[ অনলাইন ] 06/05/2024 |
|
|
|
কোটি কোটি টাকা মিলেমিশে লুট |
|
|
বিশ্ববিদ্যালয়ের বোর্ড অব ট্রাস্টিজের (বিওটি) সদস্যরা নিয়েছেন মোটা অঙ্কের আর্থিক ও গাড়ির সুবিধা। নিয়ম না থাকলেও তুলে নেওয়া হয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়ের ৫ কোটি টাকার সুদসহ স্থায়ী আমানত। ব্যাংক থেকে স্থায়ী ক্যাম্পাস প্রতিষ্ঠার জন্য জমি কেনা ও ভবন নির্মাণে বিশ্ববিদ্যালয়ের নামে নেওয়া হয়েছে ১০ কোটি টাকার ঋণ। রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (রাজউক) অনুমোদন ছাড়াই ভবন নির্মাণ করা হয়েছে। আইনকানুনের তোয়াক্কা না করে বিওটি চেয়ারম্যানের আত্মীয়কে দেওয়া হয় সেই কাজ। বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) তদন্তে উঠে এসেছে বাংলাদেশ ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের কোটি কোটি টাকা লুটপাটের এমন চিত্র।
রাজধানীর মুগদা গ্রিন মডেল টাউনে অবস্থিত এ বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের আর্থিক অনিয়মের কারণে পুরো বিষয়টি বিশ্ববিদ্যালয়ের চ্যান্সেলর রাষ্ট্রপতির নজরে এনে বিওটি ভেঙে দেওয়ার কথা ভাবছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। এজন্য আগামীকাল সোমবার দুপুরে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সভাকক্ষে এক সভা আহ্বান করা হয়েছে। শিক্ষামন্ত্রী ব্যারিস্টার মহিবুল হাসান চৌধুরীর সভাপতিত্বে এ সভায় প্রতিমন্ত্রী শামসুন নাহার, মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের সচিব, ইউজিসির চেয়ারম্যান ছাড়াও গোয়েন্দা বিভাগসহ বিভিন্ন বিভাগের প্রতিনিধি অংশ নেবেন। সভায় বিশ্ববিদ্যালয়টির উপাচার্য, ট্রেজারার ও রেজিস্ট্রারকে উপস্থিত থাকতে বলা হয়েছে।
শিক্ষা মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, এ বিশ্ববিদ্যালয়ের বিষয়ে ইউজিসির পাঁচ সদস্যের তদন্ত দল বিশদ তদন্ত করে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে তাদের প্রতিবেদন পেশ করে। ইউজিসি সদস্য অধ্যাপক ড. বিশ্বজিৎ চন্দ তদন্ত কমিটির প্রধান ছিলেন। এ কমিটি তদন্তে বিশ্ববিদ্যালয়ে আর্থিক লুটপাটের ভয়াবহ চিত্র উদ্ঘাটিত হয়েছে।
জানা গেছে, যুদ্ধাপরাধের দায়ে আমৃত্যু কারাদণ্ডপ্রাপ্ত জামায়াত নেতা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের সময় ২০০৫ সালে নিজে আবেদন করে এ বিশ্ববিদ্যালয়টির অনুমোদন নিয়েছিলেন। পরে সাঈদীর বেয়াই ও জামায়াতের নেতা অধ্যাপক কামাল উদ্দীন আবদুল্লাহ জাফরীকে বিশ্ববিদ্যালয়ের ট্রাস্টি বোর্ডের চেয়ারম্যান করা হয়। সাময়িক অনুমতি নিয়ে চালু হওয়া এ বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুমতির মেয়াদ শেষ হয় বেশ আগেই। তবু তারা সরকারের কাছে স্থায়ী সনদের জন্য আবেদন করেনি। বিশ্ববিদ্যালয়টির স্থাপন ও পরিচালনার অনুমতির মেয়াদ উত্তীর্ণ হওয়ায় এবং বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আইন অনুযায়ী সনদপত্রের জন্য আবেদন দাখিল না করায় বর্তমানে বিশ্ববিদ্যালয়টির কার্যক্রমের আইনগত কোনো ভিত্তি নেই। শুরুতে চারটি মাত্র বিষয় নিয়ে চালু হওয়া এ বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ স্থায়ী আমানতের ৫ কোটি টাকা সুদসহ ব্যাংক থেকে তুলে নেওয়ায় ইউজিসি নতুন করে আর কোনো বিষয় খোলার অনুমতি দেয়নি। এসব কারণে একসময় শিক্ষার্থীর সংখ্যা ১০ হাজার ছাড়িয়ে গেলেও এখন তা দেড় হাজারে নেমে এসেছে।
করোনার সময় অবৈধভাবে ১০ জন শিক্ষককে চাকরিচ্যুত করে কর্তৃপক্ষ। চাকরিচ্যুতদের অভিযোগ, জামায়াত ঘরানার লোকদের দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনা করা হয়। করোনাকালে আর্থিক সংকটের অজুহাতে বেছে বেছে প্রগতিশীল ঘরানার শিক্ষকদের বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বের করে দেওয়া হয়। ইউজিসির তদন্তে এই অভিযোগ সত্য বলে প্রমাণিত হয়েছে। তদন্ত কমিটি তাদের চাকরিতে বহাল করার সুপারিশ করেছে।
ছয় কোটি টাকার বেশি সম্মানী বিওটি সদস্যদের দুর্নীতির বিষয়ে তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বিওটি চেয়ারম্যান, ভাইস চেয়ারম্যান ও সদস্য সচিব মিলে গত ১১ অর্থবছরে মাসিক সম্মানী হিসেবে ৬ কোটি ১৩ লাখ ৩২ হাজার টাকা নিয়েছেন। শুধু বিওটি চেয়ারম্যানই মাসে ৩ লাখ ৮০ হাজার টাকা করে বিশ্ববিদ্যালয় তহবিল থেকে ১১ বছরে মাসিক সম্মানী ও গাড়ি সুবিধা বাবদ নিয়েছেন ৩ কোটি ৬৬ লাখ ৬ হাজার ২১৩ টাকা। যেখানে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান নির্বাহীর দায়িত্বে থাকা উপাচার্য এর অর্ধেক পরিমাণ বেতনও পান না। যদিও ট্রাস্টি হিসেবে কোনো আর্থিক সুবিধাই নিতে পারেন না বিওটি চেয়ারম্যান। এ ছাড়া বিশ্ববিদ্যালয় থেকে গাড়ি, গাড়ির চালক, আবাসন ও একাধিক কর্মচারীসহ নানা সুবিধা নিচ্ছেন তিনি।
বিওটির ভাইস চেয়ারম্যান প্রফেসর ড. আ ন ম রফিকুর রহমান ১ কোটি ৩৩ লাখ ১৬ হাজার ৪৭৮ টাকা নিয়েছেন। সদস্য সচিব সৈয়দ শহীদুল বারী নিয়েছেন ১ কোটি ১৪ লাখ ৯ হাজার ৯৪০ টাকা। অথচ বিওটি ডিডে বলা আছে– এ ট্রাস্ট জনহিতকর, অলাভজনক ও অবাণিজ্যিকভাবে ইসলামী আদর্শে পরিচালিত হবে। অথচ বিওটির সদস্যরা এটাকে ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে পরিণত করেন। সদস্যরা সম্মানী ছাড়াও সিটিং অ্যালাউন্স বাবদ কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন। এ প্রতিষ্ঠানের ৯ ট্রাস্টির মধ্যে মাত্র চারজন সদস্য ১ কোটি ৫৬ লাখ ২৯ হাজার ৮৫৬ টাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠায় বিনিয়োগ করেন। বিওটি সদস্যদের অবৈধভাবে নেওয়া অর্থ বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আইন অনুযায়ী বিশ্ববিদ্যালয়ের তহবিলে জমা দেওয়ার সুপারিশ করা হয়েছে প্রতিবেদনে। একই সঙ্গে দুর্নীতি দমন কমিশনে (দুদক) মামলার সুপারিশ করা হয়েছে।
