[ অনলাইন ] 20/04/2024 |
|
|
|
রাজস্ব আহরণ কেন এগোচ্ছে না |
|
|
উন্নয়ন কর্মসূচি বাস্তবায়নে বিদেশি ঋণের ওপর নির্ভরতা রয়েছে দীর্ঘদিন ধরেই। দিন দিন বিদেশি ঋণ পরিশোধের চাপ বাড়ছে। এমনকি ঋণ পরিশোধেও ফের ঋণ করতে বাধ্য হচ্ছে সরকার। অর্থনীতির বিশ্লেষকরা মনে করেন, উন্নয়নশীল দেশের কাতারে উন্নীত হওয়ার এই পর্যায়ে বাংলাদেশের যে উন্নয়ন ব্যয় তা খুব আহামরি নয়। মূলত, অভ্যন্তরীণ রাজস্ব আহরণ পর্যাপ্ত না হওয়ায় কারণেই এ টানাপোড়েন। বিশ্বব্যাংকের এক প্রতিবেদন বলছে, বাংলাদেশের রাজস্ব আহরণ সামর্থ্যের অর্ধেকেরও কম। রাজস্ব আহরণ কাঙ্ক্ষিত মাত্রায় না এগোনোর ফলে অবকাঠামো উন্নয়ন, মানবপুঁজি গঠন, সামাজিক নিরাপত্তা ব্যয় কিংবা অন্যান্য প্রয়োজনীয় উন্নয়নে পর্যাপ্ত অর্থের জোগান অনেক ক্ষেত্রেই সম্ভব হচ্ছে না।
কর-জিডিপি অনুপাতে হতাশাজনক চিত্র: মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) অনুপাতে রাজস্ব আহরণ হতাশাজনক। কর-জিডিপি অনুপাতের ক্ষেত্রে একেবারে পিছিয়ে থাকা দেশগুলোর সারিতে রয়েছে বাংলাদেশ। এমনকি দক্ষিণ এশিয়ার প্রতিবেশী দেশগুলোর তুলনায়ও বাংলাদেশ পিছিয়ে। জিডিপির অনুপাতে করের অংশ বাড়ানোর পরামর্শ দিয়ে আসছেন অর্থনীতিবিদ ও বিশেষজ্ঞরা। নীতিনির্ধারকরা এ নিয়ে আশাবাদী থাকেন। অথচ বাস্তবতা তার বিপরীত। গত এক দশকে কর-জিডিপি অনুপাত না বেড়ে বরং কমে এসেছে। ২০২৩ সালে জিডিপির অনুপাতে করের অংশ দাঁড়িয়েছে ৮ দশমিক ২ শতাংশ। এক দশক আগে ২০১২ সালে যা ছিল ৯ দশমিক ১ শতাংশ। অর্থাৎ, সাম্প্রতিক বছরগুলোতে প্রশংসনীয় অর্থনৈতিক উন্নয়ন সত্ত্বেও রাজস্ব আহরণে দুর্বলতা ঘোচেনি। ২০২২ সালের কর-জিডিপি অনুপাতের তুলনামূলক চিত্র বিশ্লেষণে দেখা যায়, বাংলাদেশে এ হার ছিল ৭ দশমিক ৭৭ শতাংশ। অন্যদিকে প্রতিবেশী দেশে ভারতে এ হার ১৬ দশমিক ৯৮ শতাংশ। এছাড়া এশিয়ার দেশ ইন্দোনেশিয়ায় ১১ দশমিক ৫৯, ভিয়েতনামে ১৪ দশমিক শূন্য ৩, থাইল্যান্ডে ১৫ দশমিক ৫৭ ও ফিলিপাইনে ১৫ দশমিক ৬১ শতাংশ।
এ প্রসঙ্গে অর্থ মন্ত্রণালয় প্রকাশিত মধ্যমেয়াদি সামষ্টিক অর্থনৈতিক নীতি বিবৃতিতে (২০২৩-২৪ থেকে ২০২৫-২৬) বলা হয়, বাংলাদেশের সঙ্গে এশিয়ার কয়েকটি দেশের কর-জিডিপির হারের তুলনামূলক বিশ্লেষণে দেখা যায়, বাংলাদেশের জিডিপি শতাংশে কর আহরণের পরিমাণ অন্যান্য দেশের তুলনায় বেশ কম। করের এ ধরনের তুলনামূলক বিশ্লেষণের ক্ষেত্রে প্রতিটি দেশের ভিন্ন ভিন্ন প্রেক্ষাপট বিবেচনায় নেওয়া প্রয়োজন। যেমন– কী কী কর রাজস্ব হিসেবে অন্তর্ভুক্ত হচ্ছে, কর কীভাবে সংজ্ঞায়িত হচ্ছে, আহরিত করের ধরন ইত্যাদি। যে প্রেক্ষাপটেই বিশ্লেষণ করা হোক না কেন বাংলাদেশে রাজস্ব আদায় যে অনেক কম তাতে কোনো সন্দেহ নেই। সরকার তাই রাজস্ব আদায় বাড়ানোর ওপর জোর দিচ্ছে।
