[ পাতা ১ ] 06/05/2024 |
|
|
|
পুঁজিবাজারের ‘খলনায়ক’ ফারুক |
|
|
বড় ভাই পুলিশের বড়কর্তা, ছোট ভাই ব্যারিস্টার।
প্রবঞ্চনার চিত্রনাট্যে তারা অন্তরালে। তবে আপন দু’ভাইয়ের উদ্দীপনায় আবদুল
কাদের ফারুক পুঁজিবাজারের এক ‘দুঃসাহসী খলনায়ক’। শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত
তিন কোম্পানির এই উদ্যোক্তা ‘ফার’ গ্রুপের চেয়ারম্যান। শেয়ার নিয়ে এক
যুগেরও বেশি সময় চলছে ফারুকের অবিশ্বাস্য ভেলকি। ধরাকে সরা জ্ঞান করে পুরো
পরিবার নিয়ে তিনি গাছের খাচ্ছেন, তলারও কুড়াচ্ছেন। সঙ্গে পাচ্ছেন খোদ
শেয়ারবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ
কমিশনের (বিএসইসি) আশকারা। নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিএসইসির নানা তদন্ত
প্রতিবেদন, ফারুকের বিরুদ্ধে শাস্তির ব্যবস্থাবিষয়ক নথি, উচ্চ আদালতে মামলা
এবং সংশ্লিষ্ট সূত্রের অনেক তথ্য-প্রমাণ পেয়েছে সমকাল।
‘গভীর জলের
মাছ’ হয়ে শেয়ারবাজারের নানা চোরাপথে হেঁটেছেন ফারুক। এই যেমন, আইপিওর আগে
এক পয়সাও লগ্নি না করে জালিয়াতির মাধ্যমে ভুয়া শেয়ার ইস্যু করেন। বাজারে
আসার আগেই প্রথমে এ শেয়ারের কিছু অংশ প্রাইভেট প্লেসমেন্ট প্রক্রিয়ায়
বিক্রি করে নগদ টাকা লুটে নেন। পরে ওই কোম্পানিকে বাজারে তালিকাভুক্ত করে
বাকি শেয়ার বেচে শত শত কোটি টাকা হাতিয়ে নেন। আবার কখনও তালিকাভুক্ত চালু
কোম্পানিকে লোকসানি সাজিয়ে ওই প্রতিষ্ঠানের টাকা ও সম্পদে নিজের নামে
আরেকটি ব্যক্তিমালিকানাধীন কোম্পানিতে হস্তান্তর করেন। পরে কৌশলে ওই
কোম্পানি তালিকাভুক্ত করে নিজে ওঠেন টাকার চূড়ায়, আর সাধারণ বিনিয়োগকারীকে
বসিয়ে দেন পথে।
এক-দুই বছর নয়; এক যুগের বেশি সময় এভাবে শেয়ারবাজারে
‘রাজ’ করছেন আবদুল কাদের ফারুক ও তাঁর সঙ্গীরা। তবে কারসাজির বিষয়ে নিরেট
প্রমাণ থাকলেও ফারুকসহ তাঁর দলবলের বিরুদ্ধে বিএসইসি কোনো সময় কঠোর
ব্যবস্থা নেয়নি। শুধু আলোচনা-সমালোচনা ছাইচাপা দিতে আলাদা সাত ঘটনায় আর্থিক
জরিমানা করে বিএসইসি, টাকার অঙ্কে যা মাত্র দুই কোটি। অবশ্য তাঁর বিরুদ্ধে
যত টাকার অনিয়মের প্রমাণ নিয়ন্ত্রক সংস্থার হাতে আছে, সে তুলনায় এ
জরিমানার অঙ্ক লোক দেখানো বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা। ফারুকের বিরুদ্ধে এমন
সব অভিযোগ আছে, কেঁচো খুঁড়তে সাপ বের হওয়ার শঙ্কায় সেসব অভিযোগের গর্তে
হাতই দেননি বিএসইসির শীর্ষ কর্তাদের কেউ কেউ।
দুই নম্বরিতে
সিদ্ধহস্ত ফারুক একদিকে নিজের কোম্পানির শেয়ার নিয়ে দু’হাত ভরেন। পাশাপাশি
