[ অনলাইন ] 12/05/2022
 
দেশে ছড়িয়ে পড়ছে আইস-এলএসডি, উদ্বেগ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর
সারা দেশে ছড়িয়ে পড়ছে আইস বা ক্রিস্টাল মেথ ও এলএসডিসহ নতুন নতুন মাদক। রাজধানী ঢাকার বাইরে জেলা শহরগুলোতেও পৌঁছে গেছে ভয়ঙ্কর এই মাদক। উচ্চবিত্ত ও শিক্ষিত তরুণ-তরুণীরা আসক্ত হয়ে পড়ছে এসব মাদকে। ভয়ঙ্কর ও নতুন এসব মাদক ছড়িয়ে পড়ায় উদ্বেগ প্রকাশ করেছে খোদ আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী। সম্প্রতি আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর মাঠ পর্যায়ের ইউনিটগুলোর কাছে পাঠানো এক গোয়েন্দা প্রতিবেদনে আইস বা ক্রিস্টাল মেথ ও এলএসডি দেশব্যাপী বিস্তৃতির বিষয়ে বলা হয়েছে, এখনই প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিয়ে নিয়ন্ত্রণ করা না গেলে ভবিষ্যতে এসব মাদকের ভয়াবহ বিস্তার ঘটবে।

পুলিশ সদর দফতরের অতিরিক্ত ডিআইজি  (গোপনীয়) আব্দুল্লা হিল বাকির সই করা এক নির্দেশনায় মাঠ পর্যায়ের ইউনিটগুলোকে গোয়েন্দা প্রতিবেদন অনুযায়ী কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, গত বছরের ২৬ মার্চ মিয়ানমার থেকে কক্সবাজারে পাচার হওয়ার সময় টেকনাফ এলাকা থেকে র‌্যাব (গোয়েন্দা) এর একটি দল দুই কেজি আইস মাদকসহ এক মাদক ব্যবসায়ীকে আটক করে। একই বছরের ২৯ মে ঢাকার শাজাহানপুর, রামপুরা, বাড্ডা ও ভাটারা এলাকায় অভিযান চালিয়ে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ এলএসডি সেবন ও ব্যবসার সঙ্গে জড়িত বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঁচ শিক্ষার্থীকে গ্রেফতার করে। গত বছরের ৯ জুন রাজধানীর মোহাম্মদপুর এলাকা থেকে ‘ব্রাউনি কেক’ নামে গাঁজার নির্যাস দিয়ে তৈরি বিশেষ এক মাদক উদ্ধার করে মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ। চলতি বছরের ১০ এপ্রিল রাজধানীর কদমতলী এলাকা থেকে বিপুল পরিমাণ এলএসডি মাদকসহ এক প্রবাসীকে গ্রেফতার করে র‌্যাব।

রাজধানী ঢাকা থেকে বিপুল পরিমাণ এলএসডি উদ্ধার ও মাদক ব্যবসায়ীদের গ্রেফতারকারী গোয়েন্দা পুলিশের অতিরিক্ত উপ-কমিশনার মিশু বিশ্বাস জানান, আমরা একটি বড় এলএসডি চালান ধরেছিলাম। ওই মামলায় সবার বিরুদ্ধে দ্রুততম সময়ে আদালতে চার্জশিট জমা দেওয়া হয়েছে। এলএসডি ও আইসসহ নতুন ধরনের এসব মাদকের ব্যবসার সঙ্গে জড়িতদের আমরা প্রতিনিয়ত নজরদারি করে যাচ্ছি। ‘ব্রাউনি কেক’ ব্যবসায়ী একটি চক্রকে ধরা হয়েছিল। অভিযান চলমান রয়েছে।

আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর কর্মকর্তারা বলছেন, গত দুই- তিন বছর ধরে দেশে নতুন মাদকের ব্যবহার শুরু হয়েছে। আইস বা ক্রিস্টাল মেথ ও এলএসডি ছাড়াও ব্রাউনি কেকের আদলে তৈরি মাদক এবং ডিওবি নামে আরেক ধরনের মাদকও উদ্ধার করা হয়েছে।

গোয়েন্দা সংস্থার ওই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, মাদক নিয়ন্ত্রণে সরকারের শূন্য সহিষ্ণুতা নীতি এবং পুলিশসহ অন্যান্য সংস্থার অব্যাহত অভিযানে বিপুল পরিমাণ মাদকদ্রব্য উদ্ধার হলেও মাদকের আগ্রাসন উল্লেখযোগ্যভাবে হ্রাস পায়নি। সম্প্রতি প্রচলিত মাদকের পাশাপাশি নতুন মাদকের বিস্তৃতিতে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তির অপব্যবহার, অবৈধ আর্থিক লেনদেন এবং স্বচ্ছল পরিবারের সন্তানদের জড়িয়ে পড়ার খবর মাদক আগ্রাসনে নতুন মাত্রা যোগ করেছে।

গোয়েন্দা সংস্থার ওই প্রতিবেদনে মাদকের বিস্তৃতি সম্পর্কে বলা হয়েছে, করোনা মহামারির কারণে দীর্ঘদিন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, খেলার মাঠ, জিম ইত্যাদি বন্ধ থাকায় এবং কোনও বিনোদনের ব্যবস্থা না থাকায় স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রীরা মাদকের দিকে বেশি ঝুঁকছে। পরিবারিক অশান্তি, বেকারত্ব, লক্ষ্যহীন ভবিষ্যৎ, নৈতিক ও ধর্মীয় শিক্ষার অভাব, ভোগ-বিলাসী জীবনযাপন, মাদকের সহজলভ্যতা ইত্যাদি কারণও তরুণ সমাজকে মাদকের দিকে ঠেলে দিচ্ছে। এছাড়া পর্নোগ্রাফি, ধর্মীয় ও সামাজিক মূল্যবোধ-বিরোধী নাটক, সিনেমা ও বিজ্ঞাপন প্রচার, আকাশ সংস্কৃতির মাধ্যমে অপসংস্কৃতির বিস্তারও তরুণ-তরুণীদের মাদক গ্রহণে উদ্বুদ্ধ করছে। এক শ্রেণির তরুণ দ্রুত অর্থবিত্ত লাভের আশায় মাদক ব্যবসার সঙ্গে জড়িয়ে পড়ছে এবং ফলশ্রুতিতে নিজেরাও মাদকসেবী হয়ে পড়ছে। একইসঙ্গে স্মার্ট হওয়ার প্রবণতা, নিষিদ্ধ বস্তুর প্রতি আগ্রহ, খারাপ সঙ্গ, হতাশা, একাকিত্ববোধ, বিষণ্নতাসহ বিভিন্ন কারণেও অনেকে মাদকের পথ বেছে নিচ্ছে।

গোয়েন্দা প্রতিবেদনে নতুন মাদক বিস্তার প্রতিরোধের সুপারিশ হিসেবে তথ্য প্রযুক্তির ব্যবহার ও ভার্চুয়াল মুদ্রার লেনদেনকারী মাদক ব্যবসায়ীদের চিহ্নিত করে দ্রুত আইনের আওতায় আনার কথা বলা হয়েছে। এছাড়া এলএসডি, আইস, ব্রাউনি কেকসহ নতুন মাদক সম্পর্কে জনসচেতনতা বৃদ্ধি, আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরগুলোতে আরও বেশি নজরদারি ও তল্লাশি বৃদ্ধিসহ সীমান্ত এলাকায় নজরদারি বাড়ানোর সুপারিশ করা হয়েছে। বিভিন্ন আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক সংস্থার সঙ্গে মাদক সংক্রান্ত গোয়েন্দা তথ্য আদান-প্রদানের মাধ্যমে দেশীয় মাদক ব্যবসায়ীদের সঙ্গে আন্তর্জাতিক মাদক ব্যবসায়ীদের চিহ্নিত করতে হবে। মাদক কারবারিদের অবৈধ সম্পদ অনুসন্ধানপূর্বক রাষ্ট্রের অনুকূলে তা বাজেয়াপ্ত করা, মাদক সংক্রান্ত মামলার দ্রুত তদন্ত ও বিচার শেষ করে অপরাধীদের শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে। প্রয়োজনে মাদক সংশ্লিষ্ট মামলা নিষ্পত্তি করতে বিশেষ ট্রাইবুন্যাল গঠনের পরামর্শও দেওয়া হয়েছে।

সুপারিশে বলা হয়েছে, মাদকাসক্তদের চিকিৎসার পাশাপাশি পুর্নবাসনের জন্য যুব উন্নয়ন অধিদফতর এবং বিভিন্ন উন্নয়নসহযোগী সংস্থার মাধ্যমে প্রশিক্ষণ দিয়ে স্বাবলম্বী করতে হবে। মাদক বিক্রি ও অনৈতিক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত মাদক নিরাময় কেন্দ্রগুলোকে চিহ্নিত করে আইনানুগ ব্যবস্থা নিতে হবে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কোনও সদস্য বা সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীর বিরুদ্ধে মাদক সম্পৃক্ততা পাওয়া গেলে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা করতে হবে।