Hawkerbd.com     SINCE
 
 
 
 
ঋণখেলাপি গোষ্ঠীকে দায়মুক্তি দিতেই কি সব উদ্যোগ? [ পাতা ৪ ] 30/04/2024
ঋণখেলাপি গোষ্ঠীকে দায়মুক্তি দিতেই কি সব উদ্যোগ?
কোনো ধরনের নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক সম্প্রতি দুর্বল ও সবল ব্যাংক একীভূতকরণের উদ্যোগ নিয়েছে। প্রায় একই সময়ে গ্রুপভুক্ত ঋণখেলাপিদের আরও ছাড় দিতে নতুন প্রজ্ঞাপন জারি করেছে। দুটি উদ্যোগই প্রকারান্তরে দেশের ব্যাংক ব্যবস্থাকে আরও একধাপ খারাপের দিকে নিয়ে যাবে।

ব্যাংক একীভূতকরণের আলোচনায় যাওয়ার আগে বাংলাদেশ ব্যাংকের নতুন প্রজ্ঞাপনের দিকে আলোকপাত করা যাক। প্রজ্ঞাপনে বলা হয়েছে, ঋণখেলাপি ব্যবসায়ী গ্রুপের একটি প্রতিষ্ঠান খেলাপি হলেও অন্য প্রতিষ্ঠানগুলো এখন থেকে নতুন করে ঋণ পাওয়ার যোগ্য হবে। তবে প্রতিষ্ঠানটি ইচ্ছাকৃত খেলাপি, নাকি যৌক্তিক কারণে খেলাপি হয়েছে, ব্যাংক তা দেখবে। আর এসব বিবেচনা করে বাংলাদেশ ব্যাংক ঋণ নেওয়ার বিষয়ে চূড়ান্ত অনুমোদন দেবে। এর মধ্য দিয়ে ঋণখেলাপিরা কার্যত আবারও ছাড় পাচ্ছে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাছ থেকে। আগে এক প্রতিষ্ঠান খেলাপি হলে গ্রুপভুক্ত অন্য প্রতিষ্ঠানের ঋণ নেওয়ার সুযোগ ছিল না। এ প্রজ্ঞাপনের উদ্দেশ্য এবং এর পেছনে যে ঋণখেলাপি শক্তিশালী গোষ্ঠী কাজ করেছে সেটি বুঝতে হলে একটু পেছনে ফিরে যেতে হবে। গত বছর জুলাইয়ে যখন সংসদে ব্যাংক কোম্পানি আইনে পরিবর্তনের প্রস্তাব পাশ হয়, তখন তাতে অতিরিক্ত সংশোধনীর প্রস্তাব করেছিলেন সরকারি দলের একজন সংসদ-সদস্য।

ব্যাংক কোম্পানি আইনে সংশোধনীর এ পুরো প্রক্রিয়াটি ছিল পরিকল্পিত। গত বছর জুনে বেশ কয়েকটি ব্যাংকের পরিচালক সম্মিলিতভাবে সরকারের কাছে একটি লিখিত প্রস্তাব পাঠিয়েছিলেন। যেখানে বলা হয়, গ্রুপভুক্ত কোনো প্রতিষ্ঠান খেলাপি হলে, অন্য প্রতিষ্ঠান যাতে ঋণের সুবিধা থেকে বঞ্চিত না হয়। ওই প্রস্তাবে আরও বলা হয়েছিল ঋণ ইচ্ছাকৃতভাবে খেলাপি না হলে বা যুক্তিসংগত কারণে ঋণখেলাপি হয়ে পড়লে, সেই ঋণকে খেলাপি হিসাবে গণ্য করা উচিত হবে না। এ লিখিত প্রস্তাব পাঠানোর আগে সংশোধিত ব্যাংক কোম্পানি আইনের খসড়ায় এমন কোনো ধারা ছিল না। অথচ পরে এ ধারা যুক্ত করে আইনটি পাশ হয়। যে সংসদ-সদস্য এ সংশোধনীর প্রস্তাব এনেছিলেন, আওয়ামী লীগ আবারও সরকার গঠন করলে তিনি প্রতিমন্ত্রীর দায়িত্ব পান। হয়তো রাষ্ট্রের সেই শক্তিশালী গোষ্ঠীর পক্ষ থেকে এটা একটা পুরস্কার।

