Hawkerbd.com     SINCE
 
 
 
 
বিল তুলতে জালিয়াতি [ অনলাইন ] 05/05/2024
বিনামূল্যের বইয়ে নিম্নমানের কাগজ, পিএলআই রিপোর্ট জাল
বিল তুলতে জালিয়াতি
প্রতি বছরের শুরুতেই প্রায় ৪ কোটি শিক্ষার্থীর হাতে বিনামূল্যের বই তুলে দেয় সরকার। এর জন্য ব্যয় হয় হাজার কোটি টাকার বেশি। কিন্তু অসাধু ব্যবসায়ীদের চক্রে মাধ্যমিক পর্যায়ের বই এবারও নি¤œমানের কাগজ দিয়ে ছাপানো হয়েছে। নি¤œমানের কাগজকে ভালোমানের দেখিয়ে বিল তুলতে ১৮ কোটি বইয়ের পিএলআই (পোস্ট ল্যান্ডিং ইন্সপেকশন) রিপোর্ট জালিয়াতির ঘটনা ঘটেছে।

সংশ্লিষ্টরা জানান, খারাপ কাগজ দিয়ে বই ছাপাতে লটপ্রতি লাখ টাকা ঘুষ গুনতে হয়েছে ব্যবসায়ীদের। মান নিয়ন্ত্রণকারী প্রতিষ্ঠানের ছাড়পত্র পেতে করা হয়েছে সিল ও স্বাক্ষর জালের মতো কাজ। যার সঙ্গে জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের (এনসিটিবি) প্রশাসন ও বিতরণ শাখা জড়িত বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে।

জানা যায়, এ বছর শিক্ষার্থীদের হাতে বই তুলে দিতে ১১০০ কোটি টাকার বই ছাপানো হয়। এর মধ্যে ২০০ কোটি টাকা এখনো বকেয়া। নি¤œমানের কাগজ দিয়ে তড়িঘড়ি ছাড়পত্র ও জরিমানা ঠেকাতেই এমন জালিয়াতির আশ্রয় নেওয়া হচ্ছে। সূত্র জানায়, যে মানের বই এ বছর দেওয়া হয়েছে তাতে ব্যবসায়ীদের অন্তত ৫০ কোটি টাকা জরিমানা গুনতে হতে পারে। এ ছাড়াও প্রেসগুলোর কালো তালিকাভুক্তির সম্ভাবনা রয়েছে। সে ক্ষেত্রে আগামী বছর বইয়ের কাজ পাওয়ার সম্ভাবনা থাকবে না। এসব কারণে ঘুষ ও জাল-জালিয়াতির মাধ্যমেই তারা এটি পার পেতে চাচ্ছে।

জানতে চাইলে এনসিটিবি চেয়ারম্যান অধ্যাপক ফরহাদুল ইসলাম জনকণ্ঠকে বলেন, এমন ঘটনার কারণে আমি ১৩টি পিএলআই রিপোর্ট জব্দ করেছি। এই অভিযোগ আমার কাছেও এসেছে। তবে অর্থ লেনদেনের যে বিষয়ে অভিযোগ উঠেছে তা ভয়াবহ। বিষয়টি নিয়ে তদন্ত কর হবে। যে বেসরকারি মাননিয়ন্ত্রণকারী প্রতিষ্ঠান এমনটি করেছে তারা যেন এনসিটিবি চৌহদ্দির মধ্যে না আসতে পারে এমন ব্যবস্থাও নেওয়া হবে। অভ্যন্তরীণ কর্মকর্তাদের জড়িত থাকার বিষয়ে তিনি বলেন, সম্প্রতি জাতীয় গোয়েন্দা সংস্থা এ বিষয়ে তদন্ত করেছে। এক মাসের মধ্যেই পরিবর্তন দেখা যাবে বলে তিনি নিশ্চয়তা দেন।
মান যাচাইয়ের জন্য সারাদেশে বই বিতরণের পর মাঠ পর্যায় থেকে কিছু বই সংগ্রহ করা হয়। এ সময় বইয়ের কাগজ, মুদ্রণ, বাঁধাই ও স্থায়িত্ব পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে ইন্সপেকশন এজেন্ট। এরপর যে রিপোর্ট এনসিটিবিকে দেওয়া হয় তার নামই পিএলআই রিপোর্ট। এই রিপোর্টের ভিত্তিতেই পরবর্তী বিল ছাড় করে এনসিটিবি।

