[ ১ম পাতা ] 09/06/2022
 
বৈশ্বিক রিজার্ভে ডলারের অংশ ৫৯ শতাংশ
বিশ্বের বৃহত্তম অর্থনীতির দেশ যুক্তরাষ্ট্র। মুদ্রাবাজারে দেশটির মুদ্রা ডলারের প্রভাবও সবচেয়ে বেশি। সাম্প্রতিক বছরগুলোয় বৈশ্বিক অর্থনীতিতে মার্কিন অংশীদারত্ব কমছে। এর মধ্যেও ডলার তার নিজস্ব প্রভাব ধরে রেখেছে। বেশ কিছুদিন ধরেই বাজারে মুদ্রাটির প্রভাব নিম্নমুখী। রিজার্ভ মুদ্রা হিসেবেও একটু একটু করে আকর্ষণ হারাচ্ছে ডলার। গত দুই দশকে বিশ্বব্যাপী কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলোর রিজার্ভ তহবিলে মুদ্রাটির অংশ কমেছে অন্তত ১৩ শতাংশীয় পয়েন্ট।

বৈশ্বিক অর্থনীতিতে মার্কিন আধিপত্য এখন অনেকটাই টলায়মান। অদূরভবিষ্যতেই চীন যুক্তরাষ্ট্রকে ছাড়িয়ে বিশ্বের শীর্ষ অর্থনীতিতে রূপ নেবে বলে পূর্বাভাস রয়েছে। এর পরও এখনো বিশ্বের বিভিন্ন দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের রিজার্ভে প্রধান বৈদেশিক মুদ্রা হিসেবে ডলারকেই বিবেচনা করা হয়ে থাকে। আন্তর্জাতিক বাণিজ্য বা বৈদেশিক ঋণ পরিশোধ অথবা ব্যাংকবহির্ভূত ঋণ গ্রহণ ও পরিশোধের মাধ্যম হিসেবে ডলারের অবস্থান শীর্ষে। এমনকি খোদ যুক্তরাষ্ট্রের মোট বাণিজ্য, ইস্যুকৃত বন্ড অথবা প্রদত্ত ও গৃহীত মোট বৈদেশিক ঋণের সম্মিলিত পরিমাণের চেয়েও কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলোর রিজার্ভে থাকা ডলারের পরিমাণ অনেক বেশি। তবে এ পরিস্থিতিতে এখন পরিবর্তনের সম্ভাবনা দেখতে পাচ্ছেন মুদ্রাবাজার বিশ্লেষক ও পর্যবেক্ষকরা।

সত্তরের দশকেও বিশ্বব্যাপী কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলোর মোট বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের ৮৫ শতাংশই ছিল ডলারে। বৈশ্বিক মোট রিজার্ভে ডলারের অংশ কমতে শুরু করে চলতি শতকের শুরুতে এসে। বর্তমানে ডলারের আধিপত্যে হুমকি সৃষ্টি করেছে ইউরো ও চীনা রেনমিনবির মতো মুদ্রাগুলো। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) তথ্য অনুযায়ী, গত দুই দশকে (১৯৯৯ সাল থেকে গত বছর পর্যন্ত) বিশ্বব্যাপী বিভিন্ন দেশের রিজার্ভ তহবিলের ডলারের অবদান কমেছে অন্তত ১৩ শতাংশীয় পয়েন্ট। ১৯৯৯ সালে বিভিন্ন রিজার্ভ তহবিলে ডলারের মোট অবদান ছিল কমপক্ষে ৭২ শতাংশ। গত বছরের শেষে তা এসে দাঁড়িয়েছে ৫৯ শতাংশে।

বিশ্বব্যাপী কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলো রিজার্ভের জন্য এখন আর শুধু ডলারের ওপর নির্ভর করে নেই। বিভিন্ন মুদ্রার মিশ্রণে রিজার্ভে বৈচিত্র্য আনার কৌশল নিচ্ছেন মুদ্রানীতির নীতিনির্ধারকরা। উদাহরণ হিসেবে বলা যায় ব্যাংক অব ইসরায়েলের কথা। সম্প্রতি ইসরায়েলের কেন্দ্রীয় ব্যাংক নতুন এক রিজার্ভ কৌশল প্রকাশ করেছে। ব্যাংকটির হাতে মোট রিজার্ভের পরিমাণ ২০ হাজার কোটি ডলার। চলতি বছরের শুরু থেকেই এ রিজার্ভে ডলারের অংশ কমানোর উদ্যোগ নিয়েছে ব্যাংক অব ইসরায়েল। অস্ট্রেলীয় ডলার, কানাডীয় ডলার, চীনা রেনমিনবি (ইউয়ান) ও জাপানি ইয়েনের সংমিশ্রণে নিজস্ব রিজার্ভ পোর্টফোলিও সমৃদ্ধ করার কৌশল হাতে নিয়েছে ব্যাংকটি।

