[ সারাদেশ ] 30/07/2022
 
পাচারকারীদের 'ঢাল' হয়ে উঠছে প্রযুক্তি
বছর তিনেক আগে শরীয়তপুরের নড়িয়ার তরুণ রোমান হোসেন ফেসবুকে দালালদের প্রলোভনে পড়ে ইতালি যেতে চেয়েছিলেন। তাঁকে লিবিয়া হয়ে ইতালি পৌঁছে দেওয়ার কথা থাকলেও দুবাই নিয়ে আটকে রাখা হয়। পরে ছাড়া পেলেও এখন পর্যন্ত মানবেতর জীবন কাটাচ্ছেন সেখানেই। তাঁকে ইতালি পাঠাতে গিয়ে পরিবার ঋণগ্রস্ত হয়েছে, ঋণের কিস্তি দিতে গিয়ে নিঃস্ব হয়েছে তারা।

গতকাল শুক্রবার ফোনে রোমান বলছিলেন, ইতালি যেতে দালালদের ৬ লাখ টাকা দিয়েছিলেন। চরম ভোগান্তির পর আটকে পড়েন দুবাইয়ে। অবৈধ হওয়ায় রয়েছেন মানবেতরভাবে।

একই জেলার বাসিন্দা কামাল মুন্সি ইতালি যেতে লিবিয়া যান। কয়েক মাস পর দালালরা তাঁর স্বজনকে জানিয়েছে, তিনি সেখানেই স্ট্রোক করে মারা গেছেন। গত কয়েক বছর ধরে কামালের পরিবার নানা ভোগান্তির পরও লাশটি দেশে ফেরত আনতে পারেনি।

পাচারের শিকার হয়ে লিবিয়ার একটি আশ্রয়কেন্দ্রে থাকা আবদুর রাকিব (ছদ্ম নাম) গতকাল রাতে কথোপকথনের অ্যাপস ইমুর মাধ্যমে জানান, এখানেও বাংলাদেশি দালাল রয়েছে। তারা দেখা দেয় না। মেসেঞ্জার ও ইমু ব্যবহার করে কথা বলে। এ জন্য তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থাও নেওয়া যায় না।

এ ভোগান্তিটা শুধু রোমান বা কামালের পরিবারের নয়, পাচার হয়ে ইউরোপে পাড়ি দেওয়া অনেকের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, প্রায় সবাই নানা অ্যাপ ব্যবহার করে পাচারকারীদের সঙ্গে কথোপকথন সেরেছেন, তারা সরাসরি দেখা দেয় না। তারা ইউরোপে পৌঁছতে পারলেও পাসপোর্ট সংক্রান্ত ঝামেলা, কর্মস্থল, থাকাসহ পদে পদে নানা ভোগান্তির শিকার হন। গবেষণা বলছে, ওই দু'জন ইতালিতে পৌঁছতে না পারলেও ২০২২ সালের প্রথম ছয় মাসে অন্তত ১২ হাজার ৬৩৬ জন বাংলাদেশি পাচারকারীদের প্রলোভনে পড়ে অবৈধপথে ইউরোপে গেছেন।

ওই পাচারকারী চক্রের খপ্পরে পড়ে অবৈধভাবে বিদেশে যেতে গিয়ে অনেকেই সাগরে প্রাণ হারাচ্ছেন। যাঁরা বেঁচে যাচ্ছেন, তাঁরাও পড়ছেন নানা ভোগান্তিতে। শুধু তাই নয়; পাচার হওয়া নারীরা পাচারকারীদের বন্দিশালায় থাকতে বাধ্য হচ্ছেন। কখনও পাচারকারীরা গ্রেপ্তার হলেও তাদের বিচারও হয় না, আইনের ফাঁক গলিয়ে বেরিয়ে যায় তারা।

এমন পরিস্থিতিতে 'প্রযুক্তির ব্যবহার ও অপব্যবহার' প্রতিপাদ্যে আজ ৩০ জুলাই পালিত হচ্ছে আন্তর্জাতিক মানব পাচার প্রতিরোধ দিবস-২০২২।

ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের জেমস প্রি প্রান্ট স্কুল অব পাবলিক হেলথের সহায়তায় পরিচালিত বেসরকারি সংস্থা ব্র্যাকের মাইগ্রেশন প্রোগ্রামের এক গবেষণা বলছে, ভূমধ্যসাগর হয়ে ইউরোপে লোক পাঠানো কিংবা ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তের নারী ও শিশু পাচার; সব ক্ষেত্রেই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের ব্যবহার বেড়েছে। গবেষণা প্রতিবেদনটি বলছে, পাচারকারীরা সামাজিক ও অর্থনৈতিকভাবে সংকটে থাকা পরিবারের শিশু-কিশোরীদের পাচারের জন্য টার্গেট করছে।