রাজস্ব আহরণে প্রধান কিছু দুর্বলতা: কেন প্রত্যাশিত মাত্রায় রাজস্ব আহরণ বাড়ানো যাচ্ছে না, সে বিষয়ে বেশ কিছু কারণ উল্লেখ করা হয়েছে সম্প্রতি প্রকাশিত বিশ্বব্যাংকের বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট আপডেট প্রতিবেদনে। এসব কারণের মধ্যে রয়েছে–অর্থ পাচার, কর ফাঁকি এবং অবৈধ পুঁজি প্রবাহ, সনাতনী পদ্ধতির কর আহরণ পদ্ধতি, কর কর্মকর্তাদের প্রতি করদাতাদের আস্থার সংকট, করছাড় নীতি, নতুন ভ্যাট আইন বাস্তবায়নের চ্যালেঞ্জ ইত্যাদি। দেশি-বিদেশি বিশেষজ্ঞরা এসব বিষয় নিয়ে অনেক দিন ধরেই কথা বলছেন। সরকারি পর্যায়ের কিছু সুপারিশও বছরের পর বছর ঝুলছে। কাজের কাজ খুব একটা হচ্ছে না।
কর কর্মকর্তাদের প্রতি করদাতাদের আস্থার সংকট প্রসঙ্গে বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদনে বলা হয়, রাজস্ব আহরণ কর্তৃপক্ষের প্রতি আস্থার ঘাটতির কারণে ব্যক্তি এবং প্রাতিষ্ঠানিক করদাতারা নিরুৎসাহিত হন। রিটার্ন দাখিলে সম্পদের তথ্য ঘোষণার ক্ষেত্রে অনেকে হয়রানির শিকার হন। কর্মকর্তাদের অতিরিক্ত অনুসন্ধানের ভয়ে সৎ করদাতারাও আতঙ্কে থাকেন। অথচ কর ফাঁকিবাজদের সুযোগ দেওয়া হয়। বাজেটে কালো টাকা সাদা করার সুযোগ দেওয়ার কারণেও প্রকৃত করদাতারা নিরুৎসাহিত হন। এনবিআর কিংবা দুর্নীতি দমন কমিশনের পক্ষ থেকে এ নিয়ে কোনো প্রশ্ন তোলা হয় না। এ ধরনের নীতি সিদ্ধান্ত শেষ পর্যন্ত করদাতাদের ওপর প্রভাব ফেলে। এতে করদাতাদের আস্থার ঘাটতি বাড়তেই থাকে।
বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদনে বিদেশে অর্থ পাচারকে রাজস্ব আহরণে দুর্বলতার অন্যতম বড় কারণ হিসেবে তুলে ধরা হয়েছে। এ প্রসঙ্গে ট্যাক্স জাস্টিস রিপোর্ট-২০২০ এর বরাত দিয়ে বলা হয়, বাংলাদেশ থেকে বছরে যে পরিমাণ অর্থ পাচার হয় তার পরিমাণ জিডিপির শূন্য দশমিক ৭ শতাংশ। করপোরেট কর ফাঁকিসহ পাচারের কারণে ২০২০ সালে প্রায় ৭০ কোটি ডলার কম রাজস্ব পেয়েছে সরকার, যা ওই বছরের মোট রাজস্বের ২ দশমিক ২ শতাংশ। বাংলাদেশের সমমানের অর্থনীতির দেশগুলোর মধ্যে যা সবচেয়ে বেশি। ২০২১ সালের গ্লোবাল ফিন্যান্সিয়াল ইন্টিগ্রিটি প্রতিবেদনে বলা হয়, বাংলাদেশ থেকে অর্থ পাচারের ঘটনার বেশির ভাগই আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্যে আন্ডার ইনভয়েসিং কিংবা ওভার ইনভয়েসিংয়ের মাধ্যমে হয়। ওই প্রতিবেদন অনুযায়ী, প্রতিবছর বাংলাদেশ থেকে এ ধরনের বাণিজ্যিক ফাঁকফোকরে বছরে ৩ দশমিক ৬ বিলিয়ন ডলার পাচার হয়ে যায়।
ব্যক্তি পর্যায়ে বাড়তি রাজস্ব আহরণের সম্ভাবনা: সম্প্রতি বেসরকারি গবেষণা সংস্থা পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) এক গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়, আয়করযোগ্য হলেও অনেক মানুষ নিয়মিত কর দেন না। রাজস্ব বাড়াতে আয়কর আদায়ে আরও গুরুত্ব দিতে হবে। ব্যক্তি পর্যায় থেকে রাজস্ব আদায় বছরে আরও ৬৫ হাজার কোটি টাকা বাড়ানো সম্ভব। এ ক্ষেত্রে স্বল্পমেয়াদি কিছু পদক্ষেপ নেওয়া যেতে পারে। এই অর্থ আদায় করা গেলে আইএমএফের শর্ত অনুসারে কর-জিডিপি অনুপাত দশমিক ৫ শতাংশ বাড়ানো সম্ভব হবে। প্রতিবেদনে বলা হয়, বিভিন্ন খাতে দেওয়া করছাড় কমিয়ে আনা হলে আগামী অর্থবছরেই অতিরিক্ত ৩০ হাজার কোটি টাকা রাজস্ব আয় করা সম্ভব। স্বল্পমেয়াদে এই বাড়তি অর্থ আদায়ের পাশাপাশি কর কাঠামোতে সংস্কার অব্যাহত রাখতে হবে। বাড়তি রাজস্ব আদায় সংস্কার কর্মসূচি বাস্তবায়ন দরকার। একই সঙ্গে কর প্রশাসনে দুর্নীতি কমানো, অটোমেশন, অপ্রয়োজনীয় করছাড় তুলে নেওয়া ও ২০১২ সালের মূল ভ্যাট আইনে ফিরে যাওয়া প্রয়োজন। ওই আইনে ভ্যাট ১৫ শতাংশ রাখার কথা বলা হয়েছে। কর প্রশাসন দুর্নীতিমুক্ত করা, কর আদায় ব্যবস্থা অটোমেটেড বা স্বয়ংক্রিয় করাসহ বিভিন্ন সংস্কারে হাত দেওয়ার এখনই উপযুক্ত সময়। নতুন সরকারের প্রথম দুই-তিন বছরই সাহসী সংস্কার করা সম্ভব।
আইএমএফের শর্ত পূরণে রাজস্ব আহরণে বড় লক্ষ্য: চলতি অর্থবছরের সংশোধিত বাজেটে সরকারি ব্যয়ে বড় কাটছাঁট করা হলেও রাজস্ব আহরণের লক্ষ্যমাত্রা খুব বেশি কমানো হয়নি। কারণ আইএমএফের কাছে দেওয়া প্রতিশ্রুতি অনুসারে কর-জিডিপি অনুপাত শূন্য দশমিক ৫ শতাংশ বাড়াতে হবে। এর সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে মূল বাজেটের চেয়ে মাত্র ২০ হাজার কোটি টাকা কমিয়ে এনবিআরের সংশোধিত লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ৪ লাখ ১০ হাজার কোটি টাকা। এ ছাড়া এনবিআর-বহির্ভূত কর এবং কর ছাড়া রাজস্বের লক্ষ্যমাত্রা ৭০ হাজার কোটি থেকে কমিয়ে ৬০ হাজার কোটি টাকা করা হয়েছে। সব মিলিয়ে সরকারের সার্বিক রাজস্ব আদায় ৫ লাখ কোটি টাকা থেকে কমিয়ে ৪ লাখ ৭০ হাজার কোটি টাকা করা হয়েছে।