রিজার্ভের মুদ্রা বণ্টন ব্যবস্থায় চলমান এ পরিবর্তনের বড় একটি ভূমিকা রয়েছে ভূরাজনীতিরও। দীর্ঘদিন ধরেই মার্কিন নেতৃত্বাধীন পশ্চিমা ব্লকের সঙ্গে বিরোধিতা চলছে রাশিয়ার। ইউক্রেন যুদ্ধের অনেক আগে থেকেই দেশটির ওপর নানা মার্কিন বিধিনিষেধ আরোপ করা ছিল। এর পরিপ্রেক্ষিতে ডলারের ওপর নির্ভরতা কমিয়ে রিজার্ভ ও আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে অন্যান্য মুদ্রার ব্যবহার বাড়িয়েছে রাশিয়া। বিশেষ করে চীনা রেনমিনবির মজুদ ক্রমেই বাড়িয়ে তুলেছে দেশটি। চলতি বছরের শুরুতে রেনমিনবির বৈশ্বিক রিজার্ভের এক-তৃতীয়াংশই ছিল রুশ কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মালিকানায়। ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর পর মুদ্রাটির ওপর রাশিয়ার নির্ভরতা আরো বেড়েছে।

শুধু ইউয়ান নয়, রিজার্ভ মুদ্রা হিসেবে সাম্প্রতিক সময়ে তুলনামূলক ছোট অর্থনীতির মুদ্রা ব্যবহার শুরু হয়েছে, যেগুলো আগে কখনই রিজার্ভ হিসেবে ব্যবহার হয়নি। আইএমএফ বলছে, গত কয়েক দশকে রিজার্ভে ডলারের অংশ যেভাবে কমেছে এর বিপরীতে ইউরো, পাউন্ড বা জাপানি ইয়েনের মতো প্রচলিত রিজার্ভ মুদ্রাগুলোর অংশ সেভাবে বাড়েনি। কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলো ডলার বা রিজার্ভ হিসেবে প্রচলিত অন্যান্য মুদ্রার পরিবর্তে তুলনামূলক ছোট অর্থনীতির মুদ্রার মজুদ বাড়াচ্ছে।

এর পেছনে দুটি বিষয় প্রধান কারণ হিসেবে কাজ করে থাকতে পারে বলে মনে করছে আইএমএফ। প্রথমত, এসব মুদ্রায় মুনাফা বেশি। একই সঙ্গে অস্থিতিশীলতাও কম। এতে রিজার্ভের পরিমাণ বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে এর পোর্টফোলিওতেও বৈচিত্র্য নিয়ে আসছেন কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলোর মুদ্রা ব্যবস্থাপকরা। দ্বিতীয়ত, দেশে দেশে আর্থিক খাতে এখন প্রযুক্তির ব্যবহার বাড়ছে। বাজার ও তারল্য ব্যবস্থাপনার বিষয়টি এখন দিনে দিনে আরো স্বয়ংক্রিয় হয়ে উঠছে। একই সঙ্গে ডলারের পরিবর্তে তুলনামূলক ছোট অর্থনীতির মুদ্রা ব্যবহারও আরো সহজ ও সাশ্রয়ী হয়ে দাঁড়িয়েছে।

সংস্থাটির ভাষ্য অনুযায়ী, ডলারবহির্ভূত এসব মুদ্রার ইস্যুকারী কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলো দ্বিপক্ষীয় সোয়াপ লাইনের আওতায় ফেডারেল রিজার্ভের কাছ থেকে ডলার সংগ্রহ করে থাকে। এতে সংশ্লিষ্ট কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলোও মনে করছে, ডলারের বিপরীতে মুদ্রাগুলোর বিনিময় হারের স্থিতিশীলতা বজায় থাকবে। এ বিষয়ই মুদ্রাগুলোকে নিয়ে বিভিন্ন দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের আস্থা বাড়াচ্ছে।

ডলারের আধিপত্য হারানোর বিষয়টি বিশ্লেষক মহলে প্রথম আলোচনার ঝড় তোলে কভিডের প্রাদুর্ভাব দেখা দেয়ার পর। ওই সময় নভেল করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবজনিত অভিঘাত মোকাবেলায় বেশকিছু নীতিগত পদক্ষেপ নেয় যুক্তরাষ্ট্র। এর ধারাবাহিকতায় ডলারের বিনিময় হারও কমতে থাকে। সে সময় রিজার্ভ হিসেবে ডলারের আধিপত্য হারানোর সম্ভাবনা নিয়ে আলোচনা শুরু করে গোল্ডম্যান স্যাকস, জেপি মরগানের মতো বিনিয়োগ ব্যাংকগুলো। বিশেষ করে চীন কভিডের আঘাত কাটিয়ে সবার আগে অর্থনীতি চালু করতে সক্ষম হলে মুদ্রাবাজারে রেনমিনবির প্রভাব বাড়তে থাকে। এর বিপরীতে কমতে থাকে ডলারের প্রভাব।