কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের সার্টিফিকেট জালিয়াতির সাথে জড়িতদের তালিকা দীর্ঘ হচ্ছে। শুধু কারিগরি শিক্ষা বোর্ড নয়, এই জালিয়াতিতে উঠে আসছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) ও শিক্ষা মন্ত্রণালয়সহ সরকারের অন্য প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা-কর্মচারীর নামও। জাল সার্টিফিকেট দিয়ে সরকারী পদে চাকরি নেয়ার তথ্যও পেয়েছে তদন্ত সংশ্লিষ্ট ডিবির কর্মকর্তারা। অনেকটাই কেঁচো খুঁড়তে বেরিয়ে আসছে সাপ। কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের সদ্য সাবেক চেয়ারম্যান মো. আলী আকবরের স্ত্রী মোছা. সেহেলা পারভীন ও কম্পিউটার সেলের সিস্টেম অ্যানালিস্ট এ কে এম শামসুজ্জামানসহ গ্রেফতারকৃত বেশ কয়েকজনকে জিজ্ঞাসবাদে এমন তথ্য পেয়েছেন গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) কর্মকর্তারা।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে তদন্তের সাথে জড়িত ডিবির একজন এএসপি ইনকিলাবকে বলেন, যারা গ্রেফতার হয়েছে তাদের পাশাপাশি সার্টিফিকেট জালিয়াতির সঙ্গে আরও বেশ কয়েকজন রাঘববোয়াল জড়িত। তাদের তালিকাও করা হচ্ছে। দ্রুত আইনের আওতায় আনা হবে। দুদক কর্মকর্তা, বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের পরিচালকসহ আরও কমপক্ষে ৩০ জন এই সার্টিফিকেট জালিয়াতির সঙ্গে জড়িত থাকার তথ্য পেয়েছে ডিবি। তাদের বিষয়ে তথ্য যাচাই-বাছাই করে তালিকা তৈরির কাজ চলছে। নরসিংদী, ময়মনসিংহ, খুলনা, দিনাজপুর, গাজীপুর, ঢাকা ও কিশোরগঞ্জসহ দেশের বিভিন্ন এলাকার দালাল ও বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের পরিচালকরা যোগাযোগ করতো এ চক্রের সাথে।
জানা যায়, সার্টিফিকেট জালিয়াতির সঙ্গে কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের আরও তিন কর্মকর্তার নাম পাওয়া গেছে। তারা হলেন- কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের সিবিএ নেতা আব্দুল বাছের, রেজিস্ট্রেশন শাখার অ্যাসিস্ট্যান্ট প্রোগ্রামার মামুনুর রশীদ ও বোর্ডের উপ-পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক জাকারিয়া আব্বাস। তারা বিভিন্ন সময় বোর্ডের কম্পিউটার সেলের সিস্টেম অ্যানালিস্ট একেএম শামসুজ্জামানকে শিক্ষার্থীদের রেজাল্ট পরিবর্তন ও জাল সার্টিফিকেট তৈরি করার কথা বলতেন। তাদের দাবি অনুযায়ী, এ কে এম শামসুজ্জামান সার্টিফিকেট তৈরি ও রেজাল্ট পরিবর্তন করে দিতেন। তবে এজন্য তারা শামসুজ্জামানকে কোনো টাকা দিতেন না। একই বোর্ডের লোক হওয়ায় শামসুজ্জামান তাদের কাছে টাকা চাইতে সাহসও পেতেন না।
তদন্ত সূত্রে জানা যায়, শামসুজ্জামানের সার্টিফিকেট দুর্নীতি সংক্রান্ত একটি মামলা হয় দুদকে। দুদকের উপ-পরিচালক পদমর্যাদার এক কর্মকর্তা মামলার তদন্তের জন্য শামসুজ্জামানকে ডাকেন। এরপর থেকে দুদকের ওই কর্মকর্তাকে বিভিন্নভাবে ম্যানেজ করার চেষ্টা করেন শামসুজ্জামান। কিন্তু সেই কর্মকর্তাকে ম্যানেজ না করতে পেরে দুদকের উপ-পরিচালক পদমর্যাদার আরেক কর্মকর্তার দারস্থ হন।