যারা খেলাপি হন, তারা ইচ্ছাকৃতভাবে খেলাপি হয়েছেন, এ কথা নিশ্চয়ই স্বীকার করবেন না এবং খেলাপি হয়ে পড়ার পেছনে যুক্তি এবং প্রমাণ উপস্থাপন করবেন। যে গোষ্ঠী সংসদকে ব্যবহার করে আইন পরিবর্তন করাতে সক্ষম হয়েছেন, তাদের জন্য নিজেদের ইচ্ছাকৃত খেলাপি নয় বলে প্রমাণ করা নিশ্চয়ই কোনো কঠিন বিষয় নয়। যেখানে সরকার তথা পুরো রাষ্ট্রযন্ত্রকে প্রভাবিত করার ক্ষমতা তারা রাখে। ফলে এর মধ্য দিয়ে খেলাপিরা ব্যাংক থেকে টাকা বের করে নিয়ে যাওয়ার নতুন বন্দোবস্ত করল নিয়ন্ত্রক সংস্থা এবং সরকারের মাধ্যমেই।

গত বছরের ডিসেম্বর শেষে খেলাপি ঋণ দাঁড়িয়েছে প্রায় দেড় লাখ কোটি টাকা, যা বিতরণ করা ঋণের ৯ শতাংশ। ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতা গ্রহণের সময় খেলাপি ঋণ ছিল প্রায় সাড়ে ২২ হাজার কোটি টাকা। অর্থাৎ ১৫ বছরে খেলাপি ঋণ বেড়েছে প্রায় সাড়ে ৬ গুণ। তবে প্রকৃত হিসাব এর প্রায় দ্বিগুণ। বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাব অনুযায়ী, আদালতের মাধ্যমে স্থগিত, অবলোপনকৃত ও পুনঃতফসিলি ঋণ যোগ করলে এ পরিমাণ প্রায় ৩ লাখ কোটি টাকা।

এবার সাম্প্রতিক সময়ের আলোচিত ব্যাংক একীভূতকরণের পদ্ধতি, উদ্দেশ্য এবং নীতিমালার দিকে আলোকপাত করা যাক। সরকারি-বেসরকারি মোট পাঁচটি ব্যাংককে অন্য পাঁচটি ব্যাংকের সঙ্গে একীভূত করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। কার্যত অনেকটা জোর করে কিছুটা সবল ব্যাংকের ওপর চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে দুর্বল ব্যাংকের বোঝা। নিয়ন্ত্রক সংস্থার ব্যাংক একীভূতসংক্রান্ত নীতিমালা ঘোষণা করার আগেই ব্যাংক একীভূত করার তিনটি ও পরে দুটি সিদ্ধান্ত হয়। নীতিমালা অনুযায়ী, এ পর্যায়ে ব্যাংক একীভূত হওয়ার কথা স্বেচ্ছায়; কিন্তু বাস্তবে ব্যাংকের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের ডেকে নিয়ে ব্যাংক একীভূত করার সিদ্ধান্ত জানিয়ে দিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এ ব্যাপারে দ্বিমত পোষণ করার কোনো সুযোগ দেওয়া হয়নি ব্যাংকগুলোকে। কোনো ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট দুই ব্যাংকের প্রতিনিধি, আবার কোনো কোনো ক্ষেত্রে শুধু একটি ব্যাংকের প্রতিনিধির উপস্থিতিতে একীভূত হওয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছে। ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ কিংবা ঊর্ধ্বতন নির্বাহীরা নিজেরাও জানতেন না যে তাদের ব্যাংক অন্য কোনো ব্যাংকের সঙ্গে একীভূত হতে চলেছে। অথচ নীতিমালায় আছে, একীভূত হওয়ার বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেবে সংশ্লিষ্ট ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ। অর্থাৎ স্বয়ং কেন্দ্রীয় ব্যাংক নীতিমালা অনুসরণের প্রয়োজন মনে করেনি।

