[ সম্পাদকীয় ] 24/03/2022
 
লবণাক্ত টাকা এবং সুদহারের স্লুইস গেট
কিছুদিন আগে এক ভাই মন্তব্য করলেন, পৃথিবীর সবচেয়ে সহজ কাজ হচ্ছে ব্যাংকিং। বস্তুত, টাকা দেয়া ও নেয়া ছাড়া ব্যাংকারদের আর কোনো কাজ তার চোখে পড়েনি। আমি অবশ্য আগেপাছে না ভেবে উত্তর দিয়েছিলাম, একজন ব্যাংকারের কাছে এ দেয়া-নেয়াটাই পৃথিবীর কঠিনতম কাজ।

আমাদের সরকারি অ্যাকাউন্ট এই কিছুদিন আগেও হাবুডুবু খাচ্ছিল প্রায় ১৮ হাজার কোটি টাকার অতিরিক্ত তারল্যে, যার পেছনে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির মাত্র ২৪ শতাংশ বাস্তবায়নকে একটি বড় কারণ হিসেবে দেখেছেন বিশেষজ্ঞরা। এদিকে বাংলাদেশ ব্যাংকের মুদ্রানীতি বলছে, সঞ্চয়পত্র থেকে সরকার লক্ষ্যমাত্রা ছাড়িয়ে গিয়ে ঋণ করেছে ২০২১ অর্থবছরে; যার স্বাভাবিক পরিণতি ব্যাংকিং খাত থেকে লক্ষ্যমাত্রার কম ঋণ করেছে। ওদিকে করোনা অনিশ্চয়তার মুখে বেসরকারি খাতের ঋণ প্রবৃদ্ধিও ১৪ দশমিক ৮ শতাংশ লক্ষ্যমাত্রার বিপরীতে মাত্র ৮ দশমিক ৪ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছিল। আর এসবেরই অমোঘ নিয়তিতে বাংলাদেশের ব্যাংকগুলো জুন ২০২১ শেষে ২ লাখ ৩১ হাজার ৪৬২ কোটি টাকার অতিরিক্ত তারল্যের জোয়ারে ভাসছিল; যার মধ্যে প্রায় ৬০ হাজার কোটি টাকা একেবারেই অলস পড়ে ছিল।

করোনাকালে বেসরকারি খাতসহ ঋণের সার্বিক প্রবৃদ্ধি স্লথ থাকায় ব্যাপক মুদ্রা সরবরাহের প্রবৃদ্ধিও লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে কম হয়। ফলে পূর্ববর্তী বছরের ৫ দশমিক ৬৫ শতাংশ থেকে হ্রাস পেয়ে ২০২১-এর জুনে মূল্যস্ফীতি ৫ দশমিক ৫৬ শতাংশে নেমে আসে। তবে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সর্বশেষ মুদ্রানীতির অর্ধবার্ষিক পর্যালোচনা জানাচ্ছে, সিপিআই মুদ্রাস্ফীতি ৬ দশমিক শূন্য ৫ শতাংশে দাঁড়িয়েছে ডিসেম্বর ২০২১ এ; যা ৭ দশমিক ২ শতাংশ জিডিপি প্রবৃদ্ধি লক্ষ্যমাত্রাকে ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে। আইএমএফের ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক আউটলুক বলছে, ৩৪টি অগ্রসর অর্থনীতির মধ্যে ১৫টিতেই মুদ্রাস্ফীতি ৫ শতাংশের বেশি। এদিকে ১০৯টি ইমার্জিং মার্কেট অ্যান্ড ডেভেলপিং ইকোনমির মধ্যে ৭৮টিতেই ৫ শতাংশের ওপর। অনেক বিশেষজ্ঞের মতে, বর্তমানের বৈশ্বিক মূল্যস্ফীতি উৎপাদনকারীদের হাতে তৈরি, কারণ সোভিয়েত যুগের শেষে যখন সুপার মার্কেট খালি ছিল, এখনো তেমনি দেখা যাচ্ছে; মানুষ ধরনা ধরেও তার কাঙ্ক্ষিত বস্তুটি পাচ্ছে না। তাদের মতে, করোনাকালের সরবরাহ অভিঘাত ১৯৭০-এর দশকের তেলকেন্দ্রিক সরবরাহ অভিঘাতকে ছাপিয়ে গিয়েছে, যা বর্তমানের নজিরবিহীন বৈশ্বিক মূল্যস্ফীতিকে অন্তত দুই বছর টিকিয়ে রাখবে।  

