[ শেষ পাতা ] 24/03/2022
 
চার বছরে ব্যাংকে ৯৩৭৭ কোটি টাকার ঋণ অবলোপন
সাম্প্রতিককালে দেশের ব্যাংকগুলোতে অস্বাভাবিক বেড়েছে খেলাপি ঋণ। ঋণ আদায়ে ব্যাংকগুলো যখন অনেকটা ব্যর্থ, তখন খেলাপি ঢাকতে কৌশল হিসেবে বেছে নিয়েছে ঋণ অবলোপন। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য বলছে, গত চার বছরে ৯ হাজার ৩৭৭ কোটি টাকার ঋণ অবলোপন করেছে ব্যাংকগুলো। ব্যাপক হারে অবলোপনের বিপরীতে কমেছে ঋণ আদায়ের পরিমাণও। এর সঙ্গে খেলাপি ঋণের সুদও মওকুফ করে দিচ্ছে ব্যাংকগুলো। খেলাপি ঋণ কমাতে অবলোপন নয়, বরং ঋণ আদায়ে ব্যাংকগুলোকে জোর দেয়ার পরামর্শ অর্থনীতিবিদদের।

সম্প্রতি প্রকাশিত বাংলাদেশ ব্যাংকের হালনাগাদ প্রতিবেদনের তথ্যমতে, ২০২১ সালে অবলোপনের মাধ্যমে ২ হাজার ৪৪১ কোটি টাকা খেলাপি ঋণ ব্যাংকের ব্যালেন্স শিট থেকে বাদ দেয়া হয়েছে। যা তার আগের বছরের তুলনায় আড়াই গুণ বেশি। ২০২০ সালে অবলোপন করা হয়েছিল ৯৭১ কোটি টাকা।

এ ছাড়া ২০১৯ সালে অবলোপন করা হয়েছিল ২৫৯৭ কোটি টাকা। আর ২০১৮ সালে ৩ হাজার ৩৭০ কোটি টাকা। সব মিলিয়ে গত চার বছরে ব্যাংকগুলো অবলোপন করে ৯ হাজার ৩৭৭ কোটি টাকা।

ব্যাপক হারে অবলোপন বাড়লেও বিপরীতে কমেছে ঋণ আদায়ের পরিমাণও। ২০২১ সালের জানুয়ারি থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত, এই ৯ মাসে আগের অবলোপন করা ঋণ থেকে আদায় হয় ৪৭২ কোটি টাকা। তার আগের বছর অর্থাৎ ২০২০ সালে যা ছিল ৭৩৬ কোটি টাকা। আর ২০১৯ সালে ২ হাজার ৫৯৭ কোটি টাকার ঋণ অবলোপন হলেও ওই বছর আদায় হয় মাত্র ৮৩১ কোটি টাকা।

ওদিকে, ঋণ অবলোপনের সঙ্গে খেলাপি ঋণের সুদ মওকুফ করে দিচ্ছে ব্যাংকগুলো। গত বছর অর্থাৎ ২০২১ সালে এক হাজার ৮৫৫ কোটি টাকার সুদ মওকুফ করা হয়েছে। এ ছাড়া ২০২০ সালে এক হাজার ৫৭৮ কোটি টাকা, ২০১৯ সালে দুই হাজার ২৯৩ কোটি টাকা এবং ২০১৮ সালে এক হাজার ১৯৮ কোটি টাকার সুদ মওকুফ করা হয়েছে। সবমিলিয়ে গত চার বছরে ছয় হাজার ৯২৪ কোটি টাকার সুদ মওকুফ করেছে ব্যাংকগুলো।

বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদের মতে, ঋণ আদায় না করে অবলোপন করা হলে একসময় ব্যাংকের মূলধনও শেষ হয়ে যেতে পারে। তিনি বলেন, ব্যাংকগুলো শুধু ব্যালেন্স শিট ঠিক রাখতেই অবলোপন করছে। ফলে বাইরে থেকে তাদের আর্থিক অবস্থা ভালো দেখা গেলেও বাস্তবে তা নয়। বিশিষ্ট এই অর্থনীতিবিদ বলেন, খেলাপি ঋণ কমাতে ব্যাংকগুলোকে ঋণ আদায়ে জোর দিতে হবে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে ঋণ আদায়ের টার্গেট দিতে হবে। টার্গেট পূরণ করতে না পারলে ব্যাংকগুলোকে ঋণ দেয়ার সক্ষমতা কমিয়ে দিতে হবে। ঋণ আদায়ের সক্ষমতা অনুযায়ী ঋণ দেয়ার নির্দেশনা দিতে হবে। অর্থাৎ যতটুকু ঋণ আদায় করতে পারবে ব্যাংকগুলো ঠিক ততটুকুই ঋণ দিতে পারবে এমন নীতিমালা করতে হবে।

ব্যাংকিং ব্যবস্থায় মন্দ বা ক্ষতিকর খেলাপি ঋণের বিপরীতে শতভাগ প্রভিশন রেখে স্থিতিপত্র (ব্যালান্সশিট) থেকে বাদ দেয়াকে ঋণ অবলোপন বলে। বাংলাদেশ ব্যাংকের নীতিমালা অনুযায়ী ২০০৩ সাল থেকে ব্যাংকগুলো ঋণ অবলোপন করে আসছে। ঋণখেলাপি মাত্রাতিরিক্ত বেড়ে যাওয়ায় ওই সময় ব্যাংকের স্থিতিপত্র ঠিক রাখতে অবলোপনের নীতিমালা জারি হয়। এর পর ২০১৯ সালের ৬ই ফেব্রুয়ারি অবলোপন সংক্রান্ত নতুন নীতিমালা জারি করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। সেই নিয়ম অনুযায়ী ৩ বছর হলেই মন্দ মানের খেলাপি ঋণ অবলোপন করতে পারবে ব্যাংকগুলো। আগে ৫ বছর না হলে খেলাপি ঋণ অবলোপন করা যেত না। আগে মাত্র ৫০ হাজার টাকা পর্যন্ত খেলাপি ঋণ মামলা ছাড়াই অবলোপন করার সুযোগ ছিল। এখন তা বাড়িয়ে ২ লাখ টাকা করা হয়েছে। মূলত কাগজে-কলমে খেলাপি কম দেখাতেই এ সুবিধা নিয়ে থাকে ব্যাংকগুলো।

অর্থনীতিবিদরা বলছেন, ঋণ অবলোপনের নীতিমালা শিথিল করায় ঋণখেলাপিরা উৎসাহিত হয়েছেন। ফলে ঋণ পরিশোধ না করার প্রবণতা বেড়ে গেছে। অন্যদিকে ব্যালান্সশিট ভালো দেখাতে ব্যাংকগুলো এ সুবিধা নিতে বেশি আগ্রহ দেখাচ্ছে। ফলে আড়াল হয়ে যাচ্ছে খেলাপি ঋণের প্রকৃত চিত্র।