[ অনলাইন ] 06/08/2022
 
ফোন করে সাজ্জাদ চাঁদা নেয় মুন্না
-আবদুল্লাহ আল মামুন, চট্টগ্রাম

ভারতে থেকেই চট্টগ্রামের আন্ডারওয়ার্ল্ড নিয়ন্ত্রণ করছে শিবিরের দুর্ধর্ষ ক্যাডার সাজ্জাদ হোসেন খান। তার সমসাময়িক শীর্ষ সন্ত্রাসীরা কেউ কেউ কারাগারে। কেউ আবার ক্রসফায়ারে পড়ে মারা গেছে। কিন্তু সাজ্জাদ আছে বহালতবিয়তেই। ভারত থেকেই সে ঠিক করে নিশানা। পাঠায় চাঁদার বার্তা। তার সেই বার্তা ধরে চট্টগ্রামে চাঁদা তোলে আরেক সন্ত্রাসী বেলাল উদ্দিন মুন্না। একা নয়, মুন্না চাঁদা তুলতে সঙ্গী করে আরও একডজন অনুসারীকে। কথা অনুযায়ী চাঁদা না পেলে গুলি ও বোমা ছোড়ে ঢাকাইয়া আকবর, জালাল, মোবারক ও জিসান। গল্প নয়- এই চিত্র নগরের বিবিরহাট, চালিতাতলী, হাজীরপুল, ওয়াজেদিয়া, নাজিরপাড়া ও শমসেরপাড়ার। এসব এলাকার বাসিন্দারা জানেন সাজ্জাদ ও তার অনুসারীদের অত্যাচারের খবর। পুলিশকেও তাঁরা জানিয়েছেন অভিযোগ। কিন্তু কাজের কাজ হচ্ছে না কিছুই। সাজ্জাদ ও তার অনুসারীদের অত্যাচারের মাত্রা ক্রমশ বাড়ছে। বাড়ছে তাদের চাঁদাবাজির সীমানাও।

চাঁদা চেয়ে ফোন ১৭ জুলাই : গত ১৭ জুলাই ইন্টারনেটের একটি নম্বর থেকে ফোন আসে উদীয়মান ব্যবসায়ী তানভীর আলমের কাছে। মাত্র এক মাস আগে নগরের বায়েজিদ বোস্তামী থানার চালিতাতলী এলাকায় 'কমফোর্ট হোমটেক্স' নামে কারখানা স্থাপন করেছেন তিনি। কোনো কিছু বুঝে ওঠার আগেই টেলিফোনের ওই প্রান্ত থেকে বলা হয়, 'আমি সাজ্জাদ। তুমি তো নতুন কারখানা দিয়েছ। আমাদের অনেক ছেলে জেলে আছে। তাদের বের করে আনতে হবে। অনেক ছেলেপেলে আছে। তাদের খরচ আছে। ব্যবসায়ীরা আমাদের সহযোগিতা করে। আশা করছি তুমিও করবে। তোমাকে ৪৮ ঘণ্টা সময় দিলাম।' এমন চাঁদা দাবির ফোনে তেমন পাত্তা দেননি তানভীর। তিনি ভেবেছিলেন এটি কোনো ভুয়া ফোন।
১৮ জুলাই কারখানা পুড়িয়ে দেওয়ার হুমকি :পরদিন ১৮ জুলাই বেলাল উদ্দিন মুন্নার নির্দেশে তার আরেক সহযোগী জালালের ফোন আসে তানভীরের রবি নম্বরে। এবার সরাসরি হুমকি। 'তোরে ভাই ফোন দিছিল। ভাই বলছে- ২৪ ঘণ্টার মধ্যে পাঁচ লাখ টাকা দিতে। ২৪ ঘণ্টা থেকে ২৪ মিনিট দেরি হলে তোর কারখানা, গাড়ি, তোরেসহ পুড়িয়ে ফেলব।' ফের এমন ফোন পেয়ে ভড়কে যান তানভীর। বিষয়টি এবার গুরুত্বের সঙ্গে নেন। স্বজনদের সঙ্গে পরামর্শ করে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে জানানোর সিদ্ধান্ত নেন তিনি।

