[ অনলাইন ] 17/04/2024
 
দুর্নীতির কারিগরে ভরা কারিগরি শিক্ষা বোর্ড
কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের রন্ধ্রে রন্ধ্রে অনিয়ম-দুর্নীতি। শীর্ষপদ থেকে শুরু করে বিভিন্ন কর্মকর্তা, এমনকি নিম্নপদের অনেক কর্মচারীর বিরুদ্ধেও রয়েছে নানাবিধ অপকর্মের অসংখ্য অভিযোগ। এক দশকের বেশি সময় ধরে ঘটছে এসব কা-; হচ্ছে সংবাদ, চলছে আলোচনা-সমালোচনা। কিন্তু থেমে নেই এহেন কর্মকা-। সম্প্রতি প্রতিষ্ঠানটির সিস্টেম অ্যানালিস্ট একেএম শামসুজ্জামানকে সার্টিফিকেট বাণিজ্যের অভিযোগে গ্রেপ্তার করে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ। তাকে ৬ দিনের রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করার পর বেরিয়ে আসে কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের থলের বিড়াল; প্রকাশ পায় শীর্ষপদে আসীনসহ অনেক কর্মকর্তা-কর্মচারীর একের পর এক ন্যক্কারজনক কা-কীর্তি।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এ বোর্ডে দুর্নীতির অনেক পথ রয়েছে। এসব পথ বন্ধ করা না হলে দুর্নীতি রোধ করা সম্ভব নয়। এক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের বিশেষ দৃষ্টি রাখতে হবে। দায়িত্বশীলদের পদায়নের ক্ষেত্রে ফিটলিস্ট তৈরি করা যেতে পারে। এছাড়া বিচারহীনতা আর বিচার প্রক্রিয়ায় দীর্ঘসূত্রতাও দুর্নীতি রোধের পথে অন্তরায় হয়ে দাঁড়িয়েছে।

জানা গেছে, ২০১৭ সালেও মার্কশিট সার্টিফিকেট বিক্রির অভিযোগে এ কে এম শামসুজ্জামানকে সাময়িকভাবে চাকরিচ্যুত করা হয়। কিন্তু উচ্চ আদালতের মাধ্যমে তিনি পুনর্বহাল হন। তাকে স্পর্শকাতর শাখা হিসেবে খ্যাত সার্ভারের সেই পুরনো দায়িত্বই দেয় কর্তৃপক্ষ। ফলে ফের সার্টিফিকেট বাণিজ্য শুরু করেন তিনি। এ পর্যন্ত তিনি পাঁচ হাজারেরও বেশি সার্টিফিকেট-মার্কশিট বানিয়ে বিক্রি করেছেন বলে গোয়েন্দাদের কাছে স্বীকার করেছেন। এক্ষেত্রে প্রতিটি সার্টিফিকেটের বিপরীতে তিনি নিয়েছেন ন্যূনতম ত্রিশ হাজার টাকা।

এর আগে, ২০২০ সালে এই বোর্ডের সাবেক চেয়ারম্যান ড. মোরাদ হোসেন মোল্লার সময়ে পরীক্ষা না দিয়ে পাস করার মতো কেলেঙ্কারিও ঘটে। এরও আগে,

২০১৮ সালে অনিয়ম দুর্নীতির মাধ্যমে অবৈধ সম্পদ অর্জনের দায়ে দুদকের মামলায় নাম ওঠে তৎকালীন চেয়ারম্যান ড. মো. মোস্তাফিজুর রহমানের। ২০১৪ সালেও তৎকালীন ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান ড. মো. আবদুল হক তালুকদারের বিরুদ্ধে ছিল অনিয়ম-দুর্নীতির বিস্তর অভিযোগ।

দেশে কারিগরি শিক্ষার অভিভাবক হিসেবে দায়িত্ব পালনকারী প্রতিষ্ঠানে বছরের পর বছর ধরে চলে আসা অনিয়ম-দুর্নীতির কারণ সম্পর্কে জানতে চাইলে বাংলাদেশ টেক্সটাইল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুটেক্স) সাবেক উপাচার্য এম এ কাশেম আমাদের সময়কে বলেন, ‘প্রতিষ্ঠানটিতে দুর্নীতির অসংখ্য সুযোগ আছে বিধায় অনেকে এতে জড়িয়ে যান। নৈতিকতাবোধ বিসর্জন দিয়ে এসবের মধ্যে জড়িয়ে যাওয়া রোধে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের বিশেষ নজর দিতে হবে। নৈতিকতাবোধহীনদের পদায়নের কারণেই এত দিনেও কলঙ্কমোচন হয়নি।’

কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের সাবেক এই চেয়ারম্যান আরও বলেন, বোর্ডে দায়িত্বশীলদের পদায়নের আগে বিশেষ যোগ্যতাসম্পন্ন ব্যক্তিদের ফিটলিস্ট করা যেতে পারে। যেমন- অনেক উপসচিব থাকেন সরকারের প্রশাসনে। কিন্তু সবাই কি জেলা প্রশাসক হতে পারেন? নিশ্চয় না; সবাই দক্ষ প্রশাসক হতে পারেন না। এ জন্য সরকার একটা যোগ্যতার সূচক রাখে। ওই সূচকের মধ্য দিয়ে পাস করে জেলা প্রশাসক হতে হয়। এখানেও আমি মনে করি, যোগ্যতার সূচকে পাস করলে ‘বোর্ড চেয়ারম্যান’ পদে পদায়ন করা উচিত।

তবে এই ধারাবাহিক দুর্নীতির পেছনে প্রতিষ্ঠানে বিচারহীনতা আর বিচার প্রক্রিয়ায় দীর্ঘসূত্রতার কারণ উল্লেখ করে টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান আমাদের সময়কে বলেন, ‘অতীতের ঘটনাগুলো অভিজ্ঞতা থেকে বোঝা যায় বিচারহীনতা আর বিচার প্রক্রিয়া দীর্ঘসূত্রতা রয়েছে।’ তিনি বলেন, ‘দুর্নীতি বন্ধ করতে হলে অভিযোগ আমলে নিয়ে দ্রুত তদন্ত শেষ করে বিভাগীয় ব্যবস্থা নেওয়ার পাশাপাশি দোষীদের আইনে সোপর্দ করা উচিত।’

গ্রেপ্তার শামসুজ্জামান প্রসঙ্গে গত ৪ এপ্রিল ডিবির অতিরিক্ত কমিশনার মোহাম্মদ হারুন অর রশীদ সাংবাদিকদের জানান, বোর্ডে সার্টিফিকেট বাণিজ্যে রাঘব-বোয়ালদের নামও আসছে। তিনি জানান, রিমান্ড চলাকালে জিজ্ঞাসাবাদে শামসুজ্জামান অনেক বিস্ময়কর তথ্য দিয়েছেন। শামসুজ্জামানের বরাত দিয়ে তিনি আরও জানান, বোর্ডের সবাইকে ‘ম্যানেজ’ করেই খোদ বোর্ড থেকে তিনি সনদ তৈরির কাগজ বের করতেন।

হারুন অর রশীদ আরও বলেন, শামসুজ্জামানের অবৈধ সার্টিফিকেট বাণিজ্যের বিষয়ে একাধিকবার তদন্ত কমিটি গঠন হয়েছিল। বোর্ডের কর্মকর্তারা তদন্ত করতে গিয়ে দেখেন, কেঁচো খুঁড়তে গিয়ে সাপ বেরিয়ে আসছে। ফলে একপর্যায়ে সেটা ধামাচাপা পড়ে যায়। একবার এ সংক্রান্ত একটি দুর্নীতি তদন্তের জন্য পাঠানো হয় কম্পিউটার কাউন্সিলে। সেই কাউন্সিলও মুখে কুলুপ এঁটে ফেলে। আমরা (ডিবি) সব কিছুই তদন্ত করছি। শামসুজ্জামানের কাছ থেকে বানানো সার্টিফিকেটও উদ্ধার করা হয়েছে। আমাদের কাছে তিনি জানিয়েছেন, তদন্ত করতে গিয়ে অতীতে কারা কারা চুপ হয়ে গিয়েছিলেন। রিমান্ডে পাওয়া তথ্য যাচাই করে কোনো রাঘব-বোয়াল জড়িত থাকলে সবার নাম প্রকাশ করা হবে।

গত ১ এপ্রিল শামসুজ্জামানের গ্রেপ্তারের পর কারিগরি শিক্ষা বোর্ডে অনিয়ম-দুর্নীতি বন্ধ করতে শুদ্ধি অভিযান পরিচালনার ঘোষণা দেন শিক্ষামন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেল। মন্ত্রী আরও বলেন, এ কা-ে আরও অনেকে জড়িত আছে বলে আমাদের ধারণা। সব তদন্ত করে দেখা হচ্ছে। জড়িতদের শাস্তি নিশ্চিত করা হবে।

কেঁচো খুঁড়তে কেউটে সাপ

শামসুজ্জামানকে গ্রেপ্তারের কা-ের মধ্যেই বোর্ডের বর্তমান চেয়ারম্যানের বিরুদ্ধেও অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগ এসেছে। স্বয়ং বোর্ড পরিষদেরই এক সদস্য চেয়ারম্যানের বