ন বিভাগের মধ্যে যোগাযোগ শুরু হয়েছে। বিমানবন্দর ও স্থলবন্দরে সতর্কবার্তা পাঠানো হয়েছে। দেশের সবগুলো প্রবেশপথ দিয়ে দেশে আসা বিভিন্ন দেশের নাগরিকদের আগের চেয়ে আরও কঠোরভাবে স্ক্রিনিং করা হচ্ছে। পাশাপাশি নতুন ধরনে আক্রান্ত দেশগুলো থেকে আসা নাগরিকদের সবার প্রাতিষ্ঠানিক কোয়ারেন্টাইনে রাখার প্রস্তাব করেছে সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান (আইইডিসিআর)। এর জন্য হোটেল ভাড়া করা এবং নির্দিষ্ট হোটেলগুলোতে রাখার চিন্তাভাবনা করা হচ্ছে।
এ ব্যাপারে আইইডিসিআরের উপদেষ্টা ও সাবেক প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ডা. মুশতাক হোসেন দেশ রূপান্তরকে বলেন, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ওমিক্রনকে সরাসরি উদ্বেগজনক বলেছে। এর শক্তি ডেল্টা ভেরিয়েন্টের চেয়েও বেশি। এই ধরনটি টিকা নিয়েছে এমন মানুষকেও আক্রান্ত করতে পারে। তাই এখন থেকে দেশে আসা সবার জিনোম সিকোয়েন্স করতে হবে। বিশেষ করে ওমিট্রন দেখা দিয়েছে যে সব দেশে, সে সব দেশ থেকে যারা আসবেন, স্থল ও বিমানবন্দরে তাদের সবাইকে প্রাতিষ্ঠানিক কোয়ারেন্টাইনে রাখতে হবে। ওমিক্রন রয়েছে, সে সব দেশের নাগরিকদের এই দেশে আসা বন্ধ করে দিতে হবে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মুখপাত্র অধ্যাপক ডা. রোবেদ আমিন দেশ রূপান্তরকে বলেন, বর্ডার সিল ও বিমান যোগাযোগ বন্ধ করতে হলে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়কে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। একটা নতুন ভাইরাসের ব্যাপারে উদ্বেগ দেখা দিয়েছে, সেটা স্বাস্থ্য অধিদপ্তর এসব প্রতিষ্ঠানকে জানিয়েছে। সামনে ভাইরাসটি সম্পর্কে আরও তথ্য জানা যাবে। তবে এখন পর্যন্ত যেটুকু তথ্য পেয়েছি, সেটা সবাইকে জানিয়েছি। স্থল ও বিমানবন্দরের প্রবেশপথগুলোতে স্ক্রিনিং চলছে। এর বাইরে যদি কোনো নির্দেশনা আসে, সেটা আমরা বাস্তবায়ন করব।
আরও ৪ দেশে শনাক্ত, ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞায় ফিরছে যুক্তরাষ্ট্রসহ বহু দেশ : দক্ষিণ আফ্রিকার পাশাপাশি আরও ৪ দেশ ও অঞ্চলে শনাক্ত হয়েছে দক্ষিণ আফ্রিকার করোনার নতুন ধরন ওমিক্রন। এসব দেশ ও অঞ্চল হলোÑ বেলজিয়াম, বতসোয়ানা, ইসরায়েল ও হংকং। নতুন ধরন নিয়ে গত শুক্রবার বৈঠক করেছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও)। সংস্থাটি এক বিবৃতিতে জানিয়েছে, করোনাভাইরাসের নতুন এই ধরনটি মূল ভাইরাস ও তার অন্যান্য রূপান্তরিত ধরনগুলোর চেয়ে অনেক দ্রুতগতিতে সংক্রমিত করতে সক্ষম। প্রাথমিক যেসব তথ্য পাওয়া গেছে সেসব পর্যালোচনা করে বোঝা যাচ্ছে; করোনায় আক্রান্ত হওয়ার পর সুস্থ হয়ে ওঠা ব্যক্তিরাও ওমিক্রনে আক্রান্ত হতে পারেন।
গত বৃহস্পতিবার দক্ষিণ আফ্রিকায় প্রথম শনাক্ত হয় বি.১.১৫২৯ নামের করোনার নতুন ধরন। গ্রিক বর্ণমালা অনুসারে যার নাম দেওয়া হয় ওমিক্রন। ইতোমধ্যে এই ধরনটি দক্ষিণ আফ্রিকার বাইরে ছড়িয়ে পড়েছে এবং যদি দ্রুত ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞা জারি করা না হয়, সেক্ষেত্রে বিশ্বজুড়ে এটি ছড়িয়ে পড়া নিয়ন্ত্রণ প্রায় অসম্ভব হবে বলে সতর্কবার্তা দিয়েছেন আন্তর্জাতিক বিশেষজ্ঞরা।
যুক্তরাজ্যের সরকারি স্বাস্থ্য নিরাপত্তা সংস্থা এক বিবৃতিতে জানিয়েছে, নতুন শনাক্ত হওয়া রূপান্তরিত ধরনটির স্পাইক প্রোটিন মূল করোনাভাইরাসের চেয়ে অনেকটাই ভিন্ন। ফলে, মূল করোনাভাইরাস থেকে এর ধ্বংসাত্মক ক্ষমতা অনেক বেশিÑ এমন শঙ্কা উড়িয়ে দেওয়ার উপায় নেই।
ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও যুক্তরাজ্য ইতোমধ্যে দক্ষিণ আফ্রিকা ও তার আশপাশের দেশগুলো থেকে ফ্লাইট আগমনে নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে। পাশাপাশি, যে ব্রিটিশ যাত্রীরা গত কয়েকদিনের মধ্যে দক্ষিণ আফ্রিকা বা তার পার্শ্ববর্তী কোনো দেশ থেকে যুক্তরাজ্যে ফিরেছেন, তাদের কোয়ারেন্টাইনে থাকার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
একই আদেশ জারি করেছে যুক্তরাষ্ট্র এবং কানাডাও। আগামী সোমবার থেকে দক্ষিণ আফ্রিকার সঙ্গে বিমান যোগাযোগ স্থগিত করা হচ্ছে বলে জানিয়েছে দেশ দু’টির সরকার। যুক্তরাষ্ট্রের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, দক্ষিণ আফ্রিকা, বতসোয়ানা, জিম্বাবুয়ে, নামিবিয়া, লেসোথো, ইসোয়াতিনি ও মোজাম্বিক থেকে ফ্লাইট বন্ধ করা হবে। আগামী সোমবার থেকে কার্যকর হবে এ সিদ্ধান্ত। ভারত, জাপান, ইসরায়েল, তুরস্ক, সুইটজারল্যান্ড এবং সংযুক্ত আরব আমিরাতও কঠোর করেছে তাদের ভ্রমণ বিষয়ক বিধিনিষেধ।
এদিকে, ওমান, সংযুক্ত আরব আমিরাত ও মিসরও আফ্রিকার দক্ষিণাঞ্চলের ৭টি দেশের ওপর ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে। করোনাভাইরাসের নতুন ধরন ছড়ানোর আতঙ্কে সরাসরি আফ্রিকার এসব দেশ থেকে কেউ ভ্রমণ করতে পারবেন না। আগামীকাল ২৮ নভেম্বর থেকে জারি হচ্ছে এ নির্দেশনা। সরাসরি ফ্লাইটে ফিরতে পারবেন না যেসব দেশের নাগরিকরা সেগুলো হলোÑ দক্ষিণ আফ্রিকা, লেসোথো, বতসোয়ানা, জিম্বাবুয়ে, মোজাম্বিক, নামিবিয়া, ইসোয়াতিনি। তবে এসব দেশ থেকে পরোক্ষভাবে ট্রানজিট ভিসা ব্যবহার করে যেতে পারবেন ওমান, সংযুক্ত আরব আমিরাত ও মিসরে।
ডব্লিউএইচও’র জরুরি অবস্থা বিভাগের পরিচালক মাইক রায়ান দক্ষিণ আফ্রিকার সরকারি স্বাস্থ্য সংস্থার প্রশংসা করে বলেন, ‘যখন দক্ষিণ আফ্রিকার জীবাণুবিদরা প্রথম ওমিক্রনকে শনাক্ত করলেন, সে সময় দেশটিতে এই ধরনটিতে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা মাত্র ২২ জন। অত্যন্ত দ্রুততার সঙ্গে তারা এটিকে শনাক্ত করতে পেরেছেন এবং আমাদের অবহিত করেছেন। পাশপাশি রূপান্তরিত এই ধরনটির সম্পর্কে প্রাথমিক তথ্যও দিয়েছেন তারা।’