মাধ্যমিকের দুটি ইন্সপেকশন এজেন্টের মধ্যে একটি কোম্পানির নাম শেখ ট্রেডিং ইন্সপেকশন। যার স্বত্বাধিকারী শেখ বিপ্লব। অন্যটির নাম ইন্ডিপেনডেন্ট সার্ভিস বিডি। এই কোম্পানির স্বত্বাধিকারী শেখ বেলাল। যারা পিএলআই ইন্সকেপশন এজেন্টের কাজ করে। শেখ বিপ্লব ও শেখ বেলাল সম্পর্কে সহোদর। শেখ বেলালের সিল প্যাড জালিয়াতি করে শেখ বিপ্লব পিএলআই রিপোর্ট জমা দিয়েছে। এরপরই এ বিষয়ে হইচই শুরু হয়।

ইন্ডিপেনডেন্ট সার্ভিস বিডির স্বত্বাধিকারী শেখ বিপ্লব জানান, বর্তমানে আমার বই সংগ্রহের কাজ চলছে। এখনো পর্যন্ত কোনো রিপোর্ট জমা দেইনি। কিন্তু জানতে পারলাম আমার সিল-প্যাড জালিয়াতি করে কিছুদিন ধরেই জমা দিচ্ছে সে। বিষয়টি আমি এনসিটিবিকেও জানিয়েছি।

অভিযোগ উঠেছে, ৬ষ্ঠ, সপ্তম, অষ্টম ও নবম শ্রেণির চারশ’ লটে নি¤œমানের কাগজ ঢোকানো হয়েছে। এজন্য প্রেস মালিকরা ঘুষ দিয়েছেন লটপ্রতি ২ লাখ টাকা। পরে সেটি এনসিটিবির মাধ্যমে পাস হয়ে নি¤œমানের কাগজ দিয়েই বই ছাপানো হয়েছে। এখন নি¤œমানের কাগজের বইয়ের মানের ছাড়পত্র পেতে আরও এক লাখ ঘুষ লাগছে। অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাওয়া হলে শেখ বেলাল জনকণ্ঠকে বলেন, আমি মিটিংয়ে আছি। এ বিষয়ে পরে কথা বলব। পরে তার সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি অস্বীকার করে বলেন দুই ভাইয়ের মধ্যে ভুল বোঝাবুঝি হয়েছিল।

সরেজমিন মতিঝিলে এনসিটিবি অফিসে গিয়ে দেখা যায়, নতুন বছরের বই ছাপানোর বিষয়ে প্রাথমিক কার্যক্রম শুরু হয়েছে। গত বছরের বইয়ের বাকি বিল দেওয়ারও তোড়জোড় চলছে। এ বিষয়ে কর্মকর্তারা জানান, বাকি বিলগুলো দিয়ে হাতের কাজ শেষ করে নতুন কাজ শুরু করতে হবে। সূত্র জানায়, এর আগেও ট্রেড লাইসেন্স জাল, পূর্ব অভিজ্ঞতা না থাকা ও সর্বনিম্ন দরদাতা না হওয়ার পরও এমন এজেন্ট নিয়োগের নজির রয়েছে। এ ছাড়াও যারা বড় কাজ পায়, তারায় কৌশলে অন্য কোম্পানিকে দিয়ে নিজেদের মতো এজেন্ট নিয়োগ দেওয়া হয়। এজেন্ট একা পারে না, এখানে এনসিটিবিরও জড়িত থাকতে হয়। শেষ পর্যন্ত  ঘটনা ঘটে এজেন্টের ঘাড়ে বন্দুক রেখে গুলি চালানোর মতো হয়ে দাঁড়ায়।

জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি) শিক্ষাব্যবস্থার কারিকুলাম প্রণয়ন, পরিমার্জন করে। এ ছাড়াও প্রতি বছর প্রাক প্রাথমিক, প্রাথমিক, মাদ্রাসাসহ মাধ্যমিক স্তরের বই ছাপায়। গত কয়েক বছর সরকারের অর্থে নি¤œমানের বই ছাপানোর কারণে সমালোচনার মুখে রয়েছে প্রতিষ্ঠানটি। এর মধ্যেই সংস্থাটির বিতরণ ও প্রশাসন শাখার কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে এমন অভিযোগ এলো। জানতে চাইলে এনসিটিবির বিতরণ শাখার নিয়ন্ত্রক হাফিজুর রহমান জনকণ্ঠকে বলেন, দুই ভাইয়ের মধ্যে সমস্যা হয়েছিল। পরে সেটি সমাধান হয়ে গেছে।

এনসিটিবি সূত্রে জানা যায়, ২০২৪ শিক্ষাবর্ষে প্রাথমিক, ইবতেদায়ি ও মাধ্যমিক স্তরের ৩ কোটি ৮১ লাখ ২৭ হাজার ৬৩০ শিক্ষার্থীর মধ্যে বিনামূল্যে বিতরণের জন্য ছাপানো হয়েছে ৩০ কোটি ৭০ লাখ ৮৩ হাজার ৫১৭ কপি। এর মধ্যে মাধ্যমিক স্তরের মোট বই ১৮ কোটি ৬১ লাখ ১ হাজার ২০৬টি। অষ্টম ও নবম শ্রেণির জন্য ছাপানো হয়েছে ১০ কোটি ৪১ লাখ ৫০ হাজারের বেশি বই। আর প্রাথমিক স্তরের মোট বই প্রায় ৯ কোটি ৫০ লাখ। এ ছাড়া ইবতেদায়ির জন্য ২ কোটি ৭১ লাখ ৭৩ হাজার ১৩৫টি বই ছাপা হয়েছে। গত বছর প্রায় ৩৩ কোটি বই ছাপানো হলেও নতুন কারিকুলামের কারণে এবার ২ কোটির বেশি বই কম ছাপানো হচ্ছে।

গত বছর ছাপাখানায় সাংবাদিক প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা দিয়ে অফিস আদেশ জারি করেছিল এনসিটিবি। সেখানে বলা হয়েছিল কোনো ছাপাখানা পরিদর্শনে যেতে হলে এনসিটিবির অনুমতি নিয়ে সাংবাদিকদের যেতে হবে। যা নিয়ে সব মহলে উঠেছিল সমালোচনা। অনেকে জানিয়েছিলেন দুর্নীতি ও অনিয়ম ঢাকতেই নজিরবিহীন এ উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।

পাঠ্যবইয়ের মান নিয়ন্ত্রণে অন্যতম মুখ্য ভূমিকা পালন করেন পরিদর্শন দল। বই উৎপাদনকালে ছাপাখানাগুলো নিয়মিত পরিদর্শন করতে ৩ স্তরের পরিদর্শক দল কাজ করেন। প্রাথমিকের জন্য প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের পরিদর্শক দল, মাধ্যমিকের জন্য এনসিটিবির পরিদর্শক দল এবং দরপত্রের মাধ্যমে একটি তৃতীয় পক্ষের বেসরকারি প্রতিষ্ঠান দিয়ে ছাপাখানা পরিদর্শন কার্যক্রম পরিচালিত হয়। এনসিটিবি কর্মকর্তা ও মুদ্রণ মালিকদের একাংশের দাবি, পরিদর্শকদের অনিয়মের কারণে নি¤œমানের বইগুলো অনুমোদন পেয়ে যায়।

