[ অর্থ-বানিজ্য ও করপোরেট ] 09/03/2022
 
ব্যাংক ও আর্থিক খাতে পিছিয়ে নেই নারী
বাংলাদেশে নারীরা নেই পিছিয়ে। সরকার প্রধান থেকে শুরু করে সব ক্ষেত্রেই নারীর অংশগ্রহণ লক্ষ্য করা যাচ্ছে। দেশের অর্থনীতিতে বড় অবদান রাখছেন নারীরা। বিভিন্ন খাতে বাড়ছে নারী নেতৃত্ব। নারীকে এগিয়ে নিতে সরকারি-বেসরকারিভাবে নেওয়া হয়েছে নানা উদ্যোগ। বর্তমানে শিক্ষা, চাকরি, ব্যবসা-বাণিজ্যে ভালো অবদান রয়েছে নারীর। তাদের এ উদ্যোগকে এগিয়ে নিতে দেশের বাংলাদেশ ব্যাংক ও নারী ও শিশু মন্ত্রণালয় পাশে দাঁড়িয়েছে। এখন নারী উদ্যোক্তাদের মাঝে বেড়েছে ঋণ বিতরণ। ব্যাংকগুলোতেও বাড়ছে নারী কর্মীর সংখ্যা। ব্যাংকে কর্মরত কর্মীদের সর্বোচ্চ থেকে সর্বনিম্ন প্রবেশকালীন পদবিন্যাস বা ধরনকে তিনটি শ্রেণিতে বিভক্ত করে প্রতিবেদনটি তৈরি করা হয়েছে।

এর মধ্যে ব্যবস্থাপনা পরিচালক, অতিরিক্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালক, উপ-ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও মহাব্যবস্থাপককে সর্বোচ্চ পর্যায় ধরে উচ্চপর্যায় হিসেবে ধরা হয়েছে। এতে দেখা যায়, দেশের ব্যাংক খাতে এসব পদে কর্মরতদের মধ্যে মাত্র আট দশমিক ৯৩ শতাংশ হচ্ছে নারী। অথচ ব্যাংকের মোট কর্মীর মধ্যে প্রায় ১৬ শতাংশই নারী। এরপর থাকা মধ্যম পর্যায়ে রয়েছেন ১৫ দশমিক ৫৯ শতাংশ নারী এবং প্রারম্ভিক বা প্রবেশকালীন ১৬ দশমিক ২৮ শতাংশই নারী। আগে ব্যাংকে নারী কর্মীদের অংশগ্রহণ সেভাবে ছিল না। বেসরকারি খাতে ব্যাংকের সংখ্যা বৃদ্ধি এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের নারীবান্ধব বেশকিছু সুবিধা চালু করায় তাদের সংখ্যা বেড়েছে। এজন্য প্রবেশকালীন ক্ষেত্রে দেখা যায়, ব্যাংকে নতুন চাকরির ক্ষেত্রে প্রায় ১৭ শতাংশই নারীরা নির্বাচিত হচ্ছেন। বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালকের দায়িত্ব পালন করছেন ফরিদপুরের চরভদ্রাসন উপজেলায় মেয়ে শিরীন আখতার। তিনি ১৯৮৮ সালে অগ্রণী ব্যাংক লিমিটেডে সিনিয়র অফিসার হিসেবে যোগ দিয়ে শিরীন আখতারের ব্যাংকিং ক্যারিয়ার শুরু হয়। ২০১৯ সালের সেপ্টেম্বরে তিনি কৃষি ব্যাংকের ডিএমডি পদে আসেন।

