[ অনলাইন ] 01/06/2022
 
আবার সংকটে পড়তে যাচ্ছে পোশাক খাত
তৈরি পোশাক রপ্তানিতে স্বস্তি কমে আসছে। কমে যাচ্ছে রপ্তানি আদেশ। ক্রেতারা আগে দেওয়া রপ্তানি আদেশ কাটছাঁট করছেন। চাহিদা কমে আসার কারণে দামও কম দেওয়ার সুযোগ নিতে শুরু করেছেন ক্রেতারা। অবিক্রীত ব্র্যান্ড পোশাকের স্টক বাড়ছে। রপ্তানি আয়েও এ চিত্র ফুটে উঠতে শুরু করেছে। মে মাসের গত ২৯ দিনে আগের মাসের একই সময়ের তুলনায় রপ্তানি কম হয়েছে ৮৭ কোটি ডলার বা সাত হাজার ৭৪৩ কোটি টাকা। আগামী মাসগুলোতে রপ্তানির চিত্র আরও খারাপের দিকে যেতে পারে। উদ্যোক্তারা বলছেন, করোনাকালের মতো আবার সংকটে পড়তে যাচ্ছে পোশাক খাত।

রাশিয়া-ইউক্রেনের মধ্যে চলমান যুদ্ধের জেরে ইউরোপ এবং আমেরিকায় লাগামহীন মূল্যস্ম্ফীতি ও ভোগক্ষমতা কমে আসার কারণে এ পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) তথ্য সরবরাহ সংস্থা ইউরোস্ট্যাটের তথ্য বলছে, এপ্রিলে ইউরো অঞ্চলের গড় মূল্যস্ম্ফীতি রেকর্ড ৭ দশমিক ৫ শতাংশ। কোনো কোনো দেশে এ হার ১০ শতাংশের বেশি। ইইউ বাংলাদেশের পোশাকের প্রধান বাজার। পোশাকের মোট রপ্তানির ৫০ থেকে ৫৫ শতাংশ এ জোটের ২৭ দেশগুলোতে যায়। ইইউ থেকে বেরিয়ে যাওয়া যুক্তরাজ্যে যায় ১১ থেকে ১২ শতাংশ।

উদ্যোক্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর পর প্রথম দিকে রাশিয়ায় রপ্তানি কমে যায়। তবে ইউরোপ এবং আমেরিকায় রপ্তানি নিয়ে সমস্যা হয়নি। তবে যুদ্ধ দীর্ঘায়িত হওয়ায় অর্থনৈতিক সংকট এবং মূল্যস্ম্ফীতির চাপে গত এক মাস ধরে দুই প্রধান বাজার থেকে রপ্তানি আদেশের প্রবাহ কমে আসছে।

নারায়ণগঞ্জের ফতুল্লা অ্যাপারেলসে কয়েক মাস আগেও রপ্তানি আদেশের অভাব ছিল না। কিন্তু প্রতিষ্ঠানটি ঈদের পর থেকে গতকাল পর্যন্ত নতুন একটি রপ্তানি আদেশও পায়নি। উপরন্তু এক ক্রেতা মাত্র ১১ হাজার পিস বেবিওয়্যারের রপ্তানি আদেশও আপাতত বাদ দেওয়ার অনুরোধ করেছেন। আরেক ক্রেতা দাম কম দিতে চাইছেন। প্রতিষ্ঠানটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক ফজলে শামীম এহসান সমকালকে বলেন, নেদারল্যান্ডসের একটি ব্র্যান্ডের ৮০ হাজার পিস স্পোর্টসওয়্যার নেওয়ার কথা। দেড় মাস ধরে আলোচনার পর এখন তারা প্রতি পিসে ২০ সেন্ট করে কম দিতে চায়। তিনি বলেন, মাত্র দুই মাস আগেও ক্রেতাদের সঙ্গে দর নিয়ে কোনো সমস্যা হয়নি।

যা চাওয়া হয়েছে তাই দিয়েছেন ক্রেতারা। ধামরাইয়ের কিউট ড্রেসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক শেখ এইচ এম মোস্তাফিজ জানান, ঈদের পর রপ্তানি আদেশ তো দূরে থাক, কোনো ক্রেতা যোগাযোগও করেননি। তাঁর শঙ্কা, করোনা শুরুর পর ২০২০ সালের এপ্রিলে মে মাসে যে চরম সংকট ছিল সে রকম সংকটের দিকে যাচ্ছে পরিস্থিতি। ইতাল টেক্সটাইলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সারওয়ার আলম জানান, কাঁচামাল ঊর্ধ্বগতির মধ্যে মুনাফা এমনিতেই কম। এর মধ্যে পর্যাপ্ত কাজ হাতে না থাকলে সামনে বড় বিপদ অপেক্ষা করছে।