একটি মজার ব্যাপার হলো, বাংলাদেশের অর্থনীতি এরই মধ্যে প্রণোদিত ছিল। যখন কভিড-১৯-এর খবর কেউ জানত না পৃথিবীতে, তখনই একক সুদহার যুগে প্রবেশ করে বাংলাদেশ। অথচ সুদহারের বুস্টার ডোজ দৃশ্যমান স্পন্দন জাগাতে পারেনি অর্থনীতির দেহে। ঋণের প্রবৃদ্ধি ১৪ দশমিক ৮ শতাংশ লক্ষ্যমাত্রার বিপরীতে ২০ জুন ৮ দশমিক ৪ শতাংশ এবং ২১ জুন ১১ শতাংশ অর্জন করতে সক্ষম হয়। সরকার ঋণ নিচ্ছে না, খারাপ কোম্পানি ঋণ পাচ্ছে না। একটি ভালো কোম্পানিকে ঋণের জন্য সাধাসাধি করছিলাম কিন্তু তারা আরো দুই বছর দেখতে চায়। তাই সরকার টাকা তুলে নেয়ার পরও পুরো মুক্তি পায়নি আর্থিক খাত। দুই প্রকার ক্ষুধা আছে—ব্যবসা ক্ষুধা ও ঝুঁকিবিহীন ব্যবসা এড়ানোর ক্ষুধা। যারা ঝুঁকি এড়ানোর ক্ষুধায় থাকে, তারা টাকার স্লুইস গেট বন্ধ করে দেয়, যাতে উজান থেকে বন্যার পানি ঢুকতে না পারে। অন্যদিকে যাদের ব্যবসার ক্ষুধা বেশি, তারা স্লুইস গেট খুলে দেয়। ফলে বন্যার পানির মতো টাকা সবকিছুকে ভাসিয়ে নিয়ে যায়। স্মরণকালের শিথিল ঋণ শ্রেণীকরণের কালেও আমাদের ডিফল্ট লোন ১৬ দশমিক ৩৮ শতাংশ বেড়েছে। এ অবস্থায় ব্যাংকগুলো ব্যবসার পরিবর্তে ঝুঁকি এড়ানোর ক্ষুধাকে নিবৃত্তি করতে চাইবে, সে আর বিচিত্র কী!

আসলে সুদহার কমিয়েই যদি দেশের অর্থনীতির প্রবৃদ্ধি ঘটানো যেত তাহলে সেই হার শূন্যেই তো নিয়ে যাওয়া যেত, তাহলে দেশের সবার আয় থাকত, আর সবাই বাড়ি করতে পারত সরকারের আকাঙ্ক্ষার সঙ্গে সাযুজ্য রেখে। কিন্তু তা করতে গেলে অতিরিক্ত রড, সিমেন্ট, গ্লাস লাগত, আর সেসব উৎপাদন করতে অতিরিক্ত শ্রমিক লাগত। কিন্তু এ উৎপাদনের উপকরণগুলো তো আর অসীম নয়, তাই একসময় চাহিদা অনুযায়ী জোগান দিতে না পেরে দাম বেড়ে যেত এদের। ঠিক যে উৎপাদনকারীরা বেশি আয় করবেন কিন্তু তাদের ব্যয়ও করতে হবে বেশি উপকরণের জন্য। এদিকে ভোক্তাদের আয় বাড়বে মজুরি বৃদ্ধির ফলে কিন্তু তাদের ব্যয়ও তো বেশি হবে। একসময় দাম বাড়ার একটি প্রত্যাশা তৈরি হবে অর্থনীতিতে, তা আরো দাম বাড়িয়ে তুলবে। সুতরাং অর্থনীতিতে সংখ্যাই বাড়বে সবকিছুর কিন্তু কেউ আগের চেয়ে ভালো আছে—সেকথা বলতে পারবে না; অর্থনীতির প্রকৃত জিডিপি বা উৎপাদন যে দেয়ালে ধাক্কা খেয়ে দাঁড়িয়ে আছে!

তাই বলে প্রবৃদ্ধির কোনো উপায়ই আর নেই? আঠারো শতাব্দীর মধ্যভাগে অর্থনীতিবিদ ও দার্শনিক ডেভিড হিউম অর্থনীতিতে মুদ্রা সরবরাহের প্রভাব নিয়ে বলেন, ‘মুদ্রা সরবরাহ বাড়ানো হলে প্রতিটি নাগরিকের শ্রমকে ত্বরান্বিত করতে হবে তাদের শ্রমের মূল্যবৃদ্ধির আগে।’ হ্যাঁ, আমরা অধিক পরিশ্রম করতে পারি অথবা আমাদের কর্মক্ষমতা বাড়াতে পারি, আগের বরাদ্দ সময়েই বেশি কাজ করতে পারি অথবা প্রযুক্তিগত বুমের কারণেও অল্প সময়ে বেশি উৎপাদন হতে পারে কিংবা বেকারদের কাজ দেয়া যেতে পারে বা বাইরে থেকে লোক নেয়া যেতে পারে। এগুলোর কোনোটার ক্ষেত্রেই দাম বাড়াতে হবে না। কিন্তু এরও তো একটা লিমিট আছে। কারণ ওভারটাইম খাটালে পরে শ্রমিকরা বিদ্রোহ করে বসতে পারেন। আবার টেকনোলজির পরিবর্তন তো নিয়ন্ত্রণযোগ্য নয়। যেকোনো সময় যেকোনো কিছু হতে পারে। এজন্যই একটি মাত্রা ঠিক করতে হয় দাম বাড়ার। উন্নত দেশে এ মাত্রা ৩ শতাংশ এবং উন্নয়নশীল দেশে ৬ শতাংশ বলে একটি ব্যাপক স্বীকৃত বিশ্বাস রয়েছে।

আমেরিকায় সুদহার নামতে নামতে ১৯৭২ সালে ৩ শতাংশে পৌঁছেছিল, প্রবৃদ্ধির বাতাসে নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে মানুষ ভোজের টেবিলে উঠে উদোম নৃত্য শুরু করেছিল। সে সময় ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংকের গভর্নর পল ভোকার সুদহার বাড়াতে শুরু করেন, যা ১৯৮২-তে ১৬ শতাংশে এসে দাঁড়াল। দেশের পণ্য উৎপাদনকারীরা আবিষ্কার করলেন, তাদের ক্রেতারা যেন হঠাৎ করেই বাজার থেকে উধাও হয়েছে! এক পর্যায়ে লোকসান কমাতে তারা শ্রমিক ছাঁটাই করতে শুরু করলেন। বছর না ঘুরতেই দেশটির বেকারত্ব বাড়ল ১০ শতাংশ,  জিডিপি সংকুচিত হলো ৩ শতাংশ, মুদ্রাস্ফীতি নেমে এল ৩ শতাংশে।

মূল্যস্ফীতির স্পিডমিটারটি যদি ঠিকমতো ঘোরানো যায় তাহলে ‘মূল্যস্ফীতির’ দেখা হয়তো মিলবে, কিন্তু ‘অতি উচ্চ মূল্যস্ফীতি’ শত হাত দূরে থাকবে। দুঃখ হলো, অনেক দেশের অসৎ প্রশাসন স্পিড লিমিটকে ছাড়িয়ে এমন রুদ্ধশ্বাসে ছোটে যে একসময় মূল্যস্ফীতির চাকা বিস্ফোরিত হয়ে ধোঁয়া উঠতে থাকে। যারা সরকারকে ঋণ দিয়েছিল, মূল্যস্ফীতির তোড়ে তাদের সুদ আয় উড়ে যায় না শুধু, আসল টাকার বাঁধও দুলে ওঠে। আর যারা টাকা ধরে রেখেছিল হাতের মুঠোয় বা ঘরের সিন্দুকে, তারাও ক্রয়ক্ষমতা হারিয়ে ক্ষত-বিক্ষত হয়ে মাথা চাপড়াতে থাকে। সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয় দেশের ভবিষ্যৎ নাগরিকরা, কারণ দেশটি পরে বিশ্বের দ্বারে দ্বারে ঘুরেও ঋণ পায় না। এসব দেশের সরকার তখন টাকা ছাপিয়ে হলেও তার সামরিক যন্ত্রকে দৈর্ঘ্য-প্রস্থে বড় করতে থাকে। আর এভাবে নিজের মসনদ ধরে রাখার প্রাণপণ চেষ্টা চালায়। এক্ষেত্রে জনগণের কাছ থেকে কর আদায় করা হচ্ছে না সত্য, তবে তাদের টাকার মূল্য ব্যাপক অবনমন ঘটে; যা অর্থনীতিবিদদের কাছে মুদ্রাস্ফীতি কর নামে পরিচিত।

আমাদের কষ্টার্জিত সঞ্চয় ব্যাংকে রেখে ভাবি ‘আসল’ টাকাটা নিরাপদ থাকবে কিন্তু মূল্যস্ফীতি তাও খেয়ে ফেলে; পুঁজিবাজারে ঝুঁকিপূর্ণ বিনিয়োগ করে কেউ যদি ১০ শতাংশ মূলধনি মুনাফা অর্জন করে তাহলে তার পুরোটাই গ্রাস করতে পারে সমহারের একটি মূল্যস্ফীতি। সম্পত্তি পুনর্বণ্টনেও বাধা মূল্যস্ফীতি। আমি যদি ১০০ টাকার ঋণ করি ১০ টাকা সুদে, তাহলে আমার সুদাসল ১১০ টাকা ৫৫ টাকা হয়ে যাবে ১০০ শতাংশ মূল্যস্ফীতিতে। মানে মূল্যস্ফীতি ব্যাংকের জন্য খারাপ কিন্তু ঋণগ্রহীতার জন্য স্বর্গ। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ১৯২১ সালের একটি স্থির সুদের বন্ধকি ঋণের পুরোটাই শোধ করা যেত ১৯২৩ সালের একটি পত্রিকার মূল্য দিয়ে। লাতিন আমেরিকায় ৩০ বছরের মর্টগেজ এখনো প্রায় নিষিদ্ধ। মূল্যস্ফীতির অমোঘ টানেই বাংলাদেশে ঋণ পুনঃতফসিলীকরণের জন্য পাগলপারা হয়ে ছুটতে দেখা যায় অনেককে।

একটা সুষম বাজেট থাকার পরও মূল্যস্ফীতির কারণে রাজস্ব ঘাটতি দেখা দিতে পারে; সরকারকে বেশি টাকা খরচ করতে হয় ঘোষিত কর আয় অপরিবর্তিত রেখেই। ফেডারেল রিজার্ভের সাবেক গভর্নর অ্যালান গ্রিনস্প্যানকে ‘Maestro’ নামের বইতে বব উডওয়ার্ড একজন হিরো হিসেবে দেখিয়েছেন, যিনি ১৯৯০-এর দশকে আমেরিকাকে একটা ঐতিহাসিক অর্থনৈতিক সম্প্রসারণ উপহার দিয়েছেন। কিন্তু সেই তাকেই এখন ২০০৮-এর মহামন্দার জন্য দায়ী করা হয়; সুদহার দীর্ঘদিন কম রেখে তিনি পুঁজিবাজার ও আবাসন খাতে বুদ্বুদ তৈরিতে সহযোগিতা করেছেন। সম্প্রতি ওয়ারেন বাফেট দুঃখ প্রকাশ করে বলেন, বার্কশায়ার হ্যাথাওয়ের জন্য আকর্ষণীয় কোনো বিনিয়োগ খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না; দীর্ঘমেয়াদি সুদহার নিম্ন থাকায় শেয়ারবাজার, অ্যাপার্টমেন্ট, তেলকূপ, কৃষি খামার সবকিছুরই দাম বাড়তি।

বাংলাদেশের মুদ্রানীতির মূল লক্ষ্য মাঝারি মাত্রার মূল্যস্ফীতির ঢেউ সামলে অর্থনীতির তরীকে সম্মুখপানে এগিয়ে নেয়া এবং সর্বাধিক উৎপাদনের স্বর্ণদ্বীপে নিরাপদে পৌঁছানো। মূল্য স্থিতিশীলতা বজায় রেখে প্রবৃদ্ধিকে করোনাপূর্বের ধারায় ফেরানোর লক্ষ্যে আমাদের সর্বশেষ মুদ্রানীতি পর্যালোচনায় আভাস দেয়া হয়েছে, ব্যাপক মুদ্রা (এম-২) এর প্রবৃদ্ধি ডিসেম্বর ২০২১-এর ১৩ দশমিক ৮ শতাংশ ছাড়িয়ে জুন ২০২২-এ ১৫ শতাংশে পৌঁছবে। মুদ্রা সরবরাহের এ হার একই সঙ্গে জাতীয় প্রবৃদ্ধি টার্গেট ৭ দশমিক ২ শতাংশ এবং মূল্যস্ফীতি টার্গেট ৫ দশমিক ৩ শতাংশ—দুটোই পূরণ করতে সক্ষম হবে কিনা তা অবশ্য সময়ই বলে দেবে।  

