মানবসেবার আড়ালে মিল্টন সমাদ্দারের অপকর্মের বিষয়ে কিছুই জানতেন না বলে দাবি করেছেন তাঁর স্ত্রী মিতু হালদার। ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা (ডিবি) পুলিশ কার্যালয়ে ৬ ঘণ্টার জিজ্ঞাসাবাদে নিজেকে নির্দোষ দাবি করেন তিনি। মিতু ডিবিকে বলেন, তিনি মিল্টনের প্রতিষ্ঠানে সময় দিতেন না। তিনি তাঁর চাকরি নিয়ে ব্যস্ত থাকতেন। এ ছাড়া ফাউন্ডেশনের নামে যেসব অর্থ এসেছে, কোনো কিছুতে তাঁর নাম নেই। তবে ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) অতিরিক্ত কমিশনার (গোয়েন্দা) মোহাম্মদ হারুন অর রশীদ বলেন, স্বামীর অপকর্মের দায় এড়াতে পারেন না মিতু।
হারুন অর রশীদ বলেন, মিল্টন ভয়াবহ অপরাধ করেছেন। তিনি একটি-দুটি অপরাধ করেননি। তাঁর বিরুদ্ধে ওঠা সব অভিযোগই ভয়াবহ। তিনি নিজেই এসব স্বীকার করেছেন। তাঁর নির্যাতনে অসহায় মানুষ অমানবিক কষ্টে আর্তনাদ করলে পৈশাচিক আনন্দ উপভোগ করতেন মাদকাসক্ত মিল্টন।
গতকাল রোববার বেলা ১১টার দিকে ডিবি কার্যালয়ে আসেন মিতু। বিকেল সাড়ে ৫টা পর্যন্ত তিনি সেখানেই ছিলেন। এর মধ্যে তাঁকে কয়েক দফা জিজ্ঞাসাবাদ করেছে ডিবি। তাঁর সংশ্লিষ্টতার বিষয়ে খোঁজখবর নিচ্ছে তারা। এ ছাড়া প্রতিষ্ঠানের কাগজপত্রে তাঁর সংশ্লিষ্টতা রয়েছে কিনা, তাও দেখা হচ্ছে। এই মামলার তদন্ত চলা পর্যন্ত তাঁকে নজরদারিতে রাখা হবে বলে জানিয়েছেন তদন্ত কর্মকর্তারা।
একটি সূত্র জানায়, চাইল্ড অ্যান্ড ওল্ড এজ কেয়ার আশ্রমের চেয়ারম্যান মিল্টনের টর্চার সেলে আশ্রিতদের ওপর নির্যাতনের বীভৎসজনক ছবি মিতুকে দেখিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করেছে ডিবি। তবে তিনি শুরু থেকেই এসব বিষয়ে জানার কথা অস্বীকার করছেন।
এদিকে প্রতারণা মামলায় তিন দিনের রিমান্ড শেষে গতকাল মিল্টনকে আদালতে তোলে পুলিশ। পরে মানব পাচার আইনের মামলায় তাঁর রিমান্ড আবেদন করা হয়। পরে আদালত তাঁকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য দ্বিতীয় দফায় আরও চার দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন।
মিল্টনের অপরাধের সঙ্গে স্ত্রী মিতুর যোগসাজশ বা সম্পৃক্ততা পেয়েছেন কিনা– জানতে চাইলে হারুন বলেন, দীর্ঘদিন ধরে বিভিন্ন জায়গা থেকে অর্থ সংগ্রহের পর তথাকথিত আর্তমানবতার সেবার নামে আত্মসাৎ করেছে তারা। আশ্রিত প্রতিষ্ঠানে স্ত্রী মিতু যেতেন। তিনি নিজেও তো নার্স। স্বামীর অনিয়ম-অপকর্ম জেনেও পুলিশকে অবগত করেননি। প্রতিবাদ করেননি। এতে স্বামীর অপকর্মের দায় মিতু এড়াতে পারেন না।
তিনি বলেন, ৯০০ লোকের প্রাণ কীভাবে গেল? মিল্টন তাদের হাসপাতালে নেননি, ডেথ সার্টিফিকেটও নেননি, থানা পুলিশকে অবহিত করেননি। আবার ৯০০ লোকের প্রাণ যাওয়ার যে কথা তিনি বলেছেন, সেগুলো আদৌ সত্য কিনা, সত্য হলে কী করেছেন? সব তদন্তে নিয়ে আসা হবে। এ আশ্রমের সঙ্গে জড়িত অন্যদের বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
মহানগর ডিবি-প্রধান বলেন, আশ্রমে আশ্রিত গরিব ও অসহায় মানুষের কোনো অপারেশনের প্রয়োজন হলে মিল্টন নিজেই অপারেশনের নাম করে অঙ্গহানি করতেন। কোনো ধরনের ওষুধ ছাড়াই ব্লেড ও ছুরি দিয়ে ভুক্তভোগীদের হাত-পা কেটে ফেলতেন।
ঢাকার মিরপুর মডেল থানায় প্রতারণার মামলায় তিন দিনের রিমান্ডে মিল্টনকে জিজ্ঞাসাবাদে ‘লোমহর্ষক তথ্য’ পাওয়ার কথা জানিয়ে হারুন অর রশীদ বলেন, অসহায় মানুষদের নিজেই অপারেশন করতেন, টর্চার সেলে নিয়ে নির্যাতন করতেন। তাদের বানর বলে পিটিয়ে নিস্তেজ করতেন। তিনি স্বীকার করেছেন, এসব করে তিনি পৈশাচিক আনন্দ পেতেন। তার টর্চার সেল থেকে আলামত জব্দ করা হয়েছে।
হারুন অর রশীদ বলেন, মিল্টন ভয়াবহ অপরাধ করেছেন। তিনি একটি-দুটি অপরাধ করেননি। তাঁর বিরুদ্ধে ওঠা সব অভিযোগই ভয়াবহ। তিনি নিজেই এসব স্বীকার করেছেন। তাঁর হিসাব নম্বরে এখনও ১ কোটি ৪৫ লাখ টাকা রয়েছে। এত টাকা থাকার পরও তিনি কাউকে চিকিৎসা দেননি। তাঁর ওটিতে থাকত একটা ছুরি ও কিছু ব্লেড। এসব দিয়েই নিজে অপারেশন করতেন। এ রকম ভয়াবহ, অমানবিক, অসভ্য আচরণ দেশের মানুষের জন্য লজ্জাজনক।
রাজধানীর মিরপুর থেকে গত বুধবার রাতে মিল্টনকে গ্রেপ্তার করে ডিবি। তাঁর বিরুদ্ধে এরই মধ্যে ঢাকার মিরপুর মডেল থানায় ৩টি মামলা করা হয়েছে। আরও কয়েকটি মামলার প্রস্তুতি চলছে।