বিওটির সদস্য সচিব হিসেবে রয়েছেন কামালউদ্দীন জাফরীর ভাই সৈয়দ শহীদুল বারী। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্ল্যানিং অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের পরিচালকের পদটিও তাঁর দখলে। অভিযোগ রয়েছে, নিয়মিত অফিস না করেও মাসে ১ লাখ টাকার বেশি আর্থিক সুবিধা নেন তিনি। এমনকি মাসের পর মাস বিদেশে অবস্থান করেও নিয়মিত বেতন নিয়েছেন। এ ছাড়া শহীদুল বারী বিশ্ববিদ্যালয়ের এসি খুলে নিজের বাসায় নিয়ে লাগিয়েছেন বলে অভিযোগ করেছেন শিক্ষক-কর্মকর্তারা।
বিওটি চেয়ারম্যানের ছেলে সৈয়দ আম্মার বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ অ্যাসিস্ট্যান্ট (সুপারভাইজার) হিসেবে কাজ করছেন। ঢাকার বাইরে অবস্থান করেই বছরের পর বছর বিশ্ববিদ্যালয় তহবিল থেকে নিয়মিত বেতন নিচ্ছেন তিনি। এ ছাড়া বিশ্ববিদ্যালয়টির বিভিন্ন একাডেমিক ও প্রশাসনিক পদে বিওটি চেয়ারম্যানের আত্মীয়স্বজন কর্মরত রয়েছেন। শিক্ষক-কর্মকর্তাদের অভিযোগ, অবৈধভাবে আর্থিকসহ নানা সুবিধা নিলেও বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়নে কোনো উদ্যোগ নেননি দেখভালের দায়িত্বে থাকা বিওটি সদস্যরা। চেয়ারম্যানসহ কয়েকজন সদস্যের অনিয়ম, অবহেলা ও অব্যবস্থাপনাই বিশ্ববিদ্যালয়কে দুর্দশার দিকে ঠেলে দিয়েছে।
গুরুতর সব আর্থিক অনিয়ম গত ১১ বছরের নথি পর্যালোচনা করে দেখা যায়, ব্যাংক ঋণ ও সংরক্ষিত তহবিল মিলে ১৫ কোটি টাকার বেশি অর্থ উত্তোলন করা হয়েছে। যার মধ্যে সম্মানীই বড় অঙ্কের। তদন্তে বলা হয়, ‘বিশ্ববিদ্যালয়টি যখন চরম আর্থিক দৈন্যদশার মধ্য দিয়ে যাচ্ছিল, তখনও চেয়ারম্যান, ভাইস চেয়ারম্যান ও সদস্য সচিব তাদের নির্ধারিত মাসিক বেতন তথা সম্মানী নিয়েই যাচ্ছেন। বিষয়টি অনেকটা ঋণ করে হলেও ঘি খাওয়ার মতো। যেখানে ট্রাস্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের মানোন্নয়নে কাজ করার কথা, সেখানে উল্টো তারাই বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য ক্ষতিকর ভূমিকা পালন করেছে।’ তদন্ত কমিটির সদস্যরা সমকালকে জানান, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আইন অনুযায়ী বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের সাধারণ তহবিলের অর্থ ওই বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রয়োজনীয় ব্যয় ব্যতীত অন্য কোনো উদ্দেশ্যে ব্যয় করা যাবে না। আগেও একাধিকবার ইউজিসি ও সরকার থেকে এ বিষয়ে নির্দেশনা দিলেও বিশ্ববিদ্যালয়টির বোর্ড অব ট্রাস্টিজ কোনোরূপ ভ্রুক্ষেপ না করে মাসিক বেতন-ভাতা এবং সিটিং অ্যালাউন্স গ্রহণ অব্যাহত রেখেছে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের দেওয়া তথ্য ও ব্যাংক হিসাব বিবরণী পর্যালোচনা করে দেখা যায়, বিশ্ববিদালয়ের নামে আইন অনুযায়ী এফডিআর খোলা হলেও এফডিআরের বিপরীতে পাওয়া সুদ এবং আসল তুলে নেওয়া হয়েছে, যা বিশ্ববিদ্যালয় আইনের সুস্পষ্ট লঙ্ঘন। এ জন্য ৫ বছরের কারাদণ্ড অথবা ১০ লাখ টাকা পর্যন্ত অর্থদণ্ড অথবা উভয়বিধ দণ্ডের বিধান রয়েছে।