বাজারের অন্য কোম্পানির শেয়ার নড়াচড়া করে কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা কামাচ্ছেন।
রাজধানীর রামপুরার বেটার লাইফ হাসপাতালের মালিক ফারুকের এমন অপকীর্তির
সঙ্গী তাঁর পরিবারের প্রায় সব সদস্য। তাদেরই একজন পুলিশের স্পেশাল
ব্রাঞ্চের (এসবি) ডিআইজি আবদুল কুদ্দুস আমীন; তিনি ফারুকের আপন বড় ভাই।
দুষ্কর্মের শাস্তি থেকে রেহাই পেতে ফারুক তাঁর এই ‘পুলিশ ভাই’য়ের নাম-পরিচয়
ব্যবহার করেন বলে সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্র নিশ্চিত করেছে। জেনেবুঝেই ছোট
ভাইয়ের ‘আশ্রয়দাতা’ হিসেবে কাজ করছেন ডিআইজি। ছোট ভাইকে কারসাজিতে সহায়তা
করে তিনিও নিজের ভাগ পকেটে তোলেন। ফারুকের ছোট ভাই সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী
ব্যারিস্টার আবদুল মাবুদ মাসুমও ফারুককে ‘সাধু’ দেখাতে নানাভাবে সহায়তা
করছেন বলে তথ্য মিলেছে। ব্যারিস্টার মাসুম সুপ্রিম কোর্টে শেয়ারবাজার
নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিএসইসি ও বাংলাদেশ ব্যাংকের পক্ষে প্যানেলভুক্ত আইনজীবী।
২০১৫
সালের জুলাই থেকে ২০১৬ সালের জুন পর্যন্ত আরএন স্পিনিংয়ের শেয়ার কারসাজিতে
ব্যারিস্টার মাসুম ও ফারুকের স্বার্থসংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান এবং পরিবারের
সদস্যরা জড়িত ছিলেন। এ ঘটনার সঙ্গে ব্যারিস্টার মাসুমের অলাভজনক আইনি
প্রতিষ্ঠান দ্য লয়ার্স অ্যান্ড জুরিস্টসও ছিল বলে প্রমাণ হয়। এ ঘটনায় ২০২২
সালের ২২ ফেব্রুয়ারি ফারুক ও তাঁর পরিবারের সংশ্লিষ্ট সদস্যদের নামমাত্র ১০
লাখ টাকা করে জরিমানার শাস্তি দেয় বর্তমান কমিশন।
রিং শাইন টেক্সটাইল নিয়ে ছলনার নয়া স্টাইল
২০১৯
সালে শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত হওয়া রিং শাইন টেক্সটাইলের আইপিও নিয়ে ফারুক
এমন অবিশ্বাস্য ‘খেলা’ খেলেছেন, যা আগে কেউ কখনও দেখেনি। একদিকে নিজে
লগ্নি ছাড়াই শত শত কোটি টাকা পকেটে নেন; অন্যদিকে আয়ের লোভ দেখিয়ে সাভারে
ঢাকা ইপিজেডের কোম্পানি রিং শাইন টেক্সটাইলের বিদেশি মালিকদের ফাঁদে
ফেলেন। ‘অতিলোভে তাঁতি নষ্ট’ হয়ে ওই বিদেশি মালিকরা একসময় নিজেদের
কোম্পানির নিয়ন্ত্রণ হারান। দেশত্যাগে নিয়ন্ত্রক সংস্থার বিধিনিষেধের কারণে
এখন চাইলেও আপন নিবাসে ফিরতে পারছেন না তারা।
২০১৬ সালে রিং শাইনের
মালিকদের লগ্নি ছাড়া বিশাল অঙ্কের বিনিয়োগ দেখিয়ে কোম্পানি তালিকাভুক্ত
করে দেওয়ার একটি ‘চুক্তি’ করেন ফারুক। এ চুক্তিবলে ওই কোম্পানিতে নিজের লোক
বসিয়ে জাল আর্থিক প্রতিবেদন ও পছন্দসই অডিটরকে দিয়ে নিরীক্ষা প্রতিবেদন