১৯ জুলাই বিকেলে জিডি, রাতে কারখানায় আগুন :হুমকির বিষয়টি জানিয়ে ১৯ জুলাই বিকেলে থানায় জিডি করেন তানভীর আলম। জিডি পেয়ে পুলিশ কারখানা পরিদর্শন করে। অভয়ও দেন তাঁরা। কিন্তু শেষ রক্ষা হয়নি। ওইদিন রাত আড়াইটার দিকে কারখানায় নিয়োজিত কর্মচারীর ফোন আসে তানভীরের কাছে। আগুন লেগেছে কারখানায়। ছুটে যান তিনি। দেখেন মাত্র মাসখানেক আগে গড়ে তোলা স্বপ্নের কারখানা পুড়ছে। পরদিন ইন্টারনেট নম্বর থেকে আবারও সাজ্জাদের ফোন। হুমকি দিয়ে বলে, 'কারখানা পুড়িয়েছি। এবার তোকে পুড়িয়ে ফেলব। তুই কীভাবে এখানে ব্যবসা করছ দেখব।'

ব্যবসায়ী তানভীর আলম সমকালকে বলেন, প্রথম দিন সাজ্জাদের ফোন পেয়ে পাত্তা দিইনি। মনে করেছি বিভিন্ন সন্ত্রাসীর নাম ভাঙিয়ে এমন ভুয়া ফোন তো অনেকেই করে। কিন্তু তার কথা অনুযায়ী ৪৮ ঘণ্টা পর কারখানা পুড়িয়ে দেবে এটা ভাবতে পারিনি। প্রায় ৫০ লাখ টাকা বিনিয়োগ করে কারখানা গড়ে তুুলেছিলাম। এখনও পুরোপুরি চালু করিনি। তার আগেই আমার সব শেষ হয়ে গেছে।

চাঁদা না পেলেই গুলি, পেট্রোল বোমা : নতুন বাড়ি নির্মাণ, ব্যবসা-বাণিজ্য, জমি বেচাকেনা করলেই ফোন আসে সাজ্জাদের। রেহায় নেই প্রবাসীদেরও। কেউ নীরবে চাঁদা দিয়ে ঝামেলামুক্ত হন। কেউ আইনের আশ্রয় নেন। চাঁদা দিতে গড়িমসি করলেই বিপদ। কখনও গুলি চালিয়ে ঘরবাড়ি ঝাঁঝরা করে দেওয়া হয়। কখনও আবার ছুড়ে মারে পেট্রোল বোমা। দুই দশক ধরে একই পদ্ধতিতে চালিয়ে আসছে চাঁদাবাজি।

বিবিরহাট এলাকার বাসিন্দা নুরুল আক্কাস সমকালকে বলেন, নগরের হাজীরপুল এলাকায় একটি ভবন নির্মাণ করছি। ২০২০ সালের ২০ এপ্রিল সন্ত্রাসী সাজ্জাদ ফোন করে নির্মাণাধীন ভবন থেকে একটা ফ্ল্যাট অথবা এক কোটি টাকা চাঁদা দাবি করে। চাঁদা না দেওয়ায় পরদিন ভোরে আমাদের বাড়িতে পেট্রোল বোমা হামলা করা হয়। বিষয়টি পুলিশকে জানানোর পর থেকে ভয়েস এসএমএসে পেট্রোল দিয়ে পুড়িয়ে মেরে ফেলাসহ নানা ধরনের হুমকি-ধমকি দিচ্ছে সাজ্জাদ। এর আগে সুন্নিয়া মাদ্রাসা এলাকায় একটি ভবন বিক্রি করেছিলাম তখনও ফোন করে চাঁদা দাবি করেছিল সাজ্জাদ।

২০১৯ সালের ৬ সেপ্টেম্বর চট্টগ্রামে গাড়ির যন্ত্রাংশের ব্যবসায় যুক্ত এক ব্যক্তির কাছ থেকে সাজ্জাদের নামে চাঁদা দাবি করে তার সহযোগী কয়েকজন যুবক। তাদের কথামত চাঁদা না দেওয়ায় ২৩ সেপ্টেম্বর নয়াহাটে ওই ব্যবসায়ীর বাড়িতে পেট্রোল বোমা ছোড়া হয়। একই সময় উজ্জ্বল দেওয়ানজি নামে আরেক ব্যক্তির কাছ থেকেও একই কায়দায় চাঁদা দাবি করা হয়। এ বিষয়ে তদন্তে নেমে ২০১৯ সালের ২৪ অক্টোবর রাতে পাঁচ যুবককে গ্রেপ্তার করে বায়েজিদ থানা পুলিশ।
চাঁদা দাবি করে ২০১১ সালের ১১ আগস্ট নগরের অক্সিজেন পাঠানপাড়ার ফটিকছড়ি উপজেলার তৎকালীন এক ইউপি চেয়ারম্যানের বাসায় ঢুকে গুলি করে সাজ্জাদের ক্যাডাররা। একই দিন একটি আবাসন প্রতিষ্ঠানের মালিকের গাড়ি পেট্রোল বোমা ছুড়ে পুড়িয়ে দেওয়া হয়। পরে ওই চেয়ারম্যান দুবাই গিয়ে সাজ্জাদের হাতে ৩০ লাখ টাকা তুলে দিয়ে রেহায় পান।

বায়েজিদ বোস্তামী থানার চালিতাতলী আব্দুস সাত্তার কন্ট্রাক্টর বাড়ির আবদুস সাত্তারের ছেলে বেলাল উদ্দিন মুন্না। সাজ্জাদের দীর্ঘদিনের বিশ্বস্ত সহচর। তার বিরুদ্ধে হত্যা, চাঁদাবাজিসহ অর্ধডজন মামলা রয়েছে। গত ২২ মার্চ অক্সিজেন নয়াহাট এলাকায় চাঁদা চেয়ে না পেয়ে সাইফুল ইসলাম মামুন নামের এক ব্যবসায়ীর মামুন এন্টারপ্রাইজ নামে একটি প্রতিষ্ঠানে ভাঙচুর চালায় মুন্না ও তার সহযোগীরা। নগরের বিবিরহাট, চালিতাতলী, হাজীরপুল, ওয়াজেদিয়া, নাজিরপাড়া, অক্সিজেন, কুয়াইশ, নয়ারহাট ও শমসেরপাড়া এলাকার ব্যবসায়ী, প্রবাসী ও ভবন মালিকদের ফোন নম্বর সংগ্রহ করে সাজ্জাদের কাছে পাঠায় মুন্না ও তার সহযোগীরা। এরপর সাজ্জাদ ফোনে চাঁদা দাবি করে। চাঁদার একটি অংশ বিদেশে সাজ্জাদের কাছে পৌঁছে যায়। টাকা না দিলে গুলি ও পেট্রোল বোমা ছোড়ে চালিতাতলী পূর্ব মসজিদ জব্বার সওদাগর বাড়ির মোহাম্মদ মঞ্জুরের ছেলে মো. আলী আকবর ওরফে ঢাকাইয়া আকবর, তার ছোট ভাই জালাল, মোবারক হোসেন, মো. জিসান, আরেফিন, দেলোয়ার হোসেন, হারুন উর রশিদ, উসমান, আবদুল জাব্বার, কফিল, বাদশা ও সোহেল। এদের মধ্যে ঢাকাইয়া আকবর গ্রেপ্তার হয়ে জেলে আছে। তার হয়ে তার ছোট ভাই জালাল এখন দাপিয়ে বেড়াচ্ছে।

যেভাবে দুর্ধর্ষ হয়ে ওঠে সাজ্জাদ : নগরের বায়েজিদ বোস্তামী থানার জান আলী নগর চালিতাতলী এলাকার আব্দুল গনি কন্ট্রাক্টরের ছেলে সাজ্জাদ হোসেন খান। নব্বইয়ের দশকে আরেক কুখ্যাত শিবির ক্যাডার নাছিরের সংস্পর্শে আসে। ১৯৯৭ সালে নাছির গ্রেপ্তার হলে বাহিনীর নিয়ন্ত্রণ নেয় আরেক শিবির ক্যাডার গিট্টু নাছির। তার নির্দেশে ১৯৯৯ সালের ২ জুন পাঁচলাইশ ওয়ার্ড কাউন্সিলর লিয়াকত আলী খানকে বাড়ির সামনে খুন করে ত্রাস হিসেবে আবির্ভূত হয় সাজ্জাদ। ২০০০ সালের ১২ জুলাই নগরের বহদ্দারহাটে দিনদুপুরে মাইক্রোবাস থামিয়ে ছাত্রলীগের ছয় নেতাকর্মীসহ আটজনকে ব্রাশফায়ার করে খুন করা হয়। সেখানেও নেতৃত্ব দেয় সাজ্জাদ। এ সময় চট্টগ্রামের আন্ডারওয়ার্ল্ডের নিয়ন্ত্রণ ছিল শিবির ক্যাডার গিট্টু নাছির, হাবিব খান, সাজ্জাদ হোসেন খান, ফয়েজ মুন্না, ফাইভ স্টার জসিম, গিয়াস হাজারিকা ও বিডিআর সেলিমদের হাতে। ২০০৫ সালে র‌্যাবের অভিযানে হাবিব খান, সাজ্জাদ হোসেন খান ও বিডিআর সেলিম ছাড়া সবাই বন্দুকযুদ্ধে নিহত হয়। বেঁচে গিয়ে আরও দুর্ধর্ষ হয়ে ওঠে সাজ্জাদ। সর্বশেষ ২০০০ সালের ১ অক্টোবর একে-৪৭ রাইফেলসহ গ্রেপ্তার হয়েছিল। ২০০৪ সালে জামিনে বেরিয়ে বিদেশে পালিয়ে যায়। ২০০৮ সালের ২৭ মার্চ আট খুনের মামলায় মৃত্যুদণ্ড দেন চট্টগ্রামের আদালত। ২০১৪ সালের ১৭ এপ্রিলে সাক্ষীর অভাবে হাইকোর্টে খালাস পায় সে।

ধরা পড়ে সহযোগীরা, বহালতবিয়তে সাজ্জাদ : দুর্ধর্ষ সন্ত্রাসী সাজ্জাদের বিরুদ্ধে হত্যা, অস্ত্র, চাঁদাবাজিসহ একডজন মামলায় গ্রেপ্তারি পরোয়ানা রয়েছে। সর্বশেষ ২০১২ সালে ৭ নভেম্বর ভারতের পাঞ্জাবের অমৃতসর থেকে তাকে গ্রেপ্তার করে ইন্টারপোল। ইন্টারপোলের রেড নোটিশধারী সন্ত্রাসী সাজ্জাদ। ওই বছরের ১৪ এপ্রিল তাকে গ্রেপ্তারের জন্য ইন্টারপোলের কাছে বার্তা পাঠায় বাংলাদেশ পুলিশ। পরে তাকে ফিরিয়ে আনতে দফায় দফায় চেষ্টা করে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। এর মধ্যে দিল্লির তিহার জেল থেকে জামিনে বেরিয়ে এখন ভারতেই অবস্থান করছে বলে জানিয়েছে একাধিক সূত্র। ভারতে গ্রেপ্তার হওয়ার আগে আবদুল্লাহ পরিচয়ে পাঞ্জাবের এক নারীকে বিয়েও করে সে। এই পরিচয়ে তার পাসপোর্টও রয়েছে। দুর্ধর্ষ এই সন্ত্রাসীকে দেশে ফিরিয়ে আনতে এক দশক ধরে চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়েছে সরকার। সর্বশেষ গত ২২ ফেব্রুয়ারি তাকে ফিরিয়ে আনতে ইন্টারপোলকে চিঠি দিয়েছে চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশ (সিএমপি)।

পুলিশের গোয়েন্দা সূত্রের দাবি, বাংলাদেশ থেকে পালিয়ে এক দশক দুবাই ছিল সাজ্জাদ। পরে ভারতীয় এক তরুণীকে বিয়ের পর সেখানে যায়। ভারতে গ্রেপ্তারের পর জামিনে বেরিয়ে সেখানে বসেই চট্টগ্রামে চাঁদাবাজি করছে।
নগর পুলিশের উপকমিশনার মোখলেছুর রহমান সমকালকে বলেন, দুর্ধর্ষ সন্ত্রাসী সাজ্জাদ কখনও দুবাই কখনও ভারতে অবস্থান করে বলে আমাদের কাছে তথ্য আছে। কিন্তু তার অবস্থান সংক্রান্ত কোনো সুনির্দিষ্ট তথ্য নেই। বিদেশে বসে বাংলাদেশে তার সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের বিষয়টি ইন্টারপোলকে অবহিত করেছি। আশা করছি তাকে তারা গ্রেপ্তার ও বাংলাদেশে ফিরিয়ে দেওয়ার ব্যাপারে উদ্যোগ নেবে।

বায়েজিদ বোস্তামী থানার ওসি মো. কামরুজ্জামান সমকালকে বলেন, সাজ্জাদের নির্দেশে বিভিন্ন স্থানে চাঁদাবাজি করার প্রমাণ পেয়েছি। দেশে যারা তার হয়ে কাজ করে, তাদের ধরতে পারলেও সাজ্জাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া যাচ্ছে না। এ ছাড়া সাজ্জাদের চাঁদা দাবির ফোন পেলেও কেউ অভিযোগ করতে আসে না পুলিশের কাছে। সমঝোতা করে টাকা পরিশোধ করে দেন। চাঁদা না দিলে যখন হামলার ঘটনা ঘটে, তখন তারা আমাদের কাছে অভিযোগ নিয়ে আসেন।