ব্যাংকগুলো দুর্বল হয়েছে প্রভাবশালী ঋণখেলাপি ব্যবসায়ী গোষ্ঠী, ব্যাংক মালিকদের স্বেচ্ছাচার, একই ব্যবসায়ী গ্রুপের হাতে একাধিক ব্যাংকের মালিকানা তথা ব্যাংক খাতে অনিয়ম, দুর্নীতি আর অব্যবস্থাপনার কারণে। এর পাশাপাশি রাজনৈতিকভাবে নিয়োগপ্রাপ্ত সরকারি ব্যাংকের এমডি বা পরিচালনা পর্ষদ কর্তৃক তদবির কিংবা বিভিন্ন সুবিধার বিনিময়ে ব্যাংক ঋণ ও লুটপাট; সরকারের পৃষ্ঠপোষকতায় দুর্নীতিকে প্রশ্রয়, ঋণখেলাপিদের বিচার না করা, নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করে ঋণ বিতরণ ও পুনঃতফসিল এবং টিকিয়ে রাখার নামে দেউলিয়ার পথে থাকা ব্যাংকগুলোতে তারল্য সহায়তা লুটেরা গোষ্ঠীকে দেশের ব্যাংক খাতকে ধ্বংস করার সুযোগ তৈরি করে দিয়েছে।

দেশের ব্যাংক খাত দুর্বল হওয়ার এ কারণগুলো সমাধান না করে এবং এর জন্য দায়ী ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর বিচার না করে ব্যাংক একীভূত করার মধ্য দিয়ে অপেক্ষাকৃত ভালো ব্যাংকগুলোকে ঝুঁকির মধ্যে ফেলে দেওয়া হচ্ছে। এর মধ্য দিয়ে দুর্বল ব্যাংকগুলোতে থাকা অস্বাভাবিক খেলাপি ঋণ এখন সহজে আড়াল করার সুযোগ তৈরি হলো।

দুর্বল ব্যাংকগুলোর সংকটের জন্য দায়ী ব্যক্তি বা গোষ্ঠীকে চিহ্নিত করে বিচারের আওতায় আনার কোনো নির্দেশনা নেই ব্যাংক একীভূতকরণ নীতিমালায়। এমনকি যে মালিক-পরিচালকদের যোগসাজশে ব্যাংকগুলোকে ধ্বংস করা হয়েছে, একীভূতকরণের পর তাদের অধিগ্রহণকারী ব্যাংকের পরিচালক পদে নিয়োগের সুযোগ রাখা হয়েছে এ নীতিমালায়।

‘স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে ব্যাংক-কোম্পানির একত্রীকরণ সম্পর্কিত নীতিমালা’র ধারা ৮(৩)-এ বলা হয়েছে, ‘৫ বছর অতিক্রান্ত হওয়ার পর, হস্তান্তরকারী ব্যাংকের শেয়ারহোল্ডাররা তাদের শেয়ার ধারণের আনুপাতিক হারে প্রয়োজনীয় যোগ্যতা ও উপযুক্ততা থাকা সাপেক্ষে, পর্ষদে পরিচালক হিসাবে অন্তর্ভুক্ত হতে পারবেন।’ ধারা ৮(৪)-এ বলা হয়েছে, ‘একীভূত ব্যাংক কোম্পানির পরিচালনা পর্ষদ ওই বিলুপ্ত কোম্পানির ব্যবস্থাপনা পরিচালক, অতিরিক্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও উপব্যবস্থাপনা পরিচালক পদের কোনো কর্মকর্তাকে যদি উপযুক্ত মনে করে, তাহলে নতুন করে চুক্তি ভিত্তিতে উপযুক্ত কোনো পদে নিয়োগ প্রদান করতে পারবে।’ ফলে একটা বিষয় পরিষ্কার যে, দেশের ব্যাংক খাতের শৃঙ্খলা, সুশাসন ফেরানোর উদ্দেশ্যে নয় বরং যাদের কারণে ব্যাংক দুর্বল হয়েছে, তাদের দায়মুক্তি দেওয়ার ব্যবস্থা করা হয়েছে এ নীতিমালায়।

নীতিমালায় বলা হয়েছে, দুর্বল ব্যাংকের মন্দ ঋণগুলো সম্পদ ব্যবস্থাপনা কোম্পানির কাছে বিক্রি করে দেওয়া হবে, যাতে মন্দ ঋণের প্রভাব অধিগ্রহণকারী সবল ব্যাংকগুলোর ওপর না পড়ে। যদি সম্পদ ব্যবস্থাপনা কোম্পানিগুলো মন্দ ঋণ ক্রয়ে আগ্রহী হয়, তবে দুর্বল ব্যাংকগুলো নিজেরাই এ প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে যেতে পারে। সেক্ষেত্রে একীভূতকরণের প্রয়োজন পড়ে না।