সংস্কারের উপযুক্ত সময়: রাজস্ব খাতে সংস্কার আনার এখনই উপযুক্ত সময় বলে মত দিচ্ছেন অর্থনীতিবিদরা। পিআরআইএর নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুরও তাই মনে করেন। তাঁর মতে, কর প্রশাসন দুর্নীতিমুক্ত করা, কর আদায় ব্যবস্থা অটোমেটেড বা স্বয়ংক্রিয় করাসহ বিভিন্ন সংস্কারে হাত দেওয়ার এখনই উপযুক্ত সময়। সমকালকে তিনি বলেন, নতুন সরকার এসেছে। এখন রাজস্ব খাত সংস্কারের সময়। বিড়ালের গলায় ঘণ্টা বাঁধার সময় এখনই। সামনে বাজেট আসছে। আগামী বাজেটে সংস্কারের প্রতিফলন থাকা উচিত। তিনি আরও বলেন, সম্প্রতি আইএমএফের একটি দল বাংলাদেশ ঘুরে গেছে। তারা বলেছে, কোথায় কীভাবে করছাড় কমাতে হবে। কিছু পদক্ষেপ আগামী বাজেটে নেওয়ার পরামর্শ দিয়েছে আইএমএফ। আহসান এইচ মনসুরের মতে, শুধু করছাড় কমিয়ে আগামী অর্থবছরে বাড়তি ৩০ হাজার কোটি টাকা আদায়ের উদ্যোগ নেওয়া যেতে পারে। করছাড় না কমিয়ে কর-জিডিপি অনুপাত ১৫ শতাংশে উন্নীত করা সম্ভব নয়। ব্রিটিশ আমলের ব্যবস্থাপনা দিয়ে তা হবে না। এ জন্য রাজস্ব খাতের মৌলিক সংস্কার লাগবে। কাঙ্ক্ষিত হারে কর-জিডিপি অনুপাত বাড়াতে আগামী তিন বছরে রাজস্ব খাতেও বড় ধরনের সংস্কার প্রয়োজন।
রাজস্ব আহরণে গতি বাড়াতে সম্প্রতি বিশ্বব্যাংকের পক্ষ থেকে বেশ কিছু সুপারিশ করা হয়। সংস্থাটির প্রতিবেদনে বলা হয়, করদাতাদের সংখ্যা বাড়ানোর দিকে অগ্রাধিকার দিতে হবে। সনাতনী পদ্ধতির জটিলতা এগিয়ে প্রণোদনামূলক ব্যবস্থার দিকে যেতে হবে। কর কাঠামোকে পুরোপুরি অটোমেটেড করা দরকার। এ ধরনের ব্যবস্থায় কর পরিশোধ সহজ হবে এবং সেই সঙ্গে কর ফাঁকি ও কর আহরণে দুর্নীতির সুযোগও বন্ধ হবে। নিবন্ধিত করদাতারা কর না দিলে তা খুব সহজে শনাক্ত করা যাবে। কমে আসবে কর কম দেওয়া কিংবা ফাঁকির সুযোগ। করের পরিমাণ নির্ধারণ এবং পরিশোধ প্রক্রিয়াও সহজ হবে। সহজ হবে একইভাবে ভ্যাট আদায় কার্যক্রমও। এ ছাড়া কর কাঠামোতে শুল্ক কাঠামো যৌক্তিক হারে নির্ধারণের সুপারিশ করেছে বিশ্বব্যাংক। প্রতিবেদনে বলা হয়, কোনো কোনো পণ্য আমদানিতে উচ্চ হারে শুল্ক আরোপ রয়েছে এখন। স্থানীয় শিল্পকে সুরক্ষা দেওয়ার এ নীতির কারণে রপ্তানি নিরুৎসাহিত হচ্ছে। গড় আমদানি শুল্ক এখন ১৮ দশমিক ৮ শতাংশ, যা সমপর্যায়ের অর্থনীতির দেশগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি। |
News Source
|
|
|
|
|
|
|
|
Today's Other News
|
Related Stories |
|
|
|
|