আলমগীর হোসেন :
কাউন্টারকেন্দ্রিক টিকেট কালোবাজারির অভিযোগ থাকায় এবারের ঈদে রেলের শতভাগ টিকেট অনলাইনে ছাড়া হয়েছিল। তবে তাতে কোনো লাভ হয়নি। কারণ যেখানে শর্ষের মধ্যে ভূত লুকিয়ে আছে, সেখানে এমনটা হওয়াই স্বাভাবিক।
রেলের অনলাইন টিকেটেও এবার কারও কারও ফোন নম্বর ও এনআইডি দিয়ে রেলওয়ের অ্যাপসের জন্য রেজিস্ট্রেশন করা আইডি ব্যবহার করে নিজেদের ইচ্ছামতো টিকেট হাতিয়ে নিয়েছে কালোবাজারি চক্র।
অথচ গোপন ওটিপি কোড পাওয়া ওই ব্যক্তিরা টিকেট কেনার জন্য রেলের অফিসিয়াল অ্যাপস ‘রেলসেবা’য় প্রবেশই করেননি। অর্থাৎ ‘রেলসেবা’ অ্যাপসে রেজিস্ট্রেশনকারী অনেকের আইডিতে হানা দিয়েই ট্রেনের অনলাইনের টিকেটে ভয়ংকর ‘ডাকাতি’ করেছে সংঘবদ্ধ ওই চক্র। এর ফলে ঈদে ঘুরমুখো বা কর্মস্থলে ফেরা মানুষ সার্ভার চালু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই অ্যাপসে ঢুকেও অধিকাংশ আসন ‘টিকেট শূন্য’ অবস্থায় দেখেছেন। অথচ যে ব্যক্তি টিকেট কাটার জন্য অ্যাপসেই প্রবেশ করেননি জালিয়াতি করে তার আইডি দিয়েই একাধিক টিকেট কেটেছে ‘অন্য কেউ’! এ কারণে অনেকের ফোনে রেলওয়ের নামে ‘ওটিপি’র গোপন কোডও আসে। এভাবে ‘সিস্টেম’ জালিয়াতি করে সূক্ষ্ম কায়দায় টিকেট ছিনতাইয়ের মাধ্যমে এবারে রেলের অনলাইন টিকেটেও চরম অরাজকতার শিকার হন রেলযাত্রীরা।
তথ্যপ্রযুক্তি বিশেষজ্ঞ ও ভুক্তভোগীদের আশঙ্কা, এভাবে টিকেট ব্যবস্থাপনার মতো বিভিন্ন সেক্টরে দায়িত্বে থাকা অসাধু কর্মকর্তা-কর্মচারীদের যোগসাজশে এনআইডি ও ফোন নম্বর হাতিয়ে নিয়ে ব্যাংক অ্যাকাউন্ট থেকে শুরু ডিজিটাল প্রযুক্তিনির্ভর মাধ্যমগুলোর নিয়ন্ত্রণ নিতে পারে জালিয়াতচক্র। এমন সূক্ষ্ম কায়দায় জালিয়াতির মাধ্যমে ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের মারাত্মক ক্ষতি করতে পারে তারা।
অভিযোগ রয়েছে, অনলাইন টিকেট ব্যব্যবস্থাপনার দায়িত্বে থাকা ‘সহজ ডটকম’র এক শ্রেণির কর্মকর্তা-কর্মচারীর যোগসাজশেই এ অপকর্ম করা হয়েছে। এর আগেও সহজের কিছু কর্মকর্তা-কর্মচারীর বিরুদ্ধে টিকেট কালোবাজারিতে জড়িত থাকার অভিযোগ ওঠে। যদিও রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ বলছে, এ বিষয়টি ইতিমধ্যেই অবগত হয়ে ‘সহজ ডটকমকে’ অভিযোগ খতিয়ে দেখতে বলা হয়েছে। প্রয়োজনে আইনগত পদক্ষেপ নেওয়া হবে।
