[ পাতা ১২ ] 21/04/2022
 
মূল্যস্ফীতিতে চিড়েচ্যাপ্টা জীবন
গত ১৭ মাসের মধ্যে সর্বোচ্চ মূল্যস্ফীতি ছিল মার্চে। এ নিয়ে পরপর দুই মাস ধরে মূল্যস্ফীতি ৬ শতাংশের ওপরে। কিন্তু এ হারে মজুরি বাড়ছে না।

আবদুল্লাহ আল মামুন একটি পোশাক কারখানায় চাকরি করেন। বেতন-ভাতা সব মিলিয়ে মাসে ২৫ হাজার টাকা। দুই সন্তান, স্ত্রীসহ চারজনের টানাটানির সংসার। কোনোরকমে সংসার চলে। কিন্তু কয়েক মাস ধরে আর যেন চলছে না। করোনার কারণে এ বছর বেতন বাড়েনি। তাই এখন আবদুল্লাহ আল মামুনকে সংসার চালাতে মাসের শেষের দিকে জমানো টাকায় হাত দিতে হচ্ছে।

আবদুল্লাহ আল মামুন জানান, ‘কয়েক মাস ধরে চাল-ডাল, তেল-নুন- সবকিছুর দাম বেড়েছে। কিন্তু আয় তো বাড়েনি। আগে মাসে দুই-তিনবার মাংস খেতাম। এখন তা বাদ দিতে হয়েছে।’

আবদুল্লাহ আল মামুনের মতো দেশের বহু মধ্যবিত্ত, নিম্নমধ্যবিত্ত ও সীমিত আয়ের মানুষের খাবারের পাত থেকে খাবারের বহু পদ উঠে যাচ্ছে। আর দরিদ্র মানুষের জীবনে নাভিশ্বাস উঠেছে।

দেশে নিত্যপণ্যের যেভাবে মূল্যবৃদ্ধি পাচ্ছে, তার সঙ্গে তাল মিলিয়ে মানুষের মজুরি বাড়ছে না। জিনিসপত্রের দাম বাড়তে থাকায় মূল্যস্ফীতিও বেড়েছে পাল্লা দিয়ে। দুই মাস ধরে দেশে মূল্যস্ফীতির হার ৬ শতাংশের ওপরে আছে। করোনার কারণে এমনিতেই নিম্নমধ্যবিত্ত ও গরিব মানুষের আয় কমেছে। অনেকেই করোনাকালে চাকরি হারিয়ে এখনো বেকার জীবনযাপন করছেন।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) হিসাবে, গত দুই মাসে মূল্যস্ফীতির যে হার ছিল, মজুরি বৃদ্ধির হার ছিল তার চেয়ে কম। তার মানে মানুষের আয় বৃদ্ধির গতির চেয়ে মূল্যস্ফীতি বেশি হারে বাড়ছে। অর্থাৎ মানুষের গড় মজুরি যে হারে বাড়ছে, এর চেয়ে বেশি হারে জিনিসপত্রের দাম বাড়ছে। ফলে বাড়তি আয় দিয়ে আগের মতো জিনিসপত্র কেনা সম্ভব হচ্ছে না। গত মার্চ মাসে দেশে মূল্যস্ফীতির হার ছিল ৬ দশমিক ২২ শতাংশ। আর ওই মাসে মজুরি বৃদ্ধির হার ছিল ৬ দশমিক ১৫ শতাংশ। গত ফেব্রুয়ারি মাসে মূল্যস্ফীতি ছিল ৬ দশমিক ১৭ শতাংশ। আর মজুরি বৃদ্ধির হার ছিল ৬ দশমিক ০৩ শতাংশ।

বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সিপিডির গবেষণা পরিচালক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, মূল্যস্ফীতির চেয়ে মজুরি বৃদ্ধির হার কম হলে দৈনিক ভিত্তিতে যাঁরা মজুরি পান, তাঁরা সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হন। তাঁদের প্রকৃত আয় কমে যায়। ফলে ওই সব পরিবারের খাদ্যনিরাপত্তায় বড় চ্যালেঞ্জ দেখা যায়। করোনার কারণে ওই শ্রেণি ইতিমধ্যে সঞ্চয় ভেঙে ফেলেছেন। এখন তাঁদের ধারদেনার ওপরেই চলতে হয়। এ জন্য সরকারের নানা ধরনের সুরক্ষা কর্মসূচি বাড়ানো উচিত।

মাসওয়ারি ভিত্তিতে মূল্যস্ফীতির চেয়ে মজুরি কম—এ ধরনের ঘটনা খুব একটা ঘটে না। যখন অস্বাভাবিক পরিস্থিতি তৈরি হয়, তখনই এমন ঘটনা ঘটে। সরকারি হিসাবে দেখা যায়, সব সময়ই মূল্যস্ফীতির চেয়ে মজুরি বৃদ্ধির হার বেশি থাকে। এর আগে ২০২০ সালের সেপ্টেম্বর ও অক্টোবর মাসে মূল্যস্ফীতির চেয়ে মজুরি বৃদ্ধির হার কম ছিল। তখন করোনার প্রভাবে বহু মানুষ বেকার ছিলেন। আর অনেকে বেকার না হলেও আয় কমে গিয়েছিল।

উচ্চ মূল্যস্ফীতির পথে

সাধারণত মূল্যস্ফীতি ৬ শতাংশে উঠলেই উচ্চ মূল্যস্ফীতি ধরা হয়। দেশে ছয় মাস ধরেই মূল্যস্ফীতি ৬ শতাংশের কাছাকাছি বা ওপরে আছে। এর মধ্যে গত ডিসেম্বর, ফেব্রুয়ারি ও মার্চ—এই তিন মাস মূল্যস্ফীতি ৬ শতাংশের বেশি ছিল।

শুধু বাংলাদেশ নয়; করোনার ধাক্কা কাটিয়ে অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধার পর্যায়ে আন্তর্জাতিক বাজারে জিনিসপত্রের মূল্যবৃদ্ধি এবং রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে পৃথিবীর বড় বড় দেশেও মূল্যস্ফীতি বেড়েছে। চলতি মাসে প্রকাশিত বিশ্বব্যাংকের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশসহ দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর জন্য মূল্যস্ফীতি এখন বড় চ্যালেঞ্জ।

মূল্যস্ফীতি হলো একধরনের করের মতো। যেমন গত মার্চ মাসে মূল্যস্ফীতি হলো ৬ দশমিক ২২ শতাংশ। এর মানে হলো গত বছরের মার্চে জীবনধারণের নানা উপকরণ কিনতে আপনার খরচ যদি ১০০ টাকা হয়, তাহলে এ বছরের মার্চে তা কিনতে খরচ হয়েছে ১০৬ টাকা ২২ পয়সা।

বিবিএসের সর্বশেষ হিসাব বলছে, গত ১৭ মাসের মধ্যে গত মার্চেই সর্বোচ্চ মূল্যস্ফীতি হয়েছে। এর আগে ২০২০ সালের অক্টোবর মাসে মূল্যস্ফীতি উঠেছিল ৬ দশমিক ৪৪ শতাংশে।