বর্তমানে কেবল একটি বেসরকারি ব্যাংকে নারী এমডি রয়েছেন। ২০২১ সালের মার্চে বেসরকারি ট্রাস্ট ব্যাংকের এমডি হন হুমায়রা আজম। এখন পর্যন্ত তিনিই একমাত্র নারী যে কোনো বেসরকারি ব্যাংকের এমডির দায়িত্ব পালন করছেন। তিনি এর আগে আর্থিক প্রতিষ্ঠান আইপিডিসি লিমিটেডের এমডির দায়িত্বও পালন করেন। এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র মো. সিরাজুল ইসলাম বলেন, ‘আর্থিক কর্মকা-ে নারীর অবদান রয়েছে। ব্যাংক সেবা সবার কাছে নিতে হলে নারীদের অন্তর্ভুক্তি প্রয়োজন। এজন্য সরকারও নারীবান্ধব নীতিমালার প্রতি উৎসাহিত করছে। বাংলাদেশ ব্যাংক নারী কর্মীদের মাতৃত্বকালীন ছুটি, শিশু দিবাযতœ কেন্দ্র, সন্ধ্যার পরে ব্যাংকে না থাকার বাধ্যবাধকতা থেকে মুক্তিসহ যাতায়াত সুবিধা দিতে নিয়মিত নীতিমালা করেছে। কিছু ক্ষেত্রে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে বাধ্য করেছে। ফলে দিন দিন ব্যাংকিং পেশার প্রতি নারীদের আগ্রহ বাড়ছে।’ বাংলাদেশ ব্যাংকের আরেক প্রতিবেদন অনুযায়ী, বর্তমানে দেশের ব্যাংক খাতে মোট জনবল রয়েছে এক লাখ ৮৬ হাজার ৭৮৪ জন। এর মধ্যে নারী কর্মীদের সংখ্যা ২৯ হাজার ৫১৩ জন।

এটি ব্যাংক খাতের মোট জনবলের ১৫ দশমিক আট শতাংশ। প্রতিবেদনে দেখা গেছে, ব্যাংকগুলোয় ৩০ বছরের কম বয়সি যেসব কর্মী রয়েছেন, তাদের মধ্যে ২২ দশমিক ১১ শতাংশ নারী। ৩০ থেকে ৫০ বছর বয়সি কর্মীদের মধ্যে নারীর হার ১৫ দশমিক ৮৩ শতাংশ। আর ৫০ বছরের বেশি বয়সিদের মধ্যে এ হার ৮ দশমিক ৩৮ শতাংশ। আর পেশাগত কারণে স্থানান্তরের হার ১৩ দশমিক ৪০ শতাংশ, ২০২০ সালে যা ছিল ১২ দশমিক ৪০ শতাংশ। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বর্তমানে ব্যাংক খাতের মোট পরিচালকদের ১২ দশমিক ৭৬ শতাংশ নারী। তাদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি নারী পরিচালক রয়েছেন বিদেশি মালিকানার বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোয়। আবার কর্মসংস্থানের দিক দিয়ে নারীর অনুপাত বিদেশি ব্যাংকগুলোতেই বেশি। এর পরই রয়েছে বেসরকারি ও রাষ্ট্রায়ত্ত খাত।

ব্যাংকে বেড়েছে নারী কর্মী : গত বছরের জুন পর্যন্ত ব্যাংক খাতে মোট নারী কর্মীর সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ২৯ হাজার ৫১৩ জনে। যা তার আগের বছর ২০২০ সালের ডিসেম্বরে ছিল ২৮ হাজার ৩৭৮ জন। হিসাব বলছে, ছয় মাসে ব্যাংকে নারী কর্মী বেড়েছে এক হাজার ১৩৫ জন। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গত বছরের জানুয়ারি-জুন প্রতিবেদন অনুযায়ী, দেশের বিভিন্ন ব্যাংকে মোট এক লাখ ৮৬ হাজার ৭৮৪ জন কর্মী রয়েছেন। এর মধ্যে পুরুষ কর্মী এক লাখ ৫৭ হাজার ২৭১ জন, আর নারী রয়েছেন ২৯ হাজার ৫১৩ জন।