যে প্রক্রিয়ায় অনলাইন টিকেট হাতিয়েছে কালোবাজারি চক্র : ১৫ এপ্রিল রাজশাহী রেলওয়ে স্টেশনে এ প্রতিবেদকের সঙ্গে সরাসরি কথা হয় রাজশাহীর সিনিয়র সাংবাদিক আনিসুজ্জামানের। তিক্ত অভিজ্ঞতার কথা জানিয়ে তিনি বলেন, গত ১৪ এপ্রিল তার ব্যক্তিগত মোবাইল ফোনে ০১৯৬৯-৯১৬৩১৮ নম্বর থেকে রেলওয়ের নামে ৮৮৩৮৩৪ সংখ্যার একটি ওটিপি কোড আসে। কিন্তু তিনি রেলের ওয়েবসাইটে বা অ্যাপসে কোনোভাবেই যুক্ত ছিলেন না। পরবর্তী সময়ে তিনি রেলওয়ে স্টেশনে গিয়ে এ বিষয়ে খোঁজখবর নিয়ে জানতে পারেন ‘অন্য কেউ’ তার আইডি ব্যবহার করে টিকেট কেটেছে। এদিন শফিকুল ইসলাম নামেও একজন ভুক্তভোগীর সঙ্গে কথা হয়। তার কাছেও একই নম্বর থেকে ওটিপি কোড আসে। তিনিও স্টেশনে খোঁজ নিয়ে জানতে পারেন তার ফোন নম্বর ও এনআইডি নম্বর দিয়ে কেউ একজন তিনটি টিকেট কেটে নিয়েছে। এ ছাড়া সেখানে অবস্থানকালে সেলিম নামে এক পরিবহন ব্যবসায়ীও শোনান একই রকম অভিজ্ঞতার কথা।
এদিকে গত মঙ্গলবার ঢাকায় এ প্রতিবেদকের সঙ্গে সরাসরি কথা হয় পুরান ঢাকার বাসিন্দা ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা মামুন হোসেনের সঙ্গে। তিনিও বলেন, উপর্যুক্ত ওই মোবাইল নম্বর থেকেই দুদিন আগে ৮০০৬৮৯ সংখ্যার ওটিপি কোড আসে তার মোবাইল ফোনে। তবে এ বিষয়ে তিনি আর কোনো খোঁজখবর নেননি। কিন্তু অ্যাপসে না ঢুকেও বা তিনি টিকেটের জন্য চেষ্টা না করেও কীভাবে ওটিপি কোড পেলেন সেটা নিয়ে রীতিমতো বিস্মিত তিনি। নিজের অন্যান্য প্রযুক্তিগত মাধ্যমগুলো নিয়েও ঝুঁকির শঙ্কা প্রকাশ করেন এই ভুক্তভোগী।
ঘটনা বিশ্লেষণে জানা যায়, যে ব্যক্তি কোনোভাবেই অ্যাপসে বা রেলওয়ের ওয়েবসাইটেও ঢোকেননি কিন্তু স্বয়ংক্রিয়ভাবে রেলওয়ে থেকে ‘ওটিপি’ কোড এসেছে তার মোবাইল ফোনে। অনেকেই বিষয়টিকে পাত্তা দেননি। আবার কেউ কেউ খোঁজখবর নিতে গিয়ে দেখেন তার নামে অন্তত দুই-তিনটি টিকেট কাটা হয়েছে। কিন্তু ডাউনলোড করার জন্য সেই টিকেটের কোনো কপি বা এ-সংক্রান্ত কোনো তথ্য পরবর্তী সময়ে সেই ব্যক্তির অ্যাপসে আসেনি। এখানেই মূলত হ্যাকার অথবা ‘সিস্টেম ম্যানেজমেন্টে’ সম্পৃক্তদের যোগসাজশে অন্য ব্যক্তির আইডিতে প্রবেশ করে অনলাইনে ট্রেনের টিকেট হাতিয়ে নেওয়া হয়েছে। পরে সেসব টিকেট কালোবাজারি চক্রের মাধ্যমেই বাইরে দ্বিগুণ-তিনগুণ দামে সাধারণ যাত্রীদের কাছে বিক্রি করা হয়েছে। এমন একাধিক অভিযোগের প্রমাণও সময়ের আলোর কাছে সংরক্ষিত আছে।
অ্যাপস বিশেষজ্ঞদের অভিমত : অ্যাপস তৈরিকারক প্রতিষ্ঠান ‘অরেঞ্জ বিডি’র পরিচালক ও চিফ ইনফরমেশন অফিসার (সিআইও) মো. শামীম হোসেন সময়ের আলোকে বলেন, একজনের রেজিস্ট্রেশন করা আইডি বা অ্যাপস ব্যবহার করে অন্য কেউ রেলের টিকেট কেটে নেওয়ার ঘটনা ঘটে থাকলে তা সাধারণত দুটি মাধ্যমে হতে পারে। একটি হচ্ছে-ম্যানেজমেন্টের (সহজ ডটকম) কেউ চক্রের সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়ে সার্ভার থেকে ‘অ্যাক্সেস’ দিয়ে এ অপকর্ম করতে সহায়তা করেছে। দ্বিতীয় কারণ হতে পারে, ‘সিস্টেম লেভেলে সিকিউরিটি’র দুর্বলতা। ‘সিস্টেম’ সুরক্ষিত থাকলে এটা হওয়ার কথা নয়। অর্থাৎ অনলাইন টিকেট ব্যবস্থাপনায় যারা সম্পৃক্ত তাদের যোগসাজশ কিংবা ‘সিকিউরিটি সিস্টেমে’র দুর্বলতা ছাড়া এমনটি ঘটানো সম্ভব নয়।
এমন ক্ষেত্রে যাত্রী বা গ্রাহকের ঝুঁকি প্রসঙ্গে এই অ্যাপস বিশেষজ্ঞ বলেন, ‘মারাত্মক ঝুঁকি থেকে যায়। কেননা যে ফোন নম্বর ও এনআইডি দিয়ে ব্যাংক অ্যাকাউন্ট থেকে শুরু করে ডিজিটাল মাধ্যমগুলো পরিচালিত হচ্ছে সেটা সম্পূর্ণভাবে বেহাত হতে পারে। হ্যাকার বা ওই চক্র চাইলে অনেক ধরনের ক্ষতি করতে পারবে।’
এ বিষয়ে যা বলছে কর্তৃপক্ষ
এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ রেলওয়ের মহাপরিচালক (অ.দা.) সরদার সাহাদাত আলী সময়ের আলোকে বলেন, ‘অনেকের ফোনে বিনা কারণে রেলওয়ের ওটিপি যাওয়ার খবর জেনেছি। এরপর বিষয়টি খতিয়ে দেখার জন্য অনলাইন টিকেট ব্যবস্থাপনার দায়িত্বে থাকা সহজ ডটকমকে বলা হয়েছে। তারা একটা মতামত দিলে পরবর্তী পদক্ষেপ নেওয়া হবে।’ অন্যের রেজিস্ট্রেশন করা আইডি ব্যবহার করে টিকেট হাতিয়ে নেওয়ার বিষয়ে রেল মহাপরিচালক বলেন, ‘এটা যদি হয়ে থাকে তা হলে সেটা গুরুতর অপরাধ। বিষয়টি আমরা দেখব। তাতে যেই জড়িত থাকুক, সেটা ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান হলেও আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে। এ ক্ষেত্রে তো ছাড় দেওয়ার সুযোগ নেই।’
এ বিষয়ে সহজ ডটকমের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) মালিহা এম কাদিরকে তার মোবাইল ফোন নম্বরে বেশ কয়েকবার কল করা হলেও তা বন্ধ পাওয়া যায়। পরবর্তী সময়ে সহজ ডটকমের জনসংযোগ বিভাগে যোগাযোগ করা হলে তাদেরও কোনো বক্তব্য পাওয়া যায়নি।
আইনশৃঙ্খলা বাহিনী যা বলছে : এ প্রসঙ্গে র্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন সময়ের আলোকে বলেন, ট্রেনের টিকেট কালোবাজারির বিষয়ে র্যাব সবসময়ে সোচ্চার ভূমিকা পালন করে থাকে। ইতিমধ্যেই চক্রের এমন অনেককে গ্রেফতার করা হয়েছে। অন্যের আইডি ব্যবহার করে অনলাইন সার্ভার থেকে টিকেট হাতিয়ে নেওয়ার অভিযোগ খতিয়ে দেখা হবে। এ রকম ক্ষেত্রে সাধারণত হ্যাকার বা টিকেট ব্যবস্থাপনায় সম্পৃক্তদের যোগসাজশ থেকে এ ধরনের ঘটনা হয়ে থাকতে পারে। তবে যারাই জড়িত থাকুক প্রমাণ পাওয়া গেলে অবশ্যই আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।