[ দেশ বিদেশ ] 24/05/2022
 
কেন অপরাধে জড়াচ্ছেন প্রকৌশলীরা
আশরাফুল ইসলাম একজন প্রকৌশলী। ধানমণ্ডির একটি প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইলেকট্রিক্যাল এন্ড ইলেকট্রনিক ইঞ্জিনিয়ারিং পাস করেছেন। একাধিক প্রতিষ্ঠানে ভালো বেতনে চাকরিও করেছেন। কিন্তু সবকিছু ছেড়ে তিনি হয়ে যান বড় মাপের ছিনতাইকারী। ঢাকা শহরে ছিনতাই চক্রের মূল হোতাদের একজন ছিলেন। ঢাকার পল্লবী থানা এলাকার একটি ছিনতাই মামলার তদন্ত করতে গিয়ে গোয়েন্দা পুলিশ ছিনতাই চক্রের চার হোতাকে গ্রেপ্তার করেছিল। তাদের মধ্যে আশরাফুলও ছিলেন।

আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা বলছেন, আশরাফুলের মতো আরও অনেক প্রকৌশলীকে বিভিন্ন অপরাধের জন্য গ্রেপ্তার করে জেল হাজতে পাঠানো হয়েছে। বিভিন্ন পেশার মানুষই নানারকম অপরাধ ও প্রতারণায় জড়াচ্ছেন।

 কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে প্রকৌশলীরাও অপরাধে জড়াচ্ছেন। যারা জড়াচ্ছেন তাদের অনেকেই লোভে পড়ে রাতারাতি ধনী হওয়ার জন্য এসব পথে পা বাড়াচ্ছেন অনেকে আবার বেকারত্ব থেকে মুক্তি ও খারাপ বন্ধু-বান্ধবের সঙ্গে মিশে অপরাধী হয়ে উঠছেন। এদের কেউ কেউ দুর্ধর্ষ অপরাধীর খাতায় নাম লেখাচ্ছেন। ডিবির তদন্ত সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, প্রকৌশলী আশরাফুলের বাড়ি কুষ্টিয়া জেলার কুমারখালী থানার রাহিনী পাড়ায়। তিনি ওই এলাকার সেলিম শেখ ও আয়শা বেগমের ছেলে। ঢাকার মোহাম্মদপুরের নবোদয় হাউজিং এলাকায় স্ত্রী সন্তান নিয়ে থাকতেন। ২০০৭ সালে তিনি ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ার পাস করেন। ২০১২ সালে ইবাইস ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি থেকে ইলেকট্রিক্যাল অ্যান্ড ইলেকট্রনিক ইঞ্জিনিয়ারিং পাস করেন। বিভিন্ন সময় চাকরি করেন আজমেরি প্রপার্টিস লিমিটেড, ডাইমেনশন ডিজাইজন ও মোহাম্মদীয়া হাউজিং লিমিটেডে। এসব প্রতিষ্ঠানে তিনি ভালো বেতনে চাকরি করতেন। তার সর্বশেষ কর্মস্থল ছিল ফ্যাক্টরি ইঞ্জিনিয়ারিং হিসাবে বিশ্বাস গ্রুপে। সেখানে তিনি ৩৫ হাজার টাকা বেতন পেতেন। তার কাজ ছিল টেক্সটাইল সামগ্রী একটি মিনি ট্রাক দিয়ে এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় আনা নেয়া করানো। সেই মিনি ট্রাকের চালকের কাছ থেকে তিনি ছিনতাইয়ের প্রথম দীক্ষা নেন কীভাবে দিনে-দপুরে ছিনতাই করা যায়। তার সেই গুরুর নাম লেলিন শেখ। 

চাকরি করে আশরাফুল বেশকিছু টাকা সঞ্চয় করেছিলেন। এরমধ্যে ৬ লাখ টাকা ইভ্যালী আর ৫ লাখ টাকা আলিশা মার্টে বিনিয়োগ করেন। লাভসহ বিনিয়োগের টাকার চেক পেলেও টাকা পাননি। এছাড়া করোনাকালীন সময়ে চাকরি নিয়েও বেশ সমস্যায় পড়েন। পরে লেলিন শেখের সহযোগিতায় তিনি ছিনতাই পেশায় জড়ান। বছরের মাথায় হয়ে ওঠেন দুর্ধর্ষ ছিনতাইকারী। লেলিনকে সঙ্গে নিয়ে গত দুই বছরে অন্তত ৫ শতাধিক ছিনতাই করেছেন। কামিয়েছেন কোটি টাকার উপরে। তবে তাদের কাছ থেকে উদ্ধার করা হয়েছে ১১ লাখ টাকা। ডিবি জানিয়েছে, শহরের কিছু নির্দিষ্ট এলাকায় মোটরসাইকেলে করে ঘুরে ঘুরে  তারা ছিনতাই করতেন। ব্যাংক থেকে টাকা উঠিয়ে রিকশা করে গেলে তারা পেছন থেকে মোটরসাইকেলে এসে টান দিয়ে টাকার ব্যাগ নিয়ে চলে যেতো। এসব ব্যাগে অনেক সময় ল্যাপটপ পেতো। আবার অনেক সময় লাখ লাখ টাকা মিলতো।

গত ১৩ই মে শুক্রবার গোয়েন্দা পুলিশের সাইবার অ্যান্ড স্পেশাল ক্রাইম বিভাগের একটি টিম আরও দুই প্রকৌশলীকে গ্রেপ্তার করেছে। তাদের মধ্যে মো. সাঈদ হাসান সাগর (২৫) রাজশাহীর বরেন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয় কলেজ থেকে বিসএসসি ইঞ্জিনিয়ারিং করেছেন। আর মো. নয়ন আলী ওরফে নিয়ন আহম্মেদ রাজশাহী পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট থেকে ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ারিং করেছেন। দ্রুত ধনী হওয়ার জন্য তারা সাইবার অপরাধে জড়ান। এই দুই প্রকৌশলী প্রবাসীদের টার্গেট করে কাজ করতেন। তারা মূলত সুন্দরী নারীর টোপ দিয়ে ইমো হ্যাক করে প্রবাসীদের কাছ থেকে প্রতারণা করে টাকা হাতাতেন। এছাড়া প্রবাসীদের ইমো হ্যাক করেও প্রতারণা করতেন। প্রতারণার মাধ্যমে একেকজন বছরে ১৫ থেকে ২০ লাখ টাকা আয় করেছেন। প্রবাসীদের ফাঁদে ফেলার জন্য তারা প্রবাসীদের বিভিন্ন গ্রুপে কমেন্টের মাধ্যমে জানাতেন ইমো সেক্স করতে চাইলে এই নম্বরে কল করুন। সুন্দরী মেয়েদের নম্বর ও সুন্দরী মেয়ে লাগলে কল করুন। সুন্দরী মেয়েদের সঙ্গে সেক্স করতে চাইলে ও ভালো মনের বন্ধু চাইলেও যোগাযোগ করার কথা বলতেন। এছাড়া ইউটিউবে সুন্দরী মেয়েদের ছবি দিয়ে চ্যানেল খুলতেন। সেখানে মেয়েদের ভিডিও সংগ্রহ করে তার সঙ্গে ভয়েস এডিট করে ইউটিউবে ভিডিও প্রচার করতেন। ভিডিওতে প্রবাসীদের আকৃষ্ট করার জন্য বিশেষ অ্যাপস ব্যবহার করে তারা নারী কণ্ঠে আপত্তিকর কথাবার্তা বলতেন। তারা প্রবাসীর ইমোতে কল দিয়ে মেয়ে কণ্ঠে কথা বলে তাদের ইমোতে কল দেয়ার কথা বলতে বলতেন। তাদের ইমোতে কল দিলেই প্রবাসীদের ব্যক্তিগত নম্বর পেয়ে যেতেন। এছাড়া নারী কণ্ঠে কথা বলে প্রবাসীদের আকৃষ্ট করে সরাসরি মোবাইল নম্বর চেয়ে নিতেন। ওই নম্বর দিয়ে প্রতারকরা নিজেরাই ইমো অ্যাকাউন্ট খুলতেন।

একটি অ্যাকাউন্ট নিয়ন্ত্রণে  নেয়ার পর কন্টাক্ট লিস্টের কথোকথন পর্যালোচনা, লেনদেন, পারিবারিক তথ্য, ব্যক্তিগত ছবি, ভিডিও আয়ত্বে নিয়ে ব্ল্যাকমেইল করতেন। বিভিন্ন সমস্যার কথা বলে তাদের কাছে টাকা চেয়ে মেসেজ পাঠাতেন। প্রবাসীদের পরিবারের সদস্যদের ফোন দিয়ে প্রবাসীরা বিপদে পড়েছেন, পুলিশে ধরে নিয়েছে, সড়ক দুর্ঘটনা ঘটেছে বা কিডন্যাপ হয়েছে বলে টাকা নিতো। গোপন ছবি ও ভিডিও দিয়ে ব্ল্যাকমেইল করেও লাখ লাখ টাকা হাতিয়েছেন। ২০২১ সালের মে মাসে ঢাকার কামরাঙ্গীচরের নোয়াগাঁও এলাকায় অভিযান চালিয়ে ডিবি একটি জাল টাকার মিনি কারখানার সন্ধান পায়। আর এই কারখানাটি চালাতেন দুজন ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ার। ওইদিনের অভিযানে ইমাম হোসেন, পিয়াস ও জীবন নামের তিনজনকে গ্রেপ্তার করা হয়।

তাদের মধ্যে পিয়াস নেটওয়ার্ক ইঞ্জিনিয়ারিং ও ইমাম কম্পিউটার সায়েন্সে বরিশাল পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট থেকে লেখাপড়া করেছেন। ইমাম একটি টেলিকম কোম্পানিতে আউটসোর্সিংয়ে কাজ করতেন। একইভাবে  পিয়াসও আরেকটি কোম্পানিতে প্রকৌশলী হিসাবে কাজ করতেন। বেশি টাকা ও দ্রুত ধনী হওয়ার লোভে তারা ভালো চাকরি ছেড়ে জাল টাকা বানানোর মিশনে নেমে পড়েন। তবে তারা যে জাল টাকা তৈরি করতেন তার মান অন্য জাল টাকার চেয়ে উন্নত। যেটি খুব এক্সপার্ট ছাড়া শনাক্ত করা কঠিন। অভিযানে তাদের কাছ থেকে ৪৬ লাখ টাকার জাল নোট উদ্ধার করা হয়েছিল।