দেশে মূল্যস্ফীতির ওপর বারবার চড়াও হতে দেখা গিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংককে। এজন্য ব্যক্তি খাতের (জিডিপির ৩৫-৪০ শতাংশ) ঋণ প্রবৃদ্ধির ব্রেক কষে দিতে দেখা গিয়েছে কখনো কখনো। যেমন ২০১৫-এর জুলাইয়ে ব্যক্তি খাতের ঋণের প্রবৃদ্ধি ১৫ শতাংশ নির্ধারণ করলেও পরে ১৪ দশমিক ৮ শতাংশে নামিয়ে আনা হয়। বেশি ঋণ সস্তা টাকায় বাজার সয়লাব করে উচ্চ মূল্যস্ফীতির জন্ম দেয়; যা আবার প্রকৃত ভোগ, বিনিয়োগ সবকিছুকে ক্ষতিগ্রস্ত করে। বাজারে টাকার বুদ্বুদ বাষ্পাকারে উড়তে থাকে, বিপুল বেগে পাচার হতে থাকে লবণাক্ত টাকা। অন্যদিকে ঋণ প্রবৃদ্ধির মাত্রায় সতর্ক নিয়ন্ত্রণ আরোপ করা হলে মধ্যম ও নিম্ন খাতের ব্যবসায়ী থেকে শুরু করে সমাজের পিছিয়ে পড়া গোষ্ঠীগুলোর অন্দরে প্রবেশের একটা পথ খুঁজে পায় টাকা। ঋণ প্রবৃদ্ধির হার কমালেও বিদেশী ঋণ খুলে দেয়া হয়েছিল বড় কোম্পানিগুলোর জন্য, যাতে অধিক ঋণপ্রবাহ যায় এসএমইর জন্য। ফলে ঋণের বণ্টন ও গুণগত মান উন্নত হয়। খেয়াল করার বিষয়, ২০১৩ সালে যেখানে ২০ শতাংশ ঋণ প্রবৃদ্ধি ৬ শতাংশ জিডিপি প্রবৃদ্ধি নিশ্চিত করেছে, সেখানে ২০১৫ সালে মাত্র ১৩ শতাংশ ঋণ প্রবৃদ্ধি সমঅংকের জাতীয় প্রবৃদ্ধি উপহার দিয়েছে দেশকে। সম্ভবত কেইনস আবিষ্কৃত ‘পুঁজির প্রান্তিক দক্ষতা ও উৎপাদনশীলতা’ তত্ত্বের ওপর আস্থা রেখেই ২০১৫-১৬ অর্থবছরে ৭ শতাংশ জাতীয় প্রবৃদ্ধির জন্য ১৪ দশমিক ৮ শতাংশকে যথেষ্ট মনে করা হয়েছিল।  

ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, ঋণের মান ও সঠিক ব্যবহার বেশি গুরুত্বপূর্ণ পরিসর বাড়ানোর থেকে। ২০০০ সালে ব্যক্তি খাতের ঋণ জিডিপির মাত্র ২১ শতাংশ ছিল এবং মোট বিনিয়োগ জিডিপির ২৩ শতাংশ ছিল। ২০১৩ সালে সেই ব্যক্তি খাতের ঋণই বেড়ে জিডিপির ৪২ শতাংশ হয়েছে, অথচ মোট বিনিয়োগ বেড়ে জিডিপির মাত্র ৩০ শতাংশ হয়েছে। স্পষ্টতই, ব্যক্তি খাতের ঋণ বাড়লেই দেশের প্রবৃদ্ধির জন্য জরুরি উচ্চতর পুঁজি সংগঠন হয়েছে নিশ্চিত করে বলা যায় না। মূলধনি যন্ত্রপাতিতে না গিয়ে একটা বড় অংশ ট্রেডিংয়ে চলে যেতে পারে, একটি বড় অংশ গুপ্ত ও সমান্তরাল অর্থনীতিতে চলে যেতে পারে। ২০১২-১৩-এর ঋণ কলঙ্ক সেই বার্তা দেয়।

