[ প্রথম পাতা ] 09/06/2022
 
খরচের বোঝা ভারী হচ্ছে আরও
কর্মহীনতা ও বেকারত্ব বৃদ্ধি এবং খাদ্যসহ সব ধরনের ভোগ্যপণ্যের অগ্নিমূল্যের কারণে সাধারণ মানুষ সংসার চালাতে গিয়ে এমনিতেই হিমশিম খাচ্ছে। চিকিৎসা, শিক্ষাসহ বিভিন্ন খাতের বাজেট কাটছাঁট করে তারা পরিবার-পরিজন নিয়ে কষ্টে দিনাতিপাত করছে। এই দুঃসময়ে গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধি যেন 'মরার উপর খাঁড়ার ঘা' হয়ে দাঁড়িয়েছে।

অর্থনীতিবিদ ও বাজার পর্যবেক্ষকরা বলছেন, গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধির কারণে বাজারব্যবস্থা, উৎপাদন, বণ্টনসহ সব ক্ষেত্রে ব্যাপক প্রভাব পড়বে। শিগগিরই বিদু্যতের দামও বাড়বে। এতে নিত্যপণ্যসহ সব ধরনের পণ্যমূল্য আরেক দফা বৃদ্ধি পাবে। করোনার কারণে সাধারণ মানুষের আয় কমে যাওয়ার পাশাপাশি রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে নিত্যপণ্যের দাম বৃদ্ধির মুখে নতুন চাপ জনজীবন দুর্বিষহ করে তুলবে।

সংশ্লিষ্টরা জানান, সার উৎপাদনের ক্ষেত্রে গ্যাসের মূল্য ২৫৯ দশমিক ৫৫ শতাংশ বেড়েছে। আগে প্রতি ঘনমিটার গ্যাসের জন্য সার কারখানাগুলো ৪ টাকা ৪৫ পয়সা করে দিত। এখন দিতে হবে ১৬ টাকা। এতে সারের দাম হু হু করে বাড়বে। আর বাড়তি দরে সার কিনে কৃষকরা ফসল উৎপাদন করায় সব ধরনের খাদ্যশস্যের দাম স্বাভাবিকভাবেই বৃদ্ধি পাবে।

তবে অর্থনীতিবিদরা অনেকেই মনে করেন, সরকার হয়তো কৃষককে অতিরিক্ত দামে সার কিনতে বাধ্য করবে না। এ খাতে ভর্তুকি দিয়ে দাম সহনীয় পর্যায়ে রাখবে। সে ক্ষেত্রে সারের জন্য ভর্তুকির পরিমাণ বেড়ে যাবে। ফলে গ্যাসের দাম বাড়িয়ে রাজস্ব ঘাটতি পূরণ করার যে কৌশল সরকার অবলম্বন করতে চাচ্ছে, আরেক খাতে অতিরিক্ত ভর্তুকি দিয়ে সেই কৌশলও ক্ষতিগ্রস্ত হবে।

অন্যদিকে বড় শিল্পে প্রতি ঘনমিটার গ্যাসের দাম ১১ টাকা ৯৮ পয়সা এবং মাঝারি শিল্পে ১১ টাকা ৭৮ পয়সা করায় শিল্প কারখানার পরিচালনা ব্যয় বাড়বে। এর ফলে সেসব কারখানার পণ্যের দাম বাড়বে। যা সংসার খরচের বোঝা আরও ভারী করে তুলবে।

এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের গবেষক ও অর্থনীতিবিদ নাজনীন আহমেদ বলেন, গ্যাসের দাম বাড়ার কারণে সাধারণ মানুষের গৃহস্থালির খরচ বাড়বেই। পাশাপাশি শিল্প কারখানায় পণ্য উৎপাদন ব্যয় বাড়ায় সেসব পণ্যের দাম বাড়ার চাপও তাদের ওপর পড়বে। যা সামাল দেওয়া সাধারণ মানুষের পক্ষে কঠিন হয়ে দাঁড়াবে।

শিল্পমালিকরা বিষয়টি স্বীকার করে বলেন, গ্যাসের দাম বৃদ্ধির কারণে শুধু উৎপাদন খরচই বাড়বে না, এতে শিল্পের প্রতিযোগিতা সক্ষমতাও কমবে। করোনা মহামারির প্রকোপ নিয়ন্ত্রণে আসার পর শিল্প কারখানার অর্থনীতি কেবল ঘুরে দাঁড়াতে শুরু করেছিল, তা ভীষণভাবে ব্যাহত হবে।

এ ছাড়া পুরোপুরি গ্যাসনির্ভর শিল্পগুলো নতুন করে বিপদের মধ্যে পড়বে। তাদের ব্যয় বিদু্যৎনির্ভর কারখানার চেয়ে কয়েকগুণ বেশি হবে। এতে গ্যাস পুড়িয়ে উৎপাদিত পণ্যের মূল্য আকাশচুম্বী হয়ে উঠবে। যা সাধারণ মানুষের দুর্ভোগ আরও বাড়াবে। একই সঙ্গে উদ্যোক্তারাও প্রতিযোগিতার সক্ষমতা হারাবে। গ্যাসভিত্তিক বেশকিছু মাঝারি শিল্পকারখানা বন্ধ হয়ে যেতে পারে বলেও আশঙ্কা করছেন অনেকে।

