বর্তমানে দেশে নারী মাদকাসক্তদের সংখ্যাও কম নয়। বিভিন্নভাবে মাদকাসক্ত
হয়ে পড়ছে নারীরা। নারীকে ধারণ করে যে পরিবার টিকে থাকে, সেখানে নারীই যদি
মাদকাসক্ত হয়ে পড়ে তাহলে তা পরিবার ও সমাজের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ। অথচ
মাদকাসক্ত নারীদের নিরাময়ে দেশে যথেষ্ট নিরাময় কেন্দ্র গড়ে উঠেনি। একমাত্র
আহ্ছানিয়া মিশন মাদকাসক্ত নারীদের নিরাময়ের লক্ষ্যে ২০১৪ সালে নারী
মাদকাসক্তি চিকিৎসা ও পুনর্বাসন কেন্দ্রে গড়ে তোলে। এই কেন্দ্র থেকে ১০
বছরে ৭৬৫ জন নারী চিকিৎসা সেবা নিয়েছেন।
প্রতিষ্ঠানটির ১০ বছর উপলক্ষে প্রকাশ করা প্রতিবেদনের তথ্যানুযায়ী, ১০
বছরে চিকিৎসা নেয়া ৭৬৫ জন নারীর মধ্যে মাদককাসক্তি সমস্যার জন্য চিকিৎসা
নিয়েছেন ৪৬৩ জন। মাদক নিরাময় চিকিৎসা সেবা নেয়া নারীদের মধ্যে ৭৮ শতাংশই
ইয়াবা ও গাঁজায় আসক্ত। এরমধ্যে একাধিক মাদকসহ ইয়াবায় আসক্ত ৩৯ শতাংশ,
গাঁজায় আসক্ত ৩৯ শতাংশ। এছাড়াও ঘুমের ওষুধ, মদ, শিরায় মাদক নেয়া ও অন্যন্য
মাদক সেবনকারী রয়েছে। গত বছরের তথ্যের তুলনায় এই হার বৃদ্ধি পেয়েছে। গত বছর
ইয়াবায় আসক্তির হার ছিল ৩৩ শতাংশ, গাঁজায় ২৮ শতাংশ ও ঘুমের ওষুধে আাসক্তি
ছিল ১৬ শতাংশ। এছাড়া মানসিক রোগের মধ্যে সিজোফ্রিনিয়ায় ৩৫ শতাংশ, মুড
ডিজ্অর্ডার ২৬, বাইপোলার ১২, ডিপ্রেশন ১০, ওসিডি ৬ শতাংশসহ বাকিরা অন্যান্য
মানসিক রোগে আক্রান্ত ছিল।
নারী মাদকাসক্তি চিকিৎসা ও পুনর্বাসন কেন্দ্রটির ১০ বছর পূর্তি উপলক্ষে
সোমবার বেলা ১১ টায় রাজধানীর শ্যামলীস্থ ঢাকা আহ্ছানিয়া মিশন স্বাস্থ্য
সেক্টর কার্যালয়ের সম্মেলন কক্ষে এক সংবাদ সম্মেলন এ তথ্য তুলে ধরা হয়।
ঢাকা আহ্ছানিয়া মিশন স্বাস্থ্য ও ওয়াশ সেক্টরের পরিচালক ইকবাল মাসুদের
সভাপতিত্বে সংবাদ সম্মেলনে চিকিৎসা কেন্দ্রটির মূল প্রতিবেদন উপস্থাপন করেন
মাদকাসক্তি চিকিৎসা ও পুনর্বাসন কেন্দ্রে কাউন্সিলর জান্নাতুল ফেরদৌস
মজুমদার। প্রতিষ্ঠানটির সিনিয়র সাইক্লোজিস্ট রাখী গাঙ্গুলীর সঞ্চালনায়
স্বাগত বক্তব্য রাখেন কেন্দ্র ব্যবস্থাপক ফারজানা ফেরদৌস। প্রতিবেদনে
উল্লেখ করা হয়, ৭৬২ জন রোগীর মধ্যে ৭০ শতাংশ চিকিৎসার মেয়াদ পূর্ণ করেছেন।
মেয়াদ পূর্ণ না করে চলে গেছে ২২ শতাংশ এবং বিভিন্ন কারনে ৪ শতাংশ রোগীকে
রেফার করা হয়েছে। বর্তমানে কেন্দ্রটিতে ৪ শতাংশ রোগী চিকিৎসারত আছেন।
বক্তরা বলেন, মাদকসক্ত নারীর সংখ্যা আশঙ্কাজনকভাবে বাড়লেও মাদকের
চিকিৎসায় পিছিয়ে আছে নারীরা। এর অন্যতম কারণ নারীদের মাদক নিরাময়ে তেমন
ব্যবস্থা না থাকা। মাত্র ৮টি নিরাময় কেন্দ্রে যৌথভাবে নারীদের চিকিৎসার
ব্যবস্থা আছে। সেগুলো শুধুমাত্র ঢাকা কেন্দ্রীক হওয়ায় অন্য বিভাগের
মাদকাসক্ত নারীরা সুবিধাবঞ্চিত হচ্ছেন। অথচ মাদকের প্রভাব পুরুষের চেয়ে
ভিন্ন ভাবে নারীদের ক্ষতি করে। এক্ষেত্রে বলা যায় শারীরিক, মনসিক
স্বাস্থ্যের পাশাপাশি প্রজনন স্বাস্থ্যে উপরে প্রভাব পড়ে। যা একজন নারীর
সন্তান ধারণ, জন্ম ও লালন পালন মারাত্বক ভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হয়। তারা বলেন,
সময়ের চাহিদার সঙ্গে সমন্বয় রেখে আহ্ছানিয়া মিশন নারী মাদকাসক্তি চিকিৎসা ও
