[ শেষের পাতা ] 13/05/2022
 
নতুন সম্ভাবনার দিগন্ত রফতানির বহর বাড়ছে
করোনা মহামারি ও বৈশ্বিক অস্থিরতার মধ্যেও নতুন মাইলফলকে পৌঁছেছে দেশের রফতানি খাত। নির্ধারিত সময়ের দুই মাস আগেই লক্ষ্যমাত্রা পূরণে সফল হয়েছে রফতানি। অর্থনীতির গুরুত্বপূর্ণ এ খাতটি দীর্ঘদিন ধরে একাই টেনে নিয়ে যাচ্ছে তৈরি পোশাকশিল্প। অথচ যে কোনো একটি খাতের ওপর অতিনির্ভরশীলতা অর্থনীতির জন্য ঝুঁকিপূর্ণ বলে মনে করেন অর্থনীতিবিদ ও ব্যবসায়ীরা। কারণ, পোশাক রফতানি কমে গেলে পুরো অর্থনীতিই বিপন্ন হয়ে পড়বে। তবে দেরিতে হলেও পোশাকের পর একসঙ্গে তিনটি খাতের পণ্য রফতানি ১০০ কোটি বা ১ বিলিয়ন ডলারের মাইলফলক ছুঁয়েছে। এগুলো হচ্ছে-হোম টেক্সটাইল, কৃষি প্রক্রিয়াজাত পণ্য এবং চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য। এছাড়া, পাট ও পাটজাত পণ্যের রফতানিও শত কোটি ডলার ছুঁইছুঁই করছে। এ ধারাবাহিকতায় আরো আছে প্রকৌশল পণ্য ও হিমায়িত খাদ্য। রফতানি বাড়াতে পণ্যের বহুমুখীকরণ ও নতুন নতুন বাজার অনুসন্ধানের প্রয়োজনীতা দেখছেন সংশ্লিষ্টরা।

সাবেক এফবিসিসিআই সভাপতি শফিউল ইসলাম মহিউদ্দিন বলেন, করোনা মহামারির পরে এ ধরনের অর্জন সত্যিই অর্থনীতির জন্য অনেক বড় সুখবর। আমাদের নতুন নতুন খাত যেমন-ঔষধ, আইটি, কৃষি খাত-এগুলো যখন নতুন মাত্রা যুক্ত করেছে, তখন বোঝা যাচ্ছে রফতানির স্থায়িত্ব অনেক বেড়ে যাচ্ছে। দেশের অর্থনীতির জন্য এটা অবশ্যই অনেক ভালো লক্ষণ। আরো একটি সুসংবাদ হচ্ছে, রফতানির লক্ষ্যমাত্রা ১০ মাসেই অর্জন হয়েছে।

তবে একে রফতানির সঠিক গ্রোথ হিসেবে ধরে নেয়াটা সঠিক হবে বলে মনে করেন তিনি। এর কারণ হিসেবে বিশ্ববাজারে পণ্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি, আগের রফতানির পরিমাণ ও বর্তমানে রফতানির পরিমানও দেখা উচিত বলে মত তার।

পোশাক খাতের পাশাপাশি নতুন যেসব খাতগুলো এগিয়ে আসছে সেগুলোর প্রতিও যতœবান হওয়ার পরামর্শ শফিউল ইসলাম মহিউদ্দিনের। তিনি বলেন, দীর্ঘদিন ধরেই পোশাক খাতে ভর করে রফতানি এগোচ্ছে। তবে অতিমাত্রায় কারো উপরে নির্ভরশীল হলে তার স্থায়িত্ব ভালো থাকে না। তাই পণ্যের ডাইভারসিফিকেশন বা বহুমুখীকরণ যত বাড়বে, রফতানি তত স্বাস্থ্যবান ও স্থায়ী হবে। নতুন যে খাতগুলো এগিয়ে আসছে, এসব পণ্যগুলোকে আরো বেশি যতœ নিতে হবে। এছাড়া যত ফিনিশড প্রোডাক্ট হবে, রফতানি তত মানসম্মত হবে।

বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) গবেষক ও অর্থনীতিবিদ ড. জায়েদ বখত বলেন, অনেকদিন থেকেই আমরা চেষ্টা করছি পোশাক খাতের ওপর নির্ভরতা কমিয়ে রফতানি পণ্যের বহুমুখীকরণ বাড়ানোর। পোশাক খাতের ভেতর এবং বাইরেও চেষ্টা করছি।
তিনি বলেন, আমাদের কৃষিপণ্যের বাজারে বিপুল সম্ভাবনা ও সুযোগ রয়েছে। আরেকটি সম্ভাবনাময় খাত হচ্ছে চামড়া খাত। যদিও এ খাতের জন্য আমরা খুব বেশি কিছু করতে পারিনি। ট্যানারি পল্লীর সিইটিপি আমরা এখনো কার্যকর করতে পারিনি। তাই রফতানিতে বৈচিত্র্যতা ফিরছে এটা যেমন সত্যি, তেমনি এতে খুশি হওয়ার কোনো কারণ নেই। কারণ আমাদের এ ধারাবাহিকতা ধরে রাখতে হবে। রফতানির এ ধারাবাহিকতা ধরে রাখতে হলে পোশাক খাতের মতো অন্য রফতানিমুখী খাতগুলোকেও একই সুবিধা দিতে হবে। যেমন ব্যাক টু ব্যাক এলসি, বন্ডেড ওয়্যার হাউস, ডিউটি ফ্রি এক্সেস ইত্যাদি। এসব সুবিধা দিলে সম্ভাবনাময় অনেক পণ্যই রফতানিতে ভালো করতে পারবে।

স¤প্রতি প্রকাশিত রফতানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) রফতানি আয়ের হালনাগাদ পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, সব মিলিয়ে করোনা মহামারির পর চলতি ২০২১-২২ অর্থবছরের প্রথম ১০ মাসে (জুলাই-এপ্রিল) পণ্য রফতানিতে ভালো করেছে বাংলাদেশ। তাতে দুই মাস বাকি থাকতেই চলতি অর্থবছরের যে লক্ষ্যমাত্রা ছিল তার কাছাকাছি পণ্য রফতানি হয়েছে। এ অর্থবছরে পণ্য রফতানির লক্ষ্যমাত্রা ৪ হাজার ৩৫০ কোটি ডলার। আর চলতি অর্থবছরের ১০ মাসে রফতানি হয়েছে ৪ হাজার ৩৩৪ কোটি মার্কিন ডলারের পণ্য। দেশীয় মুদ্রায় যা পৌনে ৪ লাখ কোটি টাকার সমান। এই আয় গত বছরের একই সময়ের তুলনায় ৩৫ শতাংশ বেশি। সবকিছু ঠিক থাকলে পণ্য রফতানি চলতি অর্থবছর শেষে ৫ হাজার কোটি ডলারের মাইলফলকে পৌঁছে যাবে। এর আগে এক বছরে বাংলাদেশের সর্বোচ্চ রফতানি হয়েছিল ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ৪ হাজার ৫৩ কোটি ডলার। করোনা সংক্রমণের বিস্তৃতির কারণে পরের দুই বছরে রফতানি কম হয়।

পরিসংখ্যান ঘেঁটে দেখা যায়, গত এপ্রিল মাসে ৪৭৪ কোটি ডলারের পণ্য রফতানি হয়েছে, যা দেশীয় মুদ্রায় ৪০ হাজার ৯৭৭ কোটি টাকার সমান। গত এপ্রিলে পণ্যের রফতানি গত বছরের একই সময়ের তুলনায় ৫১ শতাংশ বেড়েছে।

গবেষণা সংস্থা সিপিডির ফেলো. ড. গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, প্রতিযোগী দেশগুলোতে রাজনৈতিক অনিশ্চয়তার সুযোগ বাংলাদেশের রফতানি খাত দুভাবে নিতে পারে। প্রথমত, সীমিতভাবে ক্রয়াদেশ বেশি নিতে পারেন উদ্যোক্তারা। দ্বিতীয়ত, দীর্ঘমেয়াদে বিদেশি বিনিয়োগকে আকর্ষণ করা। এজন্য আগামী দিনের পণ্যের উৎসের হাব হিসেবে বাংলাদেশকে ব্র্যান্ডিং করতে হবে। কারণ, কৃষি প্রক্রিয়াজাত পণ্য, পেট্রো কেমিক্যাল, প্লাস্টিক, চামড়া, হালকা প্রকৌশল, সিরামিক ও তথ্যপ্রযুক্তি খাতে বিনিয়োগের বড় সুযোগ রয়েছে। তিনি বলেন, তৈরি পোশাকবহির্ভ‚ত পণ্য রফতানিতে বাংলাদেশের উদ্যোক্তাদের বাজারভিত্তিক, পণ্যমানভিত্তিক ও শুল্কবহির্ভ‚ত বিভিন্ন বাধা অতিক্রম করা বিশেষ প্রয়োজন। তিনি বলেন, সব পণ্যের বাজারে বাংলাদেশি উদ্যোক্তারা খুব সীমিত আকারেই রফতানি বাড়াতে পারছে ভিন্ন ভিন্ন কারণে। অপ্রচলিত প্রায় প্রতিটি বাজারে পণ্য রফতানির ক্ষেত্রে ভিন্ন ভিন্ন প্রতিবন্ধকতা রয়েছে। এছাড়া বিভিন্ন উন্নয়নশীল দেশ, যেমন-চীন বা ভারত বাংলাদেশকে শুল্কমুক্ত বাজার সুবিধা দিলেও বাংলাদেশ তা পর্যাপ্ত আকারে ব্যবহার করতে পারে না। কৃষিজাত পণ্য রফতানির ক্ষেত্রে স্যানিটারি ও ফাইটো স্যানিটারি স্ট্যান্ডার্ড পরিপালন গুরুত্বপূর্ণ।

শীর্ষে পোশাক খাত : রফতানিতে বরাবরের মতো শীর্ষস্থানে রয়েছে তৈরি পোশাক। গত এপ্রিল পর্যন্ত ১০ মাসে ৩ হাজার ৫৩৬ কোটি ডলারের পোশাক রফতানি হয়েছে। এই আয় গত বছরের একই সময়ের তুলনায় ৩৬ শতাংশ বেশি। শুধু এপ্রিলেই ৩৯৩ কোটি ডলারের পোশাক রফতানি হয়েছে। এক্ষেত্রে প্রবৃদ্ধি ৫৬ শতাংশের মতো।

এগিয়েছে হোম টেক্সটাইল : হোম টেক্সটাইল রফতানি গত অর্থবছর ১ বিলিয়ন ডলারের মাইলফলকে পৌঁছায়। চলতি অর্থবছর শেষ হওয়ার দুই মাস আগেই গত বছরের রফতানিকে ছাড়িয়ে গেছে হোম টেক্সটাইল খাত। গত ১০ মাসে ১৩৩ কোটি ডলারের হোম টেক্সটাইল রফতানি হয়েছে। এ আয় গত বছরের একই সময়ের তুলনায় ৩৯ শতাংশ বেশি।

কৃষিতে মাইলফলক : চা, শাকসবজি, ফলমূল, মসলাসহ কৃষি প্রক্রিয়াজাত পণ্য রফতানি প্রথমবারের মতো শতকোটি ডলারের মাইলফলকে পৌঁছেছে। চলতি অর্থবছরের প্রথম ১০ মাসে ১০৪ কোটি ডলারের কৃষি প্রক্রিয়াজাত পণ্য রফতানি হয়েছে। গত বছর এ খাতের রফতানির পরিমাণ ছিল ৮৬ কোটি ডলার। সে হিসাবে চলতি অর্থবছরের দুই মাস বাকি থাকতেই গত বছরের চেয়ে ১৮ কোটি ডলারের বেশি পণ্য রফতানি হয়েছে।

স্বরূপে ফিরছে চামড়া খাত : চামড়া ও চামড়াজাত পণ্যের রফতানি বেশ কয়েক বছর পর শত কোটি ডলারের ঘরে ফিরেছে। পরিবেশ দ‚ষণের কারণে ২০১৬-১৭ অর্থবছরের পর এ খাতের রফতানি কমতে থাকে। গত দুই বছর রফতানি ছিল শতকোটি ডলারের নিচে। চলতি অর্থবছরের প্রথম ১০ মাসে ১০১ কোটি ডলারের চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য রফতানি হয়েছে। এ আয় গত বছরের একই সময়ের তুলনায় ৩৩ শতাংশ বেশি।

সম্ভাবনাময় অন্য খাত : কয়েকটি সম্ভাবনাময় খাত রফতানিতে ভালো করছে। এদের মধ্যে অন্যতম এক সময়ের সোনালি আঁশখ্যাত পাট ও পাটজাত পণ্যের রফতানি টানা দুই বছর পর গত অর্থবছর শতকোটি ডলারে পৌঁছায়। চলতি বছরও সেই ধারা বজায় থাকবে। কারণ, এখন পর্যন্ত পাট ও পাটজাত পণ্যের রফতানি ৯৭ কোটি ডলার।