তৈরি করেন তিনি। ভুয়া লগ্নি দেখিয়ে ১০ কোটি টাকারও কম পরিশোধিত রিং শাইনের
মূলধন ২৮৫ কোটি টাকায় নিয়ে যান। ২৭৫ কোটি টাকার মূলধন বাড়ানো বা শেয়ার
ইস্যুর বিপরীতে একটি টাকাও রিং শাইনের কোম্পানির হিসাবে জমা দেননি ফারুক।
টানা তিন বছর ভুয়া আর্থিক প্রতিবেদন তৈরি করতে কোম্পানির কেউ না হয়েও
সাউথবাংলা এগ্রিকালচার ব্যাংকে দুটি হিসাব খুলে লেনদেন করেন। এর মাধ্যমে
শেয়ার মানি ডিপোজিট (শেয়ার কিনতে টাকা জমা) দেখাতে জালিয়াতির ব্যাংক
স্টেটমেন্ট তৈরি করেন ফারুক।
আবার এই টাকার ভুয়া ব্যবহার দেখাতে
অলীক বিনিয়োগ-রপ্তানি দেখিয়ে আয়ের নথি তৈরি করা হয়। এভাবে ১০ টাকা অভিহিত
মূল্যের সাড়ে ২৭ কোটি শেয়ার ইস্যু করেন তিনি। ইস্যু করা এ শেয়ারের প্রায় ৬০
শতাংশ দেন বিদেশি মালিকদের। বাকি ৪০ শতাংশ নিয়েছেন ফারুক নিজে, মা, কয়েক
স্ত্রীসহ পরিবারের অন্য সদস্য এবং স্বার্থসংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের নামে।
২০১৯ সালে এ শেয়ারের কিছু অংশ বেচে নিজেই আত্মসাৎ করেন। এই ভুয়া শেয়ারের
ভাগ ফারুকের ভাই ডিআইজি আবদুল কুদ্দুস আমীনও পেয়েছেন।
২০২১ সালে
তদন্তে আইপিও কারসাজি ধরা পড়ার পর এসব শেয়ার বাতিলের ঘোষণা দিয়েছিল
বিএসইসি। তবে অদৃশ্য কারণে তিন বছর পরও শেয়ারগুলো বাতিল করেনি সংস্থাটি।
এই আইপিও জালিয়াতির পর কোম্পানির মূল বিদেশি মালিকরা বড় বিপদে পড়লেও ফারুক
এরই মধ্যে নিজের পরিবারের সদস্যদের নামে নেওয়া শেয়ারের উল্লেখযোগ্য অংশ
(অন্তত ৭০ কোটি টাকার) বেচে দিয়েছেন। খোদ বিএসইসির শীর্ষ কর্মকর্তারাই
তাঁকে এ সুযোগ করে দেন।
নিয়ন্ত্রক সংস্থার শীর্ষ কর্তারাই যখন
কারসাজির হোতাকে আশ্রয়-প্রশ্রয় দেন, তখন বিএসইসিতে তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ
কিংবা প্রতিকার চেয়ে কোনো লাভ হয় না। তবে ভরসার শেষ আশ্রয়স্থল হিসেবে
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে নালিশ নিয়ে যান রিং শাইন টেক্সটাইলের এমডি
সুং ওয়েন লি অ্যাঞ্জেলা। গত ৩১ জানুয়ারি নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিএসইসির দুই
শীর্ষ কর্তা, আবদুল কাদের ফারুকসহ সংশ্লিষ্ট কয়েকজনের বিরুদ্ধে
প্রধানমন্ত্রীর কাছে লিখিত অভিযোগ করেন। ওই অভিযোগে রিং শাইন টেক্সটাইলের
আইপিওতে ফারুকের প্রতারণা ও জালিয়াতির বিস্তারিত তুলে ধরা হয়।
প্রধানমন্ত্রীর কাছে দেওয়া অভিযোগপত্রে তিনি লেখেন, আইপিও শেষে ২০১৯ সালের
নভেম্বরে ফারুক হুমকি দিয়ে ২০ কোটি টাকা চাঁদা নিয়েছেন।
এ ঘটনার
প্রতিকার চাইতে প্রধানমন্ত্রীর কাছে পাঁচ মিনিটের সময় চেয়ে আবেদন করেছিলেন