এদিকে দুর্বলের সঙ্গে সবল এবং বেসরকারির সঙ্গে সরকারি ব্যাংক একত্রীকরণ প্রক্রিয়াকে কেন্দ্র করে পুরো ব্যাংক খাতে এক ধরনের আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে। ব্যাংকে টাকা রাখতে ভয় পাচ্ছেন বেশিরভাগ আমানতকারী। এজন্য ব্যক্তিগত আমানতকারীর পাশাপাশি প্রাতিষ্ঠানিক আমানতকারীও ব্যাংক থেকে টাকা তুলে নিচ্ছেন। বড় অঙ্কের এফডিআর তুলে নেওয়ার আবেদন পড়ছে প্রতিদিন। একীভূতকরণের ঘোষণা আসার পর গত কয়েকদিনে বেসিক ব্যাংক ২ হাজার কোটি টাকার বেশি আমানত হারিয়েছে। ফলে বোঝা যাচ্ছে, এ প্রক্রিয়া ব্যাংক খাতকে আরও বেশি অনিশ্চয়তা এবং ঝুঁকির দিকেই নিয়ে যাচ্ছে।

সরকার যখন ঋণখেলাপিদের বাড়তি সুবিধা দেওয়ার জন্য আইন করে, তখন নিয়ন্ত্রক সংস্থার কিছু করার থাকে না। রাষ্ট্রের শাসনব্যবস্থা যখন কর্তৃত্ববাদী হয়, তখন কোনো খাতেই সুশাসনের প্রত্যাশা করা যায় না। ব্যাংক খাত ধ্বংসের জন্য দায়ী ব্যক্তি, গোষ্ঠী এবং ব্যাংকের পরিচালক-কর্মকর্তাদের চিহ্নিত না করে, শাস্তি না দিয়ে ব্যাংক একীভূত করায় সংকট আরও ঘনীভূত হচ্ছে। লক্ষণীয় যে, প্রায় একই সময়ে ব্যাংক একত্রীকরণ প্রক্রিয়া এবং গ্রুপভুক্ত ঋণখেলাপিদের ছাড় তথা নতুন ঋণের সুযোগ দিতে নীতিমালা প্রকাশ করেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। পরিস্থিতি, উদ্যোগ ও নীতিমালা পর্যালোচনা করলে বোঝা যায়, সরকার ও কেন্দ্রীয় ব্যাংক রাজনৈতিকভাবে শক্তিশালী ঋণখেলাপি গোষ্ঠীকে বেলআউট করতে আগ্রহী। ঋণখেলাপিদের সুযোগ দিতেই কি সব উদ্যোগ?
News Source
 
 
 
 
Today's Other News
• অর্থ পাচার রোধে উচ্চতর প্রশিক্ষণের বিকল্প নেই
• ব্যবসায়ী নামধারী কিছু প্রতারক নকল পণ্য উৎপাদন করছে
• মাদক ব্যবসায় অবৈধ সম্পদ অর্জন, বাবা-ছেলের বিরুদ্ধে দুদকের মামলা
• ২ সংবাদিককে প্রধান শিক্ষকের অকথ্য গালাগাল, ভিডিও ভাইরাল
• সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তরের স্টিকার সাঁটানো গাড়িতে ৭ লাখ পিস ইয়াবা
• ঠিকাদারসহ পাউবোর ২ প্রকৌশলীর বিরুদ্ধে দুদকের মামলা
• বিদেশে অর্থপাচার রোধে প্রশিক্ষণের বিকল্প নেই: সিআইডি প্রধান
• ভূমধ্যসাগর থেকে ৩৫ বাংলাদেশি উদ্ধার
More
Related Stories
 
Forward to Friend Print Close Add to Archive Personal Archive  
Forward to Friend Print Close Add to Archive Personal Archive  
 
 
Home / About Us / Benifits / Invite a Friend / Policy
Copyright © Hawker 2013-2012, Allright Reserved