পুনর্বাসন কেন্দ্র ২০১৪ সালের এপ্রিল মাসে প্রতিষ্ঠিত হয়। যা দেশের
একমাত্র নারীদের পূর্নাঙ্গ চিকিৎসা কেন্দ্র। শুরু থেকে এই চিকিৎসা কেন্দ্র
নারীদের মাদকনির্ভরশীলতা, মানসিক ও আচরণগত সমস্যার চিকিৎসা দিয়ে আসছে।
বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে প্রতিষ্ঠানটি মাদকনির্ভরশীলতা ও মানসিক
সমস্যাগ্রস্থ নারীদের জন্য ১০ বছর ধরে সাফল্যের সঙ্গে বিজ্ঞান ও
প্রমাণভিত্তিক চিকিৎসা দিচ্ছে।
প্রতিষ্ঠানটি থেকে চিকিৎসা নিয়ে অনেক নারীই এখন স্বাভাবিক জীবনযাপন
করছেন। তারা সংসার জীবনে ফিরেছেন। পরিবার-পরিজন তাদের আপন করে নিয়েছে। এমন
কয়েকজন নারী সেখানে উপস্থিত হয়ে তাদের জীবনে মাদকে জড়িয়ে যাওয়ার গল্পও
শোনান। তাদের মধ্যে একজন লুবনা (ছদ্মনাম)। ৯ম শ্রেণির শিক্ষার্থী থাকা
অবস্থায় চাচার দেখাদেখি মাদক সেবনে আগ্রহ বাড়ে তার। একটা পর্যায়ে মাদক
ব্যবসায়ী চাচার সঙ্গেই মাদক সেবন করতেন। এতে দিন দিন বড় হতে থাকা লুবনা
সবার কাছে মাদকাসক্ত মেয়ে হিসেবে পরিচিতি পায়। সমাজে মুখ দেখাতে পারতো না।
খাবারে অরুচি থাকত, ঠিকমতো ঘুম হতো না। পরবর্তীতে পরিবার তাকে আহ্ছানিয়া
মিশন নারী মাদকাসক্তি চিকিৎসা ও পুনর্বাসন কেন্দ্রে ভর্তি করায়। সেখানে দুই
মাস করে ৪ বার চিকিৎসা নেন তিনি। এখন পুরোপুরি সুস্থ ও স্বাভাবিক জীবনযাপন
করছেন লুবনা। স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে পেরে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন কেন্দ্রের
চিকিৎসা সেবার সঙ্গে সংশ্লিষ্টদের।
সভাপতির বক্তব্যে ইকবাল মাসুদ বলেন, নারী মাদক নির্ভরশীলদের চিকিৎসা
প্রক্রিয়াটি পুরুষের তুলনায় বেশ জটিল ও সময় সাপেক্ষ। ক্রমবর্ধমান নারী মাদক
নির্ভরশীলদের চিকিৎসা ও প্রতিরোধের দিকে বিশেষ নজর দেয়া উচিত। এক্ষেত্রে
অভিভাবক ও নীতিনির্ধারকদের বিশেষ ভূমিকা পালন করতে হবে। নারীকে ধারণ করে যে
পরিবার টিকে থাকে, সেখানে নারীই যদি মাদকাসক্ত হয়ে যান তাহলে তা পরিবার ও
সমাজের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ। পরিবার, সমাজ, স্বামী কর্তৃক বিভিন্নভাবে বঞ্চিত ও
অবহেলার শিকার হয়ে নারীরা মাদকে হাত বাড়ায়। তিনি আরো বলেন, এটি দেশের
একমাত্র সম্পূর্ণ নারী কর্মীদ্বারা পরচিালিত চিকিৎসা কেন্দ্র। যা রোগীদের
নিরাপত্তাসহ চিকিৎসা নিশ্চিতে নিরলস চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। এই কেন্দ্রে
রোগীদের জীবন দক্ষতা বৃদ্ধি ও পুনর্বাসনের জন্য ভোকেশনাল ও উদ্যেক্তা কোর্স
করানো হচ্ছে।
উল্লেখ্য, ২০১৪ সালের ১২ এপ্রিল স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী (তৎকালীন
প্রতিমন্ত্রী) আসাদুজ্জামান খান আহ্ছানিয়া মিশন নারী মাদকাসক্তি চিকিৎসা ও
পুনর্বাসন কেন্দ্রের শুভ উদ্বোধন ঘোষণা করেছিলেন। বাংলাদেশের প্রথম একমাত্র
লাইসেন্সপ্রাপ্ত নারী মাদকাসক্তি চিকিৎসা ও পুনর্বাসন কেন্দ্র। যা
সর্ম্পূণ নারী কর্মী দ্বারা পরিচালিত। চিকিৎসা কেন্দ্রটি সকল আধুনিক
সুযোগসুবিধার পাশাপাশি শীতাতাপ নিয়ন্ত্রিত। এটি মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ
অধিদপ্তর থেকে ২০২৩ সালে দেশের সেরা চিকিৎসা কেন্দ্র হিসেবে পুরষ্কার অর্জন
করে।