লি অ্যাঞ্জেলা। তিনি সময় পেয়েছিলেন কিনা, তা জানতে পারেনি সমকাল। তবে
প্রধানমন্ত্রীর দপ্তর তাঁর অভিযোগ গুরুত্বের সঙ্গে নিয়েছিল। ৩১ জানুয়ারি
অভিযোগ পাওয়ার পর অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগকে (এফআইডি) এ
বিষয়ে অনুসন্ধানের আদেশ দিয়ে চিঠি দেয়। ৪ ফেব্রুয়ারি এফআইডি ব্যাখ্যা চায়
বিএসইসির কাছে।
গেল ৮ ফেব্রুয়ারি সংস্থার নির্বাহী পরিচালক সাইফুর
রহমানের সইয়ে একটি ব্যাখ্যা পাঠায় বিএসইসি। ওই ব্যাখ্যায় বিদেশি
উদ্যোক্তাদেরই রিং শাইনের আইপিও জালিয়াতির জন্য প্রধানত দায়ী করে। যদিও
বিএসইসির ব্যাখ্যার সঙ্গে এ বিষয়ক যে তদন্ত প্রতিবেদন সংযুক্ত করে, তাতে এ
আইপিও কারসাজির মূল হোতা হিসেবে ফারুককে চিহ্নিত করা হয়। বিএসইসি ব্যাখ্যায়
উল্লেখ করে, আগামী এক মাসের মধ্যে দায়ীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
এফআইডিকে প্রতিশ্রুতি দেওয়ার দুই মাস পার হলেও ব্যবস্থা নেওয়ার ব্যাপারটি
‘কথার কথা’ হিসেবে ফাইলবন্দি হয়ে আছে। এ ছাড়া সব ভুয়া শেয়ার বাতিলসহ
দোষীদের বিরুদ্ধে ফৌজদারি মামলা করার ২০২১ সালের সেই ঘোষণাও সেখানে থমকে
আছে।
চতুর ফারুকের সবশেষ জোচ্চুরি
ফারুক চক্র সর্বশেষ
জোচ্চুরি করেছে শেয়ারবাজারে নিজেদের তালিকাভুক্ত দুই কোম্পানির সঙ্গে
নিজেদেরই ব্যক্তিমালিকানাধীন দুই কোম্পানির একীভূতকরণে (মার্জার)। এক পয়সাও
বিনিয়োগ না করে গোপনে শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত আরএন স্পিনিংয়ের টাকা ও
সম্পদ নিজেদেরই নামসর্বস্ব কোম্পানি সামিন ফুড অ্যান্ড বেভারেজ
ইন্ডাস্ট্রিজে স্থানান্তর করা হয়। এরপর জালিয়াতি করে সামিন ফুডকে একীভূত
করা হয় আরএন স্পিনিংয়ের সঙ্গে। উচ্চ আদালতের সংশ্লিষ্ট আইনজীবী সূত্রে
পাওয়া নথি থেকে এ তথ্য জানা গেছে।
জালিয়াতি করে একীভূতকরণের পর
ফারুকদের আরএন স্পিনিংয়ের শেয়ার এতটাই লাফ দেয়, যা দেখে বিনিয়োগকারীর চোখ
কপালে ওঠে। একীভূতকরণের আগে আরএন স্পিনিংয়ে শেয়ারদর যেখানে ৭৩ কোটি টাকা
ছিল, পরে তা বেড়ে ৩৭৬ কোটি টাকায় ঠেকে। অন্যদিকে যাদের টাকা ও সম্পদে
ফারুকদের শেয়ারদর পাঁচ গুণ হয়েছে, সেই সাধারণ বিনিয়োগকারীর শেয়ারমূল্য ১৭০
কোটি টাকা থেকে কমে ৭৩ কোটি টাকায় নামে।
সংশ্লিষ্ট আইনজীবী সূত্রে
পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, হাইকোর্ট এই একীভূতকরণ বিষয়ে পর্যবেক্ষণ চেয়ে আদেশ
দিলে বিএসইসির আইন বিভাগ যে পর্যবেক্ষণ প্রতিবেদন তৈরি করেছিল, তাতেই এ
জালিয়াতির চিত্র উঠে আসে। ফারুকের সর্বশেষ জালিয়াতির চেষ্টা আটকে দিতে
সুপ্রিম কোর্টে নিজস্ব প্যানেল আইনজীবীর বাইরে গিয়ে স্বনামধন্য আইনজীবী
ব্যারিস্টার শাহ্দীন মালিককে নিয়োগ করেছিল সংস্থাটি। তবে বিএসইসিরই শীর্ষ
এক কর্মকর্তা ব্যারিস্টার শাহ্দীন মালিককে বাদ দিয়ে ব্যারিস্টার শফিকুল
কবীর তাপসকে নিয়োগ দেন। পরে ওই প্রতিবেদন হাইকোর্টে উপস্থাপনই করতে দেওয়া
হয়নি। হাইকোর্ট ভিন্ন কোনো পর্যবেক্ষণ বা আপত্তি না পেয়ে আরএন স্পিনিংয়ের
একীভূতকরণ স্কিম অনুমোদন করেন। বিএসইসির কমিশনার শেখ শামসুদ্দিন আহমেদ
হাইকোর্টের এ আদেশের বিরুদ্ধে আপিল করতে বলেন। তবে শীর্ষ ওই কর্মকর্তা আপিল
করতেও বাধা দেন।
ঠিক একই রকম ঘটনা ঘটে তালিকাভুক্ত ফার কেমিক্যালের
ক্ষেত্রে। এ কোম্পানির সঙ্গে এসএফ টেক্সটাইল নামের কোম্পানি একীভূত করা
হয়। এসএফ টেক্সটাইলের আইপিও ২০২১ সালে বিএসইসির বর্তমান কমিশন বাতিল
করেছিল। আরএন স্পিনিংয়ের মতো এসএফ টেক্সটাইলের জাল-জালিয়াতির পথও সুগম করে
দিয়েছিলেন বিএসইসির শীর্ষ এক কর্মকর্তাই।
এ ব্যাপারে তাঁর বক্তব্য
জানতে আবদুল কাদের ফারুককে ফোন করা হলে তিনি সাড়া দেননি। তবে পরে অফিসে
আমন্ত্রণ জানিয়ে ফার গ্রুপের ম্যানেজার (করপোরেট অ্যাফেয়ার্স) সুদীপ বণিক
দাবি করেন, একীভূতকরণে অনিয়ম হয়নি। অনিয়ম হলে একীভূতকরণ স্কিম হাইকোর্ট
অনুমোদন করত না, বিএসইসিও এটা হতে দিত না। তবে সুদীপ স্বীকার করেন,
একীভূতকরণ স্কিম ঘোষণা করলে তদন্ত কমিটি গঠন করেছিল বিএসইসি। ওই কমিটি ভালো
প্রতিবেদন দেয়।
ধান্ধা শুরু এক যুগ আগে
২০১২ সালের আরএন
স্পিনিংয়ের রাইট শেয়ার কেলেঙ্কারির মাধ্যমে ফারুকের জোচ্চুরির শুরু। ব্যবসা
সম্প্রসারণে আরএন স্পিনিং কোম্পানির ১০ টাকা অভিহিত মূল্যের রাইট শেয়ার ২০
টাকা দরে বিক্রি করে ২৭৮ কোটি টাকা সংগ্রহের ফন্দি আঁটেন ফারুক। সে সময়ের
ড. খায়রুল হোসেনের নেতৃত্বাধীন বিএসইসি এই রাইট শেয়ার প্রস্তাব অনুমোদন
করে। তবে এ রাইট শেয়ার প্রস্তাবের বিপরীতে সাধারণ বিনিয়োগকারীর কাছ থেকে
১২০ কোটি টাকা সংগ্রহ করলেও উদ্যোক্তা-পরিচালকরা নিজেদের ১৭২ কোটি টাকা জমা
করেননি। এ নিয়ে হইচই শুরু হলে কমিশন সময় বাড়িয়ে ফারুকদের রাইট শেয়ারের
টাকা জমা দেওয়ার নির্দেশ দেন। তিন পরিচালক শিরিন ফারুক (ফারুকের তৃতীয়
স্ত্রী), কিম জং সুক ও এমএল ডাইংয়ের (ফারুকের আরেক কোম্পানি) নামে ১৬০ কোটি
২৬ লাখ টাকা জমা করেছেন মর্মে নথি বিএসইসিতে জমা দেন কোম্পানির তৎকালীন
সচিব হুমায়ুন কবির। তবে নির্ধারিত ব্যাংক এশিয়ার হিসাবে জমা না করে অগ্রণী
ব্যাংকের প্রিন্সিপাল শাখায় কোম্পানির নিজস্ব করপোরেট হিসাবে এ টাকা জমা
করা হয়েছে বলে নথিতে জানানো হয়।
এ নিয়ে সন্দেহ হলে বিএসইসি তদন্তে
