[ পাতা ১ ] 29/04/2024 |
|
|
|
মিথ্যার ‘ফুলঝুরিতে’ অপকর্ম ঢাকার চেষ্টা মিল্টন সমাদ্দারের |
|
গণমাধ্যমে একেক সময় একেক বক্তব্য |
‘চাইল্ড অ্যান্ড ওল্ড এইজ কেয়ার’ নামক বৃদ্ধাশ্রমের আড়ালে মিল্টন সমাদ্দারের নানা অপকর্ম নিয়ে সংবাদ প্রকাশ করে কালবেলা, যা দেশব্যাপী ব্যাপকভাবে আলোচিত হয়। এরপর আরও কয়েকটি গণমাধ্যমে মিল্টনকে নিয়ে সংবাদ প্রকাশিত হয়। শুরু থেকেই একটি ফেসবুক পেজে আলোচনা এবং কয়েকটি গণমাধ্যমে সাক্ষাৎকার দিয়ে তার বিরুদ্ধে ওঠা সব অভিযোগ অস্বীকার করেন মিল্টন সমাদ্দার। নিজের পক্ষে কিছু তথ্যপ্রমাণ ও যুক্তিও তুলে ধরেন। মিল্টন সমাদ্দারের দাবি এবং উপস্থাপিত তথ্যপ্রমাণ অত্যন্ত গুরুত্ব সহকারে নিয়ে বিশ্লেষণ করা হয়। তাতে দেখা যায়, মিল্টনের দেওয়া তথ্যের বেশিরভাগই মিথ্যা।
কালবেলার প্রকাশিত সংবাদে চাইল্ড অ্যান্ড ওল্ড এইজ কেয়ারের উদ্যোগে দাফন করা মরদেহের হিসাবে গরমিলের বিষয়টি তুলে ধরা হয়েছিল। মিল্টন সমাদ্দার ৯০০ মরদেহ দাফনের দাবি করলেও ঢাকার তিনটি সরকারি কবরস্থান ঘুরে মাত্র ৬৫টি মরদেহের তথ্য পায়
কালবেলা। বাকি মরদেহ দাফনের কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি। এর পরিপ্রেক্ষিতে মিল্টন সমাদ্দার দাবি করেন, বেওয়ারিশ মরদেহ কবরস্থানে দাফন করা যায় না। তিনি কবরস্থান কর্তৃপক্ষকে মরদেহপ্রতি ১৬ হাজার টাকা করে ঘুষ দিয়ে দাফন করেছেন।
তবে ঘুষ দেওয়ার দাবি নাকচ করে মিরপুর বুদ্ধীজীবী এবং রায়েরবাজার কবরস্থানের দায়িত্বরতরা জানিয়েছেন ভিন্ন কথা। রায়েরবাজার বুদ্ধিজীবী কবরস্থানের প্রধান গোরখোদক গোলাম রাব্বানী কালবেলাকে বলেন, ‘সরকারি কবরস্থান সবার জন্য উন্মুক্ত। এখানে সরকারি ফি ৫০০ টাকা। এর বাইরে মরদেহ দাফনে কোনো টাকা লাগে না। যারা কবর খোঁড়ে, তাদের অনেকে খুশি হয়ে ২০০-১০০ টাকা দেন, সেটা ভিন্ন বিষয়।’
দাফনকৃত মরদেহের ডেথ সার্টিফিকেট বিশ্লেষণ করেও এই বক্তব্যের সত্যতা পাওয়া যায়। গত বছরের ১৫ জুলাই মিরপুর কবরস্থানে একটি বেওয়ারিশ মরদেহ দাফন করেন মিল্টন সমাদ্দার। ওই মরদেহের ডেথ সার্টিফিকেটে লেখা ছিল ‘আননোন’। আবার গত বছরের ৮ সেপ্টেম্বর লতা বেগম নামের এক নারীর মরদেহ দাফন করা হয়েছে এনআইডি নম্বর ছাড়া। এ ছাড়া গত ১১ জানুয়ারি আতিয়ার রহমান নামে আরও এক ব্যক্তির মরদেহ দাফন করা হয়। সেই ডেথ সার্টিফিকেটে মৃত ব্যক্তির এনআইডি নম্বর লেখা ছিল না।
জানতে চাইলে মিরপুর বুদ্ধিজীবী কবরস্থানের ইনচার্জ ছানোয়ার হোসেন কালবেলাকে বলেন, ‘উনি (মিল্টন সমাদ্দার) উনার প্রতিষ্ঠানের নামে সার্টিফিকেট দেওয়ার পরই আমরা দাফন করেছি। উনার প্রতিষ্ঠান থেকে ডেথ সার্টিফিকেট দিয়ে লিখিত দায়িত্ব নেওয়া হয়েছে। এখানে ঘুষের কোনো বিষয় নেই।’
এ ছাড়া মিল্টন সমাদ্দার একটি ফেসবুক পেজের মাধ্যমে দাবি করেছেন, তার সব অ্যাকাউন্ট চাইল্ড অ্যান্ড ওল্ড এইজ কেয়ারের নামে। তবে কালবেলার অনুসন্ধানে পাওয়া তথ্যে দেখা যায়, সিটি ব্যাংকে মিল্টন সমাদ্দারের একটি ব্যক্তিগত অ্যাকাউন্ট নম্বর রয়েছে (২৮০১৬১৭১৩৭০০১)। বিভিন্ন সময়ে তার ফেসবুক আইডিতে এই অ্যাকাউন্টটি পোস্ট করে সাহায্য সংগ্রহ করা হয়েছে। প্রবাসীদের অনেকেই এই অ্যাকাউন্টের মাধ্যমে বৃদ্ধাশ্রমের জন্য সহায়তা পাঠিয়েছেন। সেসব লেনদেনের প্রমাণও কালবেলার কাছে রয়েছে।