বাংলাদেশ মুদ্রণ সমিতির সাবেক সভাপতি তোফায়েল খান জনকণ্ঠকে বলেন, এ ধরনের ইন্সপেকশন এজেন্ট ও এনসিটিবির দায়িত্ব অনেক। কিন্তু তারা বারবারই দায়িত্বে গাফিলতি করছে। ব্যবসায়ীদের কাগজ কেনার আগে এনসিটিবির অনুমতি নিতে হয়। অনুমতির পর ছাপানো ও বাঁধানোর পর্যায়ে এনসিটিবির প্রতিদিন মনিটরিং করার নির্দেশনা আছে। শেষ হলে বই সরবরাহের জন্য অনুমতি চাওয়া হয়। এরপর নানাভাবে চেক করে ডেলিভারির জন্য ছাড়পত্র দেওয়া হয়।

এরপরই প্রেস মালিকরা সারাদেশে বই পৌঁছে দেন। তিনি জানান, ইন্সপেকশন কোম্পানি ও কর্মকর্তাদের সঙ্গে ভালো যোগাযোগ থাকলে নি¤œমানের কাগজ ও ইন্সপেকশনের পরও বিল পাওয়া সহজ হয়ে যায়। বরং দুই-একজনের পক্ষ থেকে ভালো মানের কাগজ বই ছেপে দেওয়া হলে তারাই বিল পেতে বিড়ম্বনার শিকার হয়।
গত বছর মাধ্যমিকের বইয়ের  উজ্জ্বলতা (ব্রাইটনেস) দেওয়া হয়েছিল ৮০ জিএসএম।

গতবার যা ছিল ৮৫ জিএসএম। কিন্তু ৮৫ জিএসএম ব্রাইটনেসের বইয়ে ভর্জিন পাল্প ব্যবহার করতেই হবে। কিন্তু ৮০ ব্রাইটনেসের কারণে ভার্জিন পাল্প ব্যবহার না করে ছাপানো হয়েছে। অনেক ক্ষেত্রে দেখা গেছে, এটির মান ৫০-এরও নিচে নেমে গেছে। বই মুদ্রণের সঙ্গে জড়িত ছাপাখানার মালিকরা বলছেন, বই ছাপানোর কাজ পেতে প্রাক্কলিত দামের চেয়ে কম টাকায় কাজ নেওয়ায় মান খারাপ হচ্ছে। এ ছাড়াও পরিদর্শনের অভাব, জবাবদিহিতা না থাকা ও ছাপাখানাগুলোর বিরুদ্ধে দৃশ্যমান ব্যবস্থা না নেওয়ায় বইয়ের মান নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না।

বইয়ের মানের বিষয়ে এনসিটিবি চেয়ারম্যান ফরহাদুল ইসলাম তৃতীয় পক্ষের পরিদর্শকদের প্রধান দায়ী করেছেন। জনকণ্ঠকে তিনি বলেন, দেশে মান যাচাইয়ের প্রতিষ্ঠান সংখ্যা কম। যারা আছে, তারা অধিকাংশই খেলাপির তালিকায় আছে। আমরা যাদের ওপর ভরসা করছি, তারা দুর্নীতি করে বড়লোক হচ্ছে। আমরা চাই বিএসটিআই বা সাইন্সল্যাবের সঙ্গে বইয়ের মান যাচাইয়ের চুক্তি করতে। এবার এই সমস্যা থেকে মুক্তি পেতে সেন্ট্রাল প্রকিউরম্যান্ট টেকনিক্যাল ইউনিটে (সিপিটিইউ) আবেদন করা হবে।
News Source
 
 
 
 
Today's Other News
More
Related Stories
 
Forward to Friend Print Close Add to Archive Personal Archive  
Forward to Friend Print Close Add to Archive Personal Archive  
 
 
Home / About Us / Benifits / Invite a Friend / Policy
Copyright © Hawker 2013-2012, Allright Reserved