নেমে দেখতে পায়, অগ্রণী ব্যাংকের প্রিন্সিপাল শাখায় আরএন স্পিনিংয়ের অন্য
একটি হিসাব থেকে ওই পরিমাণ টাকা একই দিনে জমা ও তোলার মাঝে রাইট শেয়ার
সাবস্ক্রিপশনের শেয়ার মানি ডিপোজিটের ভুয়া ব্যাংক স্টেটমেন্ট নেন
কোম্পানি-সংশ্লিষ্টরা। এ জালিয়াতির ঘটনায় ফারুকসহ সংশ্লিষ্ট সবার বিরুদ্ধে
মতিঝিল থানায় মামলা করে বিএসইসি। পাশাপাশি ফারুক, হুমায়ুন কবিরসহ কয়েকজনকে
শেয়ারবাজার-সংশ্লিষ্ট কোম্পানির দায়িত্ব পালন থেকে পাঁচ বছরের জন্য নিষিদ্ধ
করা হয়। তবে ফারুক এ মামলার বিরুদ্ধে হাইকোর্টে রিট করলে তা স্থগিত হয়ে
যায়। বিএসইসির সাবেক কমিশন ওই রিটের বিরুদ্ধে আপিল না করায় এক যুগেও তা আর
নিষ্পত্তি হয়নি। বর্তমান কমিশন দায়িত্ব নেওয়ার পর একই নীতি অনুসরণ করছে।
এখনকার কমিশন দায়িত্ব নেওয়ার আগে এ মামলায় বিএসইসির পক্ষে নিযুক্ত আইনজীবী
ছিলের প্রবীর নিয়োগী। তাঁর বদলে এখন ব্যারিস্টার শফিকুল কবীর তাপসকে
আইনজীবী নিয়োগ করা হয়েছে।
এ মামলার পাশাপাশি উদ্যোক্তা-পরিচালকরা
সাধারণ বিনিয়োগকারীর কাছ থেকে রাইট শেয়ার সাবস্ক্রিপশনের টাকা জমা নিলেও
নিজেরা তা সাবস্ক্রিপশন না করায় ২০১৩ সালের ২৭ জানুয়ারি খায়রুল কমিশন
ফারুকসহ দুই পরিচালককে ৫০ লাখ করে এক কোটি টাকা, ফারুকের স্ত্রী ও পরিচালক
শিরিন ফারুককে ২৫ লাখ টাকা এবং কোম্পানিকে ১০ লাখ টাকা (মোট ১ কোটি ৩৫
টাকা) জরিমানা করে।
আরএন স্পিনিংয়ের রাইট কারসাজির ঘটনা সেখানে থেমে
থাকেনি। সোয়া কোটি টাকার মতো জরিমানা গোনার পর আরএন স্পিনিংয়ের সাধারণ
বিনিয়োগকারীর টাকা ব্যবহার নিয়ে নয়ছয়ের অভিযোগ ওঠে ফারুকের বিরুদ্ধে।
সাধারণ বিনিয়োগকারীর রাইট সাবস্ক্রিপশন থেকে পাওয়া ১২০ কোটি থেকে ৫৭ কোটি
৬৪ লাখ টাকা নগদে খরচ করেন ফারুক ও তাঁর দলবল; যেখানে এক লাখ টাকার বেশি
খরচ ব্যাংক হিসাবের মাধ্যমে করার আইনি বাধ্যবাধকতা ছিল।
বিএসইসির
কর্মকর্তারা মনে করেন, উল্লেখযোগ্য অংশ আত্মসাৎ করতে নগদে টাকা তুলে নেওয়া
হয়। এ অপরাধে ২০২২ সালের ২১ জুন ফারুককে এককভাবে মাত্র ৩০ লাখ টাকা ও দুই
পরিচালকসহ চারজনকে মাত্র ২০ লাখ টাকা জরিমানা করে বিএসইসি।
এর দুই
বছর পার না হতেই রাইট শেয়ার কেলেঙ্কারির ঘটনায় নিজেদের সম্পৃক্ততার তথ্য
আইপিও পরিচিতি পুস্তিকায় উল্লেখ না করে নিজেদের ফার কেমিক্যালের আইপিও
আবেদন করেন আবদুল কাদের ফারুক। ড. খায়রুল হোসেনের কমিশন তা অনুমোদনও করে।
বিষয়টি জানাজানি হলে এবারও সমালোচনা এড়াতে ২০১৪ সালের ৩১ ডিসেম্বর ফার
কেমিক্যালকে ৫ লাখ ও ইস্যু ম্যানেজার ফার্স্ট সিকিউরিটিজ সার্ভিসেসকে
(মার্চেন্ট ব্যাংক) ৫ লাখ টাকা জরিমানা করে কমিশন। তবে ফার কেমিক্যালের
আইপিও নিয়ে জালিয়াতির অভিযোগ থাকলেও তা খতিয়ে দেখেনি বিএসইসি।
এসব
বিষয়ে জানতে ড. খায়রুল হোসেনের মোবাইলে ফোন করা হলে সাড়া দেননি তিনি। পরে
মোবাইল ফোনে বা সরাসরি সাক্ষাৎ চেয়ে এসএমএস করা হলে তাতেও তিনি সাড়া দেননি।
ধোঁকাবাজিতে ফারুক পরিবারের ১৮ সদস্য
রাইট শেয়ার ইস্যুতে
একের পর এক জালিয়াতি এবং বড় অঙ্কের টাকা আত্মসাতের পর ২০১৫ সালে সেকেন্ডারি
শেয়ারবাজারে ফ্যামিলিটেক্স নামে কোম্পানির শেয়ার নিয়ে ধোঁকাবাজির অভিযোগ
ওঠে ফারুকের বিরুদ্ধে। বিএসইসির তদন্তে দেখা যায়, এ কারসাজিতে তাঁর
পরিবারের ১৮ সদস্য জড়িত। স্বার্থসংশ্লিষ্ট কোম্পানি রাজন টেক্সটাইল, টোটাল
স্পিনিং, চং ওয়ং এআরএস সোয়েটার, এমএল স্টিল মিলস, এসএফ টেক্সটাইল, ফার হোমস
এবং ফারুকের ছেলে আবিদ মোস্তাফিজুর রহমান, রেজানুর রহমান রাজন, মেয়ে
রেজওয়ানা রহমান রিনি, দ্বিতীয় স্ত্রী নাসরিন আক্তার বানু, প্রথম স্ত্রী
হোসনে আরা বেগম, ভাই আরিফ বিল্লাহ, ভাই মহিবুল্লাহ কবির ও তাঁর মালিকানাধীন
ইকোনো বাটন অ্যান্ড অ্যাক্সেসরিজ, বোন নুরুন্নেসা সাকি ও আরিফা বেগম লাকির
নামে মোট ১৯টি বিও অ্যাকাউন্ট থেকে ২০১৬ সালের ১৬ মে থেকে ৬ জুন পর্যন্ত
ক্রমাগত কেনাবেচা করে ২ কোটি ৫৫ লাখ টাকা নগদ (রিয়েলাইজড) মুনাফা করেন
ফারুক। এর বাইরেও তাঁর ৪০ লাখ টাকার বেশি আনরিয়েলাইজড মুনাফা ছিল। ফারুকদের
এসব বিও অ্যাকাউন্টের ১৫টি ছিল প্রাইম ইসলামী সিকিউরিটিজে। বাকি চারটি বিও
ছিল আইএল ক্যাপিটাল ও আজম সিকিউরিটিজে।
এ কারসাজির তদন্তে উঠে আসে
ফ্যামিলিটেক্সের প্রি-আইপিও প্লেসমেন্টে ফারুকের নিজের ৫২ লাখ শেয়ারসহ ভাই
মহিবুল্লাহ কবির ও আরিফ বিল্লাহ এবং দুই ছেলে আবিদ মোস্তাফিজুর রহমান ও
রেজানুর রহমান রাজনের বিও অ্যাকাউন্টে ১ কোটি ২২ লাখ শেয়ার ছিল। তবে ২০১৬
সালের ১৫ মে উল্লিখিত ১৯টি বিওতে ফ্যামিলিটেক্সের কোনো শেয়ার ছিল না।
অর্থাৎ ওই দিনের আগেই নিজেদের প্লেসমেন্ট শেয়ার বিক্রি করে মুনাফা নিয়ে নেন
ফারুক ও তাঁর দলবল। ওই বছরের ১৬ মে থেকে ফের শেয়ার কেনা শুরু করেন তারা।
ওই দিন প্রাইম ইসলামী সিকিউরিটিজের গ্রাহক জুন কিং ওন এর কাছ থেকে ব্লক
মার্কেটের মাধ্যমে ২ কোটি ৯ লাখ ৭৫ হাজার শেয়ার কেনা দিয়ে এ কারসাজি শুরু।
এর পর ৬ জুন পর্যন্ত ফ্যামিলিটেক্সের বিপুল পরিমাণ শেয়ার কেনাবেচা করেন।
শেয়ারটির দাম বাড়াতে নিজেরা এত বেশি সার্কুলার ট্রেড করেন যে, ওই ১১
কার্যদিবসে যত শেয়ার কেনাবেচা হয়েছিল তার ৭৮ শতাংশই ছিল ফারুকদের। এভাবে
ধোঁকাবাজি করে তিন সপ্তাহেরও কম সময়ে প্রায় ৩ কোটি টাকা মুনাফা করেন তারা। এ
ঘটনায় সাবেক খায়রুল কমিশন তদন্ত করলেও কোনো ব্যবস্থা নেয়নি। ঘটনার ছয় বছর
পর ২০২২ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি বর্তমান কমিশন ফারুকদের সম্মিলিতভাবে মাত্র ২০
লাখ টাকা জরিমানা করে।
একই বছরের ২০১৬ সালে নিজ মালিকানাধীন আরএন
স্পিনিং এবং ফার কেমিক্যালের শেয়ার নিয়ে নিজের মালিকানাধীন বেশ কয়েকটি
কোম্পানি এবং পরিবারের সদস্যদের নিয়ে কারসাজি করেছেন ফারুক। তাঁকে ফার
কেমিক্যাল কোম্পানির শেয়ার কারসাজির ঘটনায় ১৫ লাখ টাকা এবং আরএন স্পিনিং
কোম্পানির কারসাজি ঘটনায় ১০ লাখ টাকা জরিমানা করে বর্তমান কমিশন।
যত সুবিধা নিলেন দুই ভাই
ছোট
ভাই ফারুকের অনেক অপকর্মের সুবিধাভোগী ডিআইজি আবদুল কুদ্দুস আমীন। রিং
শাইন টেক্সটাইল আইপিও কারসাজিতে ফারুক টাকা ছাড়াই সাড়ে ২৭ কোটি শেয়ার ইস্যু
করেছিলেন। এর থেকে নিজের ও পরিবারের সদস্যদের নামে নিয়েছিলেন ১১ কোটি
টাকার শেয়ার। এর ১০ লাখ শেয়ার নিয়েছেন ডিআইজি আবদুল কুদ্দুস। অভিহিত মূল্য
১০ টাকা দরে এ শেয়ারের মূল্য ১ কোটি টাকা।
সম্প্রতি ফারুক তাঁর
গ্রুপভুক্ত বন্ধ কোম্পানি আরএন স্পিনিংয়ের সঙ্গে সামিন ফুড অ্যান্ড বেভারেজ
ইন্ডাস্ট্রিজ অ্যান্ড টেক্সটাইল মিলস লিমিটেডকে এবং তালিকাভুক্ত ফার
কেমিক্যালের সঙ্গে এসএফ টেক্সটাইলকে একীভূতকরণ করেন। এ ক্ষেত্রে জালিয়াতি
হয়েছে মর্মে হাইকোর্টের জন্য পর্যবেক্ষণ তৈরি করেছিল বিএসইসি, যদিও শীর্ষ
এক কর্মকর্তার নির্দেশে তা হাইকোর্টে উপস্থাপন করেননি সংস্থাটির আইনজীবী।
এই
একীভূতকরণের আগে ডিআইজি কুদ্দুস সামিন ফুডের ৪ লাখ ৮০ হাজার শেয়ার
নিয়েছেন, অভিহিত মূল্য ১০ টাকা দরে। যার মূল্য ৪৮ লাখ টাকা। একীভূতকরণ শেষে
একই সংখ্যক শেয়ার পেয়েছেন তিনি। গতকালের বাজারদর অনুযায়ী এ শেয়ারের মোট
মূল্য ৭২ লাখ টাকা। এ ছাড়া এসএফ টেক্সটাইলেও তাঁর নামে ৩ লাখ ৫ হাজার শেয়ার
নেওয়া হয়। একীভূতকরণ স্কিম অনুযায়ী, এই প্রক্রিয়া শেষে ফার কেমিক্যালের ১
লাখ ৫৫ হাজার ৫০১টি শেয়ার পেয়েছেন। গতকালের বাজারদর অনুযায়ী এ শেয়ারের
মূল্য ৩৮ লাখ টাকা।
সেকেন্ডারি শেয়ারবাজারের কারসাজিতে ডিআইজি
কুদ্দুসের নাম এসেছে। ২০১৫-১৬ সালে তালিকাভুক্ত সাফকো স্পিনিং শেয়ার
কারসাজির তদন্তে বিএসইসি তাঁর জড়িত থাকার প্রমাণ পায়। ২০২১ সালের মে থেকে
জুনের মধ্যে সাফকোর শেয়ারদর ১০ টাকা থেকে বাড়িয়ে ৩২ টাকা করা হয়। পরে
ডিআইজি কুদ্দুসকে গত ২৮ মে শুনানিতে অংশ নিতে চিঠি দেয় বিএসইসি। তবে তিনি শ |
News Source
|
|
|
|
|
|
|
|
Today's Other News
|
Related Stories |
|
|
|
|