অর্থাৎ মোট কর্মীর মধ্যে নারীর অংশগ্রহণ ১৫ দশমিক ৮০ শতাংশ। এর মধ্যে রাষ্ট্র মালিকানাধীন ছয় বাণিজ্যিক ব্যাংকে ৫০ হাজার ৫৬৭ জন কর্মরত রয়েছেন। যাদের মধ্যে পুরুষ ৪২ হাজার ৫৪৪ জন এবং নারী আট হাজার ২৩ জন। কর্মরতদের মধ্যে নারীর অংশগ্রহণ ১৫ দশমিক ৮৭ শতাংশ। বিশেষায়িত তিন বাণিজ্যিক ব্যাংকে কর্মরত রয়েছেন ১৩ হাজার ৩০৫ জন। যাদের মধ্যে পুরুষ ১১ হাজার ৪৭৭ জন এবং নারী রয়েছেন ১৮২৮ জন। নারীর অংশগ্রহণ ১৩ দশমিক ৭৪ শতাংশ। অপরদিকে বেসরকারি ৪২ ব্যাংকে কর্মরত আছেন এক লাখ ১৯ হাজার ১১৭ জন। যাদের মধ্যে পুরুষ কর্মী এক লাখ ৩৯৫ জন, আর নারী কর্মী ১৮ হাজার ৭২২ জন। সেখানে নারীর অংশগ্রহণ ১৫ দশমিক ৭ শতাংশ। অন্যদিকে ৯ বিদেশি ব্যাংকে মোট কর্মরত রয়েছেন তিন হাজার ৭৯৫ জন, তাদের মধ্যে নারী ৯৪০ জন।

আলোচিত সময়ে এসব ব্যাংকে বোর্ড সদস্য হিসেবে নারীর অংশগ্রহণ বেড়েছে ১২ দশমিক ৭৬ শতাংশ। এর মধ্যে বাণিজ্যিক ব্যাংকের বোর্ডে সদস্য হিসেবে নারীর অংশগ্রহণের হার বেশি, ১৬ দশমিক ৩৩ শতাংশ। এক্ষেত্রে পিছিয়ে রয়েছে রাষ্ট্র মালিকানাধীন ব্যাংকগুলো।

বাড়ছে নারী উদ্যোক্তাদের ঋণ : কুটির, মাইক্রো, ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প (সিএমএসএমই) খাতেও ঋণ বিতরণ বেড়েছে ব্যাংকের। সেইসঙ্গে এ খাতের নারী উদ্যোক্তাদের মাঝে বিতরণ করা ঋণের পরিমাণও বেড়েছে। তবে নানা শর্তের কারণে ব্যাংকঋণের আওতার বাইরে রয়েছেন অনেক ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা। বাংলাদেশ সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, এক বছরের ব্যবধানে সিএমএসএমই খাতে নারী উদ্যোক্তাদের মাঝে ঋণ বিতরণ বেড়েছে ৯৮৯ কোটি ৩৬ লাখ টাকা। অন্যদিকে দেশে প্রচলিত তফসিলি ব্যাংকগুলোয় কর্মরত নারী কর্মীর সংখ্যাও বেড়েছে।

গত বছরের জানুয়ারি-জুন পর্যন্ত ব্যাংক খাতে নারী কর্মী বেড়েছে এক হাজার ১৩৫ জন। ২০২১ সালের জানুয়ারি থেকে সেপ্টেম্বরে সিএমএসএমই খাতে নারী উদ্যোক্তাদের মাঝে ঋণ দেওয়া হয়েছে চার হাজার ৫৪২ কোটি ৮৩ লাখ টাকা। এর আগের বছর অর্থাৎ ২০২০ সালের একই সময়ে এই খাতে ঋণ বিতরণ করা হয়েছিল তিন হাজার ৫৫৩ কোটি ৪৭ কোটি টাকা। সে হিসেবে বছরের ব্যবধানে সিএমএসএমই খাতে নারী উদ্যোক্তাদের ৯৮৯ কোটি ৩৬ লাখ টাকা বেশি ঋণ দেওয়া হয়েছে।

এজেন্ট ও মোবাইল ব্যাংকিংয়ে নারী : মোবাইল আর্থিক সেবায় (এমএফএস) বিকাশ, রকেট ও নগদের নারী গ্রাহকের সংখ্যা বাড়ছে। এজেন্ট ব্যাংকিং সেবার মাধ্যমে নারীরা কর্মস্থল থেকে নিজের টাকা গ্রামের বাড়িতে পাঠাতে পারছেন। এ সেবায় গত ডিসেম্বর পর্যন্ত পুরুষ গ্রাহকের সংখ্যা ছিল ৭৩ লাখ ২৯ হাজার ৯১৭, আর নারী গ্রাহক ছিল ৬২ লাখ ৫০ হাজার ৩১। দেশের ১৯ হাজার ২৪৭টি আউটলেটের মাধ্যমে এজেন্ট ব্যাংকিং সেবা দেওয়া হচ্ছে, যার মধ্যে রয়েছেন নারী এজেন্টও।