বাংলাদেশে ব্যাংকিং খাতের ঋণ জাতীয় উৎপাদনের প্রায় অর্ধেক, যেখানে রাজস্ব বাজেট হলো এর এক-পঞ্চমাংশ। এ ঋণ প্রবৃদ্ধিতে ব্রেক কষলে অখুশি হয় ব্যবসায়ী সমাজ। হ্যাঁ, যদি প্রত্যাশিত প্রাণচাঞ্চল্য দেখা যায় উৎপাদনশীলতার চাকায়, তাহলে মূল্যস্ফীতি ঘটিয়েও অর্থনীতি ভালো থাকবে, চাকা বড় হবে এবং ঘুরতেই থাকবে। কিন্তু টাকাগুলো যদি চলে যায় অনুৎপাদনশীল খাতে? শোনা যায়, অনেকে জমিজমা কেনেন অথবা সরিয়ে নেন দেশের বাইরে, সেক্ষেত্রে উল্টো পানিশূন্যতায় ভুগবে অর্থনীতি। শোনা যায়, বর্তমানে আমাদের পাইপলাইনে বিদেশী ঋণ আছে ৪ দশমিক ২৮ লাখ কোটি টাকা। পরপর দুই বছর মিলিয়ে প্রায় ৭ বিলিয়ন মার্কিন ডলার প্রাপ্তিতে বাংলাদেশকে কোনো অর্থকষ্টে পড়তে হয়নি, টাকা প্রচুর আছে দেশে। কিন্তু বিদেশ থেকে আসা ঋণের টাকা দিয়ে যদি সঠিক বিনিয়োগ না করা যায়, তাহলে একসময় শ্রীলংকা, কেনিয়া, আর্জেন্টিনার মতো টাকার সংকটে পড়বে বাংলাদেশ সরকার।

অনেক বিশেষজ্ঞ মনে করেন, সুদহার বাড়ানো হলে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে আসবে, তাতে ঋণ প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা ক্ষতিগ্রস্ত হলেও জিডিপি প্রবৃদ্ধি লক্ষ্যমাত্রা বেঁচে যাবে। অন্যদিকে সুদহারকে তলানিতে রেখে দিলে সঞ্চয় ইন্টারমিডিয়েশনে না ঢুকে ভৌত সম্পদে চালান হতে পারে, যা সম্পত্তি বুদ্বুদ তৈরি করে দেশে দীর্ঘমেয়াদি মন্দা ডেকে আনতে পারে। ২০১৫-এর মুদ্রানীতি ‘সিলেকটিভ ইজিং’ মানে কৃষি, নারী উদ্যোক্তা, সবুজ প্রকল্প, ক্ষুদ্র-মধ্যম উদ্যোগ এবং রফতানি—এসব খাতে ঋণ সরবরাহের মাধ্যমে ব্যাপক মুদ্রা বাড়ানোর ঘোষণা দিয়েছিল। ঋণের পরিমাণ নির্বিচারে না বাড়িয়ে বা সুদহারের স্লুইস গেট সবার জন্য খুলে না দিয়ে নীতি সুদহারে এ রকম কিছু বিশেষ খাতকে প্রণোদিত করলে দেশের দীর্ঘমেয়াদি উৎপাদনশীলতা নিশ্চিত হবে।

পরিমাণ বাড়লেই গুণগত পরিবর্তন ঘটে, যখন দুটি অক্সিজেন অণু থাকে তখন পানি পাওয়া যায়, যখন অণুর সংখ্যা তিনটি হয়ে যায় তখন ওজনে পরিবর্তিত হয়, যা জীবননাশী। কিন্তু এ ওজনই আবার বড় জারক, যা দিয়ে তেল থেকে সালফারের মুক্তি ঘটে। আমাদের টাকার অতিরিক্ত তারল্যকে জারকে পরিণত করা যেতে পারে, যার মাধ্যমে ছেঁকে নেয়া যেতে পারে এমন কিছু উদ্যোক্তা, এমন কিছু স্টার্টআপ, যাদের মধ্যে অনন্ত সম্ভাবনা রয়েছে কিন্তু শুধু পুঁজির অভাবে এগিয়ে আসতে পারছিলেন না। এভাবে লবণাক্ত টাকার বন্যা থেকে দেশের ভাগ্য বদলে দেয়া উদ্যোগ-পলিটুকু বের করে নিতে সুদহার-স্লুইস গেটকে দক্ষতার সঙ্গে কাজে লাগাতে হবে।