উচ্চ মূল্যস্ফীতির লাগাম টানতে গত বছর যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল রিজার্ভসহ অনেক দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক সুদের হার বাড়ানো শুরু করে। ধারাবাহিকভাবে সুদহার বাড়ানোর কারণে অর্থনৈতিক কার্যক্রম সংকুচিত হয়ে প্রবৃদ্ধির ওপর আঘাত আনতে পারে– এমন একটা আলোচনা ছিল। তবে আশ্চর্যজনকভাবে বিশ্ব অর্থনীতিতে প্রবৃদ্ধির ধারাবাহিকতা রয়েছে। ২০২৩ সালের মতো পরের দুই বছরেও মোটামুটি ভালো অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি হতে পারে বলে মনে করছে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল-আইএমএফ।
আইএমএফ সম্প্রতি ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক আউটলুক প্রকাশ করেছে। সংস্থার ফ্ল্যাগশিপ প্রতিবেদনটি মূলত বিশ্ব অর্থনীতির গতি-প্রকৃতি নিয়ে বিশ্লেষণ করে। আইএমএফ বলেছে, ২০২২ সালে বিশ্ব অর্থনীতিতে প্রবৃদ্ধি ছিল ২ দশমিক ৩ শতাংশ। ২০২৩ সালে তা বেড়ে হয়েছে ৩ দশমিক ২ শতাংশ। ২০২৪ এবং ২০২৫ সালে একই হারে প্রবৃদ্ধি হওয়ার প্রক্ষেপণ রয়েছে। উন্নত দেশগুলোতে গড়ে ২০২৩ সালে ১ দশমিক ৬ শতাংশ অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি হয়েছে। ২০২৪ এবং ২০২৫ সালে তা বেড়ে ১ দশমিক ৭ শতাংশ এবং ১ দশমিক ৮ শতাংশ হতে পারে। অবশ্য উদীয়মান এবং উন্নয়নশীল দেশগুলোতে প্রবৃদ্ধি কিছুটা কমতে পারে। ২০২৩ সালে এসব দেশে গড়ে ৪ দশমিক ৩ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হয়েছে। ২০২৪ এবং ২০২৫ সালে তা কমে ৪ দশমিক ২ শতাংশে দাঁড়াতে পারে।
আইএমএফ প্রবৃদ্ধি টেকসই থাকার পাশাপাশি মূল্যস্ফীতি কমে আসারও প্রক্ষেপণ করেছে। তবে ভূরাজনৈতিক উত্তেজনা এবং অন্যান্য কারণে মূল্যস্ফীতি কমে আসার প্রবণতা নাও টিকতে পারে। নতুন করে মূল্যস্ফীতির ঝুঁকিও রয়েছে।
২০১৯ সালের শেষের দিকে করোনাভাইরাস সংক্রমণের পর ২০২০ এবং ২০২১ সালে বিশ্ব অর্থনীতিতে এর ব্যাপক নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। বিশ্বজুড়ে পণ্য এবং সেবার সরবরাহ চেইন চরমভাবে বাধাগ্রস্ত হয়। মূল্যস্ফীতি অনেক বেড়ে যায়। ২০২২ সালে ৯ শতাংশে উঠে যায়। বিশ্বের কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলো তখন সুদের হার বাড়াতে শুরু করে। আর্থিক এবং মুদ্রানীতি সংকোচনের মাধ্যমে চাহিদা দমিয়ে রাখার নীতি নেয় বেশির ভাগ দেশ। ২০২৩ সালে মূল্যস্ফীতি ৬ দশমিক ৬ শতাংশে নেমেছে। ২০২৪ সালে তা ৫ দশমিক ৯ শতাংশ এবং ২০২৫ সালে ৪ দশমিক ৫ শতাংশে নামতে পারে বলে প্রক্ষেপণ করেছে আইএমএফ।
আইএমএফ গত অক্টেবরে বিশ্ব অর্থনীতিতে ২০২৪ সালের প্রবৃদ্ধি নিয়ে যে প্রক্ষেপণ করেছে, এপ্রিলে এসে তা বাড়িয়েছে। প্রবৃদ্ধির বিষয়ে যে প্রক্ষেপণ করেছে, তার পেছনে কিছু যুক্তি দিয়েছে। অন্যতম কারণ হলো সরবরাহ চেইনের উন্নতি হয়েছে। এ ছাড়া জ্বালানির মূল্য কমেছে। যুক্তরাষ্ট্রসহ বিভিন্ন দেশে শ্রম সরবরাহ বেড়েছে অর্থাৎ কর্মসংস্থান পরিস্থিতির উন্নতি হয়েছে। কিছু উন্নত দেশে অভিবাসন বেড়েছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতি ইতোমধ্যে অতিমারির আগের অবস্থায় ফিরেছে। তবে নিম্ন আয়ের অনেক দেশের অর্থনীতি নিয়ে উদ্বেগ রয়েছে। এর প্রধান কারণ, এসব দেশের জীবনযাত্রার ব্যয় অনেক বেড়ে গেছে।
আইএমএফ বলেছে, গত কয়েক বছরে একটা উল্লেখযোগ্য অর্জন হলো– মুদ্রা, রাজস্ব এবং আর্থিক নীতি কাঠামো শক্তিশালী হয়েছে। এর ফলে বৈশ্বিক আর্থিক ব্যবস্থা অধিকতর টেকসই হয়েছে। একই সঙ্গে মূল্যস্ফীতির ঊর্ধ্বমুখী প্রবণতা রোধ করে তা কমে আসার দিকে রয়েছে। এই অর্জন ধরে রাখা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। মূল্যস্ফীতি মূলত কমেছে জ্বালানির দাম আগের চেয়ে কমে আসার কারণে। জ্বালানিবহির্ভূত পণ্যের দামও কমেছে। এ ছাড়া চীনের রপ্তানি পণ্যের দাম কমাও মূল্যস্ফীতি হ্রাসে ভূমিকা রেখেছে। তবে ভূরাজনৈতিক উত্তেজনার কারণে সম্প্রতি জ্বালানি তেলের দাম বৃদ্ধির প্রবণতা রয়েছে। সেবা খাতে এখনও উচ্চ মূল্যস্ফীতি রয়েছে। চীনের পণ্যের ওপর নতুন করে কোনো বিধিনিষেধ আরোপ হলে মূল্যস্ফীতি বেড়ে যাওয়ার শঙ্কা রয়েছে।
বিশ্ব অর্থনীতির আগামীর ঝুঁকি সম্পর্কে আইএমএফের মত হচ্ছে, ঝুঁকি সামগ্রিকভাবে ভারসাম্যমূলক। ভূরাজনৈতিক উত্তেজনার ঝুঁকিকে বড় করে দেখেছে সংস্থাটি। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ভূরাজনৈতিক উত্তেজনার কারণে নতুন করে মূল্যস্ফীতি বাড়তে পারে। আর্থিক সমন্বয়ের ক্ষেত্রে বিশৃঙ্খলা তৈরি হলে অর্থনৈতিক কার্যক্রমে গতি কমে যেতে পারে। তবে মূল্যস্ফীতি দ্রুত কমলে এবং সময়মতো কাঠামোগত সংস্কার হলে উৎপাদনশীলতা বাড়বে এবং বিশ্ব অর্থনীতির প্রবৃদ্ধিকে ত্বরান্বিত করবে।