ব্র্যাকের মাইগ্রেশন প্রোগ্রামের গবেষণা বলছে, গত কয়েক বছরে পাচারের ক্ষেত্রে ফেসবুক, টিকটকসহ সামাজিক যোগাযোগের নানা মাধ্যম অনেক বেশি ব্যবহূত হচ্ছে। অনেক ক্ষেত্রে চাকরি কিংবা নায়িকা বা মডেল বানানোর লোভ দেখিয়ে তাঁদের নিয়ে যাওয়া হয়। পরে তাঁদের মানব পাচার চক্রের কাছে বিক্রি করে দেওয়া হয়।

শুধু তাই নয়, গবেষণায় উঠে এসেছে, ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে যত লোক ইউরোপে প্রবেশের চেষ্টা করছে, বাংলাদেশ এখন সেই তালিকায় তৃতীয়। চলতি বছরের জুন পর্যন্ত অন্তত ১২ হাজার ৬৩৬ জন বাংলাদেশি এভাবে ইউরোপে গেলেও গত এক যুগে অনিয়মিতভাবে ইউরোপে প্রবেশ করেছেন অন্তত ৬৫ হাজার বাংলাদেশি। ব্র্যাকের মাইগ্রেশন প্রোগ্রামের গবেষণা বলছে, এই পাচারের ক্ষেত্রেও সামাজিক যোগাযোগের নানা মাধ্যম ব্যবহূত হয়েছে। বিশেষত ফেসবুকে লিবিয়া টু ইতালি নামে একাধিক গ্রুপ রয়েছে।

ব্র্যাকের মাইগ্রেশন প্রোগ্রামের প্রধান শরিফুল হাসান বলেন, শুধু বাংলাদেশ নয়, বিশ্বজুড়েই মানব পাচারের ঝুঁকিতে থাকা মানুষগুলোকে চিহ্নিত, নিয়ন্ত্রণ ও তাঁদের দুর্বলতার সুযোগ নিতে অপরাধী চক্র এখন প্রযুক্তির ব্যবহার করছে।

বাংলাদেশ থেকে কী পরিমাণ নারী ও শিশু প্রতিবেশী দেশসহ বিভিন্ন দেশে পাচার হয়, তার কোনো সঠিক তথ্য পাওয়া যায় না। তবে ভারতে পাচার হওয়া প্রায় ২ হাজার নারীকে গত ১০ বছরে আইনি প্রক্রিয়ার মাধ্যমে দেশে ফিরিয়ে আনা হয়েছে।

পুলিশের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, ২০১২ সালে মানব পাচার প্রতিরোধ ও দমন আইন হওয়ার পর শুধু ওই আইনেই চলতি বছরের জুন পর্যন্ত ৬ হাজার ৫২০টি মামলা হয়েছে। কিন্তু অধিকাংশ মামলারই কোনো নিষ্পত্তি হয়নি। গত ১০ বছরে মাত্র ৭২৮টি মামলার নিষ্পত্তি হয়েছে। এর মধ্যে মাত্র ৫০টি মামলায় ৯৬ জনের সাজা হয়েছে। বাকিরা অব্যাহতি পেয়ে গেছে।

ওই মামলাগুলোর এজাহারের তথ্যানুযায়ী, ১৩ হাজারেরও বেশি মানুষ পাচারের শিকার। এতে পাচারকারী হিসেবে মোট আসামির সংখ্যা সাড়ে ৩১ হাজারেরও বেশি।

মাইগ্রেশন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বাংলাদেশ থেকে মোট ১৮টি রুটে লোকজন ইউরোপে যাওয়ার কমবেশি চেষ্টা করছেন। ইউরোপের সীমান্তে কাজ করা সংগঠন ফ্রন্টেক্সের তথ্যানুযায়ী, পৃথিবীর যেই দেশ থেকেই আসুক, ইউরোপে ঢুকতে হলে শেষ পর্যন্ত মোট ৯টি পথ ব্যবহূত হয়। বাংলাদেশিরা সবচেয়ে বেশি ব্যবহার করেছে ভূমধ্যসাগর। যেটি সেন্ট্রাল মেডিটেরিয়ান রুট হিসেবে পরিচিত। এই পথে এখন পর্যন্ত প্রায় ৩৮ হাজার বাংলাদেশি ইউরোপে ঢুকেছেন।