মিল্টন সমাদ্দার তার আশ্রমে তিন শতাধিক মানুষ রয়েছেন দাবি করলেও কালবেলার অনুসন্ধানে সেটির প্রমাণ পাওয়া যায়নি। সংবাদ প্রকাশের পরও একই দাবি করে সাভারের আশ্রম থেকে লাইভ ভিডিও প্রচার করেন মিল্টন। সেই লাইভেও সব মিলিয়ে ৫০ জনের বেশি মানুষকে দেখা যায়নি।
মিল্টন সমাদ্দারের আশ্রমে মাত্র ১০ বছরে ৯০০ মানুষের মৃত্যুর বিষয়টি ‘অস্বাভাবিক’ বলে কালবেলার প্রতিবেদনে বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশনের (বিএমএ) সাবেক সভাপতি অধ্যাপক ডা. রশিদ ই মাহাবুবের বক্তব্য ছিল। সেখানে তিনি বলেছিলেন, ‘এত মানুষ মারা যাওয়া অস্বাভাবিক। তার মানে উনার এখানে প্রোপার চিকিৎসা ব্যবস্থা নেই। তা ছাড়া উনি কতজনকে হাসপাতালে রেফার করেছেন, সেটাও খতিয়ে দেখতে হবে। উনার এখানে তো সবাই মারা যেতে পারে না। কেউ বেশি অসুস্থ হলে তাকে হাসপাতালে পাঠাতে হবে, চিকিৎসা করাতে হবে।’
পরে মিল্টন সমাদ্দার একটি গণমাধ্যমে স্বীকার করেন, তার আশ্রমে কেউ অসুস্থ হলে তাকে তিনি হাসপাতালে নেন না। চিকিৎসাও করানো হয় না। শুধু পরিচর্যা করেন। ফলে তারা চিকিৎসার অভাবে মারা যান।
তহবিলে কোটি টাকার বেশি থাকার পরও আশ্রমে বিনা চিকিৎসায় মানুষের মৃত্যু মানবাধিকারের চরম লঙ্ঘন বলে মন্তব্য করেছেন জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান ড. কামাল উদ্দিন আহমেদ। তিনি কালবেলাকে বলেন, ‘তার মতো নৃশংস ও ন্যক্কারজনক লোক আমাদের সমাজে খুব কম আছে। তিনি নৃশংসতার চরম পর্যায়ে নেমে গেছেন। টাকা উপার্জনের জন্য মানুষ এত নিচে নামতে পারে, তা আমার কল্পনায়ও ছিল না। আমরা বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্ব সহকারে দেখছি। সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোকে তদন্ত করে প্রতিবেদন দিতে বলেছি। আমরা শেষ পর্যন্ত লেগে থাকব। যাতে এই লোকের কঠিন শাস্তি হয়, যা দেখে সমাজের অন্য কেউ এই ধরনের ধৃষ্টতা দেখানোর সাহস না পায়।’
কেউ অসুস্থ হলে চিকিৎসা না করানো অপরাধ এবং এটি তার খারাপ উদ্দেশ্যের বহিঃপ্রকাশ বলে মনে করেন বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী রাশেদা চৌধুরী নিলু।
মরদেহের শরীরে কাটাছেঁড়ার বিষয়ে মিল্টন সমাদ্দার একটি ভিডিওতে বলেছেন, ‘কালবেলায় প্রকাশিত কাটাছেঁড়ার বিষয়টি মিথ্যা ও ভিত্তিহীন।’
আবার আরেকটি ভিডিওতে তিনি বলেছেন, ‘রাস্তা থেকে তুলে আনা মানুষের শরীরে কাটাছেঁড়া থাকতেই পারে।’
এ ছাড়া মিল্টন সমাদ্দার একটি ফেসবুকে পেজের আলোচনায় দাবি করেছেন, ‘ঈদের দিন সন্ধ্যায় তার সঙ্গে রাজধানীর শ্যামলীতে কয়েকজন সাংবাদিকের বাগবিতণ্ডা হয়। তার জেরেই সাংবাদিকরা কোনো অনুসন্ধান না করে তার নামে মিথ্যা সংবাদ প্রকাশ করেছেন।’
আবার একটি গণমাধ্যমে তিনি বলেন, ‘ঈদের আগের দিন সাভারে এক ব্যক্তির সঙ্গে তার ঝামেলা হয়। তার জেরেই গণমাধ্যম তার বিরুদ্ধে সংবাদ প্রকাশ করেছে।’
একেক সময় একেক বক্তব্য দেওয়া মিল্টন সমাদ্দারের বিরুদ্ধে চার মাস ধরে অনুসন্ধান করেছে কালবেলা। সংবাদ প্রকাশের আগে ইতিবাচক ফিচার লেখার কথা বলে মিল্টন সমাদ্দারের কল্যাণপুরের অফিসে টানা দেড় ঘণ্টা সাক্ষাৎকার নেওয়া হয়। সেই সাক্ষাৎকারে মিল্টন সমাদ্দারের ব্যক্তিগত এবং পারিবারিক জীবন নিয়ে যেসব অভিযোগ আনা হয়েছে, তার সবই তিনি কালবেলার কাছে স্বীকার করেছেন—যার পুরো রেকর্ড কালবেলার হাতে রয়েছে। |
No link found |
|
|
|
|
|
|
|
Today's Other News
|
Related Stories |
|
|
|
|