সেই কর্মকর্তা শামসুজ্জামানকে তার বাড্ডার বাসায় ডেকে নেন। ওই কর্মকর্তা শামসুজ্জামানকে বলেন, এখন যে কর্মকর্তার কাছে মামলার তদন্ত আছে তাকে ম্যানেজ করা যাবে না। তাই মামলার তদন্ত কর্মকর্তা পরিবর্তন করতে হবে, এজন্য দুদকের এই কর্মকর্তাকে ৩০ লাখ দিতে হবে শামসুজ্জামানকে। শামসুজ্জামান ওই কর্মকর্তার দাবি অনুযায়ী ৩০ লাখ টাকার ডলার কিনে তাকে দেন। পরে মামলার তদন্ত কর্মকর্তা পরিবর্তন হয়। আরও জানা যায়, নতুন তদন্ত কর্মকর্তাও দুদকের উপ-পরিচালক পদমর্যাদার আরেকজন কর্মকর্তা। তিনি প্রায় ১০ লাখ টাকার ওপরে শামসুজ্জামানের কাছ থেকে নিয়ে তাকে দুদকের মামলা থেকে অব্যাহতি দেন। ডিবি সূত্রে জানা গেছে, রিমান্ডে শামসুজ্জামান ডিবির কর্মকর্তাদের বলেছেন, কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের সার্টিফিকেট কাগজ প্রতি বান্ডেলে ৫০০টি করে থাকে। বান্ডেলে করা এসব কাগজ শামসুজ্জামান শিক্ষা বোর্ডের অফিস থেকে সংগ্রহ করতেন। তবে তার কাছে জাল সার্টিফিকেট তৈরির এত চাহিদা থাকতো যে বোর্ড অফিসের কাগজ পর্যাপ্ত হতো না। কাগজের জোগান ঠিক রাখতে রাজধানীর পুরান ঢাকা ও রংপুরের একটি প্রেসের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। তাদের আসল কাগজের নমুনা দেখানোর পর তারা হুবহু সার্টিফিকেটের কাগজ তৈরি করে দিতেন শামসুজ্জামানকে।
জিজ্ঞাসাবাদে শামসুজ্জামান জানান, তিনি ২০১৪ থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত সার্টিফিকেট তৈরির কাজ শেখেন। মোহাম্মদ শামসুল আলম নামে কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের সিস্টেম অ্যানালিস্টের কাছ থেকে এই জালিয়াতি শেখেন। শামসুল আলম বিভিন্ন সময় ডিপ্লোমা পরীক্ষার সার্টিফিকেট জালিয়াতি করতেন। শিক্ষার্থীদের কাছে জাল সার্টিফিকেটও বিক্রি করতেন তিনি। ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের পরীক্ষায় যেসব শিক্ষার্থী পাস করতে পারতো না তাদের নম্বর বাড়িয়ে দিয়ে পাস করিয়ে দিতেন শামসুল। তার কাছ থেকে শিখে শামসুজ্জামান এসএসসি ও ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের পরীক্ষার্থীদের জাল সার্টিফিকেট বানানোসহ পরীক্ষা প্রাপ্ত নম্বর বাড়িয়ে দিতেন।
ডিবি সূত্রে জানা যায়, শিক্ষার্থীরা প্রথমে দালালের সঙ্গে যোগাযোগ করতো। পরে দালালরা শামসুজ্জামানের সঙ্গে যোগাযোগ করত। পরে সেই অনুযায়ী শামসুজ্জামান জাল সার্টিফিকেট বানাতেন। জাল সার্টিফিকেটপ্রতি ৩০ হাজার থেকে শুরু করে ৫০ হাজার টাকা পর্যন্ত নিতেন তিনি। এছাড়া বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের পরিচালকরাও যোগাযোগ করতেন তার সঙ্গে। পরিচালকরা সার্টিফিকেটপ্রতি ৩০-৫০ হাজার টাকা দিলেও তারা শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে আরও মোটা অংকের টাকা নিতেন। প্রায় ৩০ জনের মতো দালাল ও পরিচালকের সঙ্গে যোগাযোগ রয়েছে শামসুজ্জামানের। ডিএমপির অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার (ডিবি) হারুন অর রশীদ বলেন, কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের সাবেক চেয়ারম্যান আলী আকবর খানকে ওএসডি করা হয়েছে। তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে। এ ঘটনায় যারা জড়িত তাদের তালিকা করা হচ্ছে। যারাই এর সঙ্গে জড়িত তাদের দ্রুতই গ্রেফতার করা হবে।