[ নগর-মহানগর ] 17/04/2022
 
ভুয়া ভিসা-টিকিট দিয়ে হাতিয়েছে ৩০ কোটি টাকা
ওদের টার্গেট গ্রামের নি আয়ের স্বল্প শিক্ষিত সাধারণ মানুষ। ইউরোপে আকর্ষণীয় বেতনে চাকরির প্রলোভন দেখিয়ে গ্রামের বেকার যুবক-যুবতীদের নিয়ে আসা হয় ঢাকায়। কম লেখাপড়া জানা সহজসরল এ মানুষদের জনপ্রতি পাঁচ থেকে সাত লাখ টাকা নিয়ে কাউকে ধরিয়ে দেয়া হচ্ছে ভুয়া ভিসা ও বিমান টিকিট। আর কাউকে পাচার করছে মানবপাচারকারী চক্রের সদস্যরা। পাচারের শিকার সবাই মধ্যপ্রাচ্যে মানবেতর জীবন যাপন করছে। প্রতিকার চাইতে গিয়ে ধর্ষণের শিকার হয়েছেন কেউ কেউ। জানা গেছে, সুনামগঞ্জের এক নারী ভাগ্য বদলের আশায় ইউরোপে চাকরির জন্য ঢাকায় অবস্থানরত নিজ গ্রামের তোফায়েলের সাথে যোগাযোগ করেন। ওই নারীকে চাকরির ফাঁদে ফেলে তোফায়েল হাতিয়ে নেন মোটা অঙ্কের টাকা। পরে ভুক্তোভোগী নারীকে বিদেশ না পাঠিয়ে চক্রটি শুরু করে নানা টালবাহানা। উপায় না দেখে প্রতিকার চাইতে চক্রের অন্য সদস্য কামরুলের বাসায় গেলে সেখানে ধর্ষণের শিকার হন ওই নারী। ভুক্তোভোগী নারীর অভিযোগের ভিত্তিতে গত শুক্রবার রাতে রাজধানীর রামপুরা ও হাতিরঝিল এলাকায় অভিযান চালিয়ে মানবপাচার ও প্রতারক চক্রের চার সদস্যকে গ্রেফতার করে র্যাব-৩। গ্রেফতকৃতরা হলো মানবপাচার ও প্রতারক চক্রের মূল হোতা কামরুল আহম্মেদসহ তার সহযোগী খালেদ মাসুদ হেলাল, তোফায়েল আহম্মেদ ও জামাল। গ্রেফতারের সময় তাদের কাছ থেকে ২৭টি পাসপোর্ট, একটি মনিটর, একটি সিপিইউ, মাউস, কীবোর্ড, ইউপিএস, ১০০ জাল ভিসার কপি, ১২৫টি জাল টিকিট, চারটি মোবাইল ফোন, দুইটি ফরম বই কোভিড-১৯ নমুনা সংগ্রহ ও পরীক্ষা এবং একটি প্রিন্টার উদ্ধার করা হয়।

র্যাব জানায়, গত পাঁচ বছরে এই চক্রটি অবৈধভাবে শতাধিক লোককে ভ্রমণ ভিসা দিয়ে মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে পাচার করেছে। এ ছাড়া ভুয়া ভিসা ও টিকিট সরবরাহের মাধ্যমে পাঁচ শতাধিক লোকের কাছ থেকে অন্তত ৩০ কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে চক্রটি। কৌশল হিসেবে এ চক্রের মূল হোতা কামরুল ঘন ঘন অফিসের ঠিকানা পরিবর্তন করতেন।
গতকাল রাজধানীর কাওরান বাজারে র্যাবের মিডিয়া সেন্টারে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে র্যাব-৩ এর অধিনায়ক (সিও) লে. কর্নেল আরিফ মহিউদ্দিন আহমেদ বলেন, এ চক্রটি মানবপাচার ও প্রতারক চক্রের সদস্য। কামরুল এই চক্রের মূল হোতা আর বাকিরা তার সহযোগী হয়ে কাজ করেন। কামরুলের জনশক্তি রফতানির কোনো লাইসেন্স নেই। বিভিন্ন টুরিস্ট ও ট্রাভেলসের সাথে যোগাযোগ করে অবৈধভাবে ভ্রমণ ভিসায় মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে লোক পাঠাতেন তিনি। বেকার যুবকদের টার্গেট করে জনপ্রতি পাঁচ থেকে সাত লাখ টাকা নিয়ে ভুয়া ভিসা এবং ভুয়া টিকিট সরবরাহ করতেন। ভুক্তভোগীরা বিমানবন্দরে গিয়ে প্রতারিত হয়ে তাদের টাকা ফেরত চাইলে নানা টালবাহানা করতেন কামরুল।

তিনি বলেন, গত দুই বছরে এই চক্রটি আটবার বাসার ঠিকানা পরিবর্তন করে। গত পাঁচ বছরে চক্রটি অবৈধভাবে শতাধিক লোককে মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে পাচার করেছে। যাদের বেশির ভাগই বিদেশ গিয়ে কাজ না পেয়ে মানবেতর জীবন যাপন করছে বলে জানা গেছে। এ ছাড়া আরো এমন শতাধিক ব্যক্তিকে পাঠানোর জন্য অপেক্ষায় রেখেছেন। এই চক্রটি শতাধিক লোককে মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে পাঠানোর প্রলোভন দেখিয়ে জনপ্রতি পাঁচ থেকে সাত লাখ টাকা করে হাতিয়ে নিয়ে ভুয়া ভিসা ও টিকিট সরবরাহ করে প্রায় ৩০ কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে।

আরিফ মহিউদ্দীন আহমেদ জানান, নবম শ্রেণীর গণ্ডি পার হওয়া কামরুলের নির্দিষ্ট কোনো পেশা নেই। ২০১৯ সালে ভ্রমণ ভিসায় দুবাই যান তিনি। সেখানে মানবপাচারের মাধ্যমে অর্জিত অর্থ দিয়ে দুবাইয়ের রেসিডেন্স ভিসা অর্জন করেন। সেখানে একটি প্রাইভেট কার কিনে নিজেই ভাড়ায় চালাতেন। তবে করোনা মহামারীর কারণে ওই প্রাইভেট কারটি বিক্রি করে ২০২১ সালে বাংলাদেশে ফিরে এসে পুনরায় প্রতারণা ও মানবপাচার শুরু করেন এই প্রতারক।

তদন্ত সংশ্লিষ্টদের বরাত দিয়ে র্যাবের এই কর্মকর্তা জানান, সুনামগঞ্জের এক গৃহবধূ ভাগ্য বদলের আশায় ইউরোপে চাকরির জন্য শরণাপন্ন হন ঢাকায় অবস্থানরত নিজ গ্রামের তোফায়েল আহমেদ নামে এক যুবকের। টাকা নিয়ে তোফায়েল নারীকে বিদেশ না পাঠিয়ে শুরু করেন নানা টালবাহানা। উপায় না পেয়ে ওই নারী তোফায়েলের পরিচিত কামরুল আহমেদের রামপুরার বাসায় প্রতিকার চাইতে গেলে তাকে ধর্ষণ করেন তোফায়েল। ওই নারীর অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে অভিযানে নামে র্যাব। বের হয়ে আসে তোফায়েল ও কামরুলের মানবপাচারের তথ্য। শুধু তা-ই নয়, গত ১২ এপ্রিল মৌলভীবাজার থেকে একজন নারীকে মধ্যপ্রাচ্যের একটি দেশে পাঠানোর কথা বলেন জামাল মাহবুব ইন্টারন্যাশনালের অ্যাসিস্ট্যান্ট ম্যানেজার। মাহবুব ইন্টারন্যাশনাল মানবপাচারের সাথে সম্পৃক্ত থাকায় বিএমইটি কর্তৃক তাদের লাইসেন্স ব্লক করে দেয়া হয়েছে। একমাস আগে মাহবুব ইন্টারন্যাশনালের এমডি জামাল মানবপাচারের দায়ে র্যাব-৩ এর হাতে গ্রেফতার হয়েছিলেন। জামাল সপ্তম শ্রেণী পর্যন্ত লেখাপড়া করেছেন। পাঁচ বছর ধরে তিনি কামরুলের সাথে প্রতারণা এবং মানবপাচারের কাজ করে আসছেন।

গ্রেফতার খালেদ ২০০১ সাল থেকে ১৫ বছর সৌদি আরবে ছিলেন। ২০১৬ সালে বাংলাদেশে ফেরত এসে তিনি রাজনগর মৌলভীবাজারে রেস্টুরেন্টের ব্যবসা শুরু করেন। কিন্তু এই ব্যবসায় তিনি সফল হতে না পেরে কামরুলের সাথে প্রতারণা ও মানবপাচারের কাজে যোগ দেন। তিনিও অষ্টম শ্রেণী পর্যন্ত লেখাপড়া করেছেন।

গ্রেফতার তোফায়েলের পেশা একজন গাড়িচালক। এ ছাড়াও মৌলভীবাজারে তার সিএনজি পার্টস এবং ডেকোরেটরসের ব্যবসা রয়েছে। লোভে পড়ে তিনি কামরুলের সাথে প্রতারণা ও মানবপাচারের কাজে যোগ দেন। কামরুলের বড় ভাইয়ের মাধ্যমে কামরুলের সাথে তার পরিচয় হয়।