নাম পরিবর্তন চায় ইউজিসি প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ‘ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, বাংলাদেশ’ নামে ১৯৮০ সালে কুষ্টিয়ায় একটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। নামের সাদৃশ্য রয়েছে এমন অন্য কোনো বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন করা যাবে না বিধান থাকলেও ‘বাংলাদেশ ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়’ নামকরণ করা হয়েছে। তদন্ত কমিটি বিশ্ববিদ্যালয়টির নাম পরিবর্তন করার সুপারিশ করেছে। ইউজিসির সুপারিশ ইউজিসি মন্তব্য করেছে, প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকে ১৯ বছরে বিশ্ববিদ্যালয়টি আইন যথাযথভাবে অনুসরণের কোনো চেষ্টাই করেনি। সার্বিক বিবেচনায় বিশ্ববিদ্যালয়টির চলমান অচলাবস্থা নিরসনকল্পে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আইন অনুযায়ী চ্যান্সেলরের এখতিয়ার প্রয়োগ করে জরুরি ভিত্তিতে বোর্ড অব ট্রাস্টিজ পুনর্গঠনের প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য সুপারিশ করা হয়।
বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের বক্তব্য আর্থিক অনিয়মের বিষয়ে বাংলাদেশ ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. আমিনুল হক ভূঁইয়া সমকালকে বলেন, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়কে নানা চ্যালেঞ্জের ভেতর দিয়ে যেতে হয়। তাই সব বিষয়ে সবকিছু সদুত্তর সব সময় দেওয়া যাবে, এমনটি নয়। আপনি তো সব জেনেশুনেই কথা বলছেন। আমি আর এ বিষয়ে কী বলব? বিওটি সদস্যদের লুটপাটের কারণেই বিশ্ববিদ্যালয়ে আর্থিক সংকট তৈরি হয়েছে কিনা প্রশ্নে তিনি বলেন, আর্থিক টানাপোড়েন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে থাকেই। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়েও থাকে। মন্ত্রণালয়ের বৈঠকের বিষয়ে উপাচার্য বলেন, আমি যাব। আমাদের যা বলার বৈঠকেই বলব।
যা বলছে ইউজিসি ইউজিসি সদস্য ও তদন্ত দলের প্রধান অধ্যাপক ড. বিশ্বজিৎ চন্দ বলেন, শিক্ষকদের চাকরিচ্যুত করার ঘটনা তদন্ত করতে গিয়ে ট্রাস্টি বোর্ড চেয়ারম্যান ও তাঁর পরিবারের সদস্যদের বিভিন্ন অবৈধ সুবিধা গ্রহণের বিষয়টি তাদের নজরে আসে। বিশেষ করে বিওটি চেয়ারম্যান মাসে ৩ লাখ ৮০ হাজার টাকা সম্মানী হিসেবে নেন বলে প্রমাণ পাওয়া গেছে। বিওটি চেয়ারম্যানের আত্মীয়স্বজন অফিস না করেও মাসের পর মাস বেতন নিচ্ছেন। অবশ্যই তাদের কাছ থেকে এসব অর্থ বিশ্ববিদ্যালয় তহবিলে ফেরত ও তাদের বিরুদ্ধে আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হবে। |
News Source
|
|
|
|
|
|
|
|
Today's Other News
|
Related Stories |
|
|
|
|