পোশাক উৎপাদন ও রপ্তানিকারক উদ্যোক্তাদের সংগঠন বিজিএমইএ সূত্রে জানা গেছে, চলতি মে মাসের গত ২৯ দিনে ২৭০ কোটি ডলারের পোশাক জাহাজীকরণ হয়েছে। আগের মাস এপ্রিলে যার পরিমাণ ছিল ৩৬০ কোটি ডলার। চলতি অর্থবছরের কোনো কোনো মাসে ৪০০ থেকে ৪৫০ কোটি ডলারের রপ্তানি হয়েছে।

ক্ল্যাসিক গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এবং বিজিএমইএর সহসভাপতি শহিদুল্লাহ আজিম সমকালকে বলেন, মূল্যস্ম্ফীতির কারণে খাদ্যপণ্যের পেছনেই ইউরোপীয়দের এখন বড় ব্যয় করতে হচ্ছে। এ কারণে পোশাকের চাহিদা সেখানে দিন দিন কমছে। বিশেষ করে বিলাসী পণ্য হিসেবে উচ্চমূল্যের পোশাকের চাহিদা কমেছে উল্লেখযোগ্য হারে। বিজিএমইএ সূত্রে জানা গেছে, মোট রপ্তানি আয়ে উচ্চমূল্যের পোশাকের অংশ এখন ২৪ শতাংশ।

প্রবণতা পর্যবেক্ষণে দেখা যায়, গত বছর জুলাই-আগস্ট সময়ে বৈশ্বিক অতিমারি করোনাভাইরাসের সংক্রমণ থেকে পরিস্থিতি কিছুটা স্বাভাবিক হয়ে আসতেই পোশাকের চাহিদা হঠাৎ ব্যাপক বেড়ে যায়। চাহিদার এ ঊর্ধ্বগতির সুবিধা কাজে লাগাতে ব্র্যান্ড এবং ক্রেতারা পোশাক সংগ্রহের পরিমাণ বাড়াতে থাকে। যুদ্ধ সেই চিত্র বদলে দিয়েছে। বিশাল স্টক দুশ্চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে ব্র্যান্ডগুলোর। ক্রেডিট রেটিং কোম্পানি এস অ্যান্ড পির ভোক্তাসূচকের বরাত দিয়ে ব্লুমবার্গের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ওয়ালমার্ট, টার্গেট ও গ্যাপ- এ তিন ব্র্যান্ডের হাতে অতিরিক্ত ৪৫ বিলিয়ন ডলারের পণ্যের স্টক পড়ে আছে। বাংলাদেশের পোশাকের বড় ক্রেতা এসব ব্র্যান্ড। অন্যান্য ব্র্যান্ডেরও স্টক বাড়ছে। কারণ খুচরা বিপণিতে বিক্রি কমে গেছে। লোকসান ঠেকাতে এ ব্র্যান্ডগুলো কম চাহিদার পণ্যের দর কমাতে বাধ্য হচ্ছে।

পিআরআইর নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর সমকালকে বলেন, পোশাক খাত এখন দুই দিক থেকে বিপদে রয়েছে। প্রথমত, বিশ্ব অর্থনীতিতে এক ধরনের স্থবিরতা চলছে। ফলে চাহিদা কমছে পোশাকের। আবার কাঁচামালের অস্বাভাবিক ঊর্ধ্বগতির কারণে মুনাফা পাচ্ছেন না উদ্যোক্তারা। গত কয়েক মাসে বড় অঙ্কের রপ্তানি আয় দেখা গেলেও নিট মুনাফা কম ছিল। এর সঙ্গে চাহিদা কমে আসায় উদ্বেগজনক পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। তিনি মনে করেন, এ অবস্থায় উৎসে কর না বাড়িয়ে সরকার রপ্তানি খাতকে সহায়তা দিতে পারে। এ ছাড়া স্থানীয় মূল্য সংযোজন বাড়াতে হবে।