শিল্প উদ্যোক্তারা বলছেন, জ্বালানি গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধির কারণে শুধু দেশের শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলোতেই নয়, সার্বিক অর্থনীতিতেও নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। মধ্যম আয়ের দেশে বাংলাদেশের উন্নীত হওয়ার পথে এ সিদ্ধান্ত অন্তরায় হয়ে দাঁড়াতে পারে। সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রায়ও ভোগান্তি বাড়বে।

অর্থনীতিবিদরাও একই আশঙ্কা প্রকাশ করে বলেন, নতুন করে গ্যাসের দাম আরও একধাপ বাড়ায় পোশাক শিল্প থেকে শুরু করে অর্থনীতির প্রায় প্রতিটি খাতে ভয়াবহ নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে। সংশ্লিষ্টদের ভাষ্য, এখনই অধিকাংশ কারখানা নিরবচ্ছিন্ন গ্যাস পাচ্ছে না, গ্যাসের পর্যাপ্ত চাপও অনেক সময় থাকে না। অথচ প্রতিমাসে গ্যাস বিল ঠিকই পরিশোধ করতে হচ্ছে। গ্যাসের দাম বাড়ায় উৎপাদন খরচ বেড়ে যাবে। আর উৎপাদন খরচ বেড়ে গেলে বৈশ্বিক প্রতিযোগিতায় টিকে থাকা কঠিন হয়ে পড়বে। দেশের বাজারেও এর বিরূপ প্রভাব পড়বে। বিভিন্ন শিল্প, বিশেষ করে পোশাক শিল্পে বিদেশি ক্রেতার কার্যাদেশ (অর্ডার) কমে গেলে গার্মেন্টস মালিকরা কর্মী ছাঁটাইয়ের দিকে ঝুঁকবে। এতে নতুন করে বেকারত্ব বাড়বে। পরিবারের উপার্জনক্ষম সদস্যের সংখ্যা কমে গেলে সংসারের বোঝা আরও ভারী হয়ে উঠবে।

ব্যবসায়িক নেতারা মনে করেন, গ্যাসের দাম বাড়ার কারণে দেশি-বিদেশি বিনিয়োগ নিরুৎসাহিত হবে। এতে দেশের পুরো অর্থনীতিতেই এর নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। দেশে প্রয়োজনীয় জ্বালানির ৭৪ শতাংশ প্রাকৃতিক গ্যাসের মাধ্যমে পূরণ হওয়ায় গ্যাসের দাম বৃদ্ধির কারণে শিল্প খাত বিপর্যস্ত হবে। এর ফলে সাধারণ জনগণের জীবনযাত্রার ব্যয় অনেকাংশে বেড়ে যাবে। বিশেষ করে বাণিজ্যিক উৎপাদন ও নিত্যপণ্যের দাম বৃদ্ধিতে মূল্যস্ফীতিও বাড়বে।

টেক্সটাইল মালিক রাজীব আহম্মেদ বলেন, শিল্প খাতে ব্যবহৃত ১৭ শতাংশ গ্যাসের বড় অংশই টেক্সটাইল মিল ও তৈরি পোশাক শিল্পে ব্যয় হয়। বিশেষ করে টেক্সটাইল মিলগুলো মূলত স্পিনিং, উইভিং, ডায়িং ও ফিনিশিং ইউনিট পরিচালনা করে। আকস্মিক গ্যাসের দাম বাড়লেও সঙ্গে সঙ্গে বিদেশি ক্রেতাদের কাছ থেকে বাড়তি দাম আদায় করা সম্ভব হবে না। অথচ অধিকাংশ শিল্পকারখানার আগামী ছয় মাসের অর্ডার নেওয়া রয়েছে। ফলে সামগ্রিকভাবে এ খাত ক্ষতিগ্রস্ত হবে। তিনি আরও বলেন, বৈশ্বিক প্রতিযোগিতায় নেমে বর্তমানে পোশাকের ন্যায্যমূল্য পেতে হিমশিম খেতে হচ্ছে। তদুপরি আবার গ্যাসের দাম বৃদ্ধি রপ্তানি খাতকে বেকায়দায় ফেলবে।

বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) অতিরিক্ত গবেষণা পরিচালক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, গ্যাসের দাম বৃদ্ধির কথা অনেক দিন ধরেই আলোচনায় ছিল, যার আনুষ্ঠানিক ঘোষণা এলো। গ্যাসের দাম বৃদ্ধির প্রভাব দেশের সব সেক্টরের ওপরই পড়বে। ফলে মূল্যস্ফীতি বেড়ে যাবে।

কনজু্যমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সভাপতি গোলাম রহমান বলেন, প্রতিবছরই জীবনযাত্রার ব্যয় বাড়ছে। এর ওপর গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধির কারণে উৎপাদনসহ জনজীবনের ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। সাধারণ মানুষকে এর বড় মাশুল দিতে হবে।

বাণিজ্যিক খাতে (হোটেল, রেস্টুরেন্ট এবং অন্যান্য) প্রতি ঘনমিটার গ্যাসের দাম বাড়িয়ে ২৬ টাকা ৬৪ পয়সা করায় জনজীবনে এরও নেতিবাচক প্রভাব পড়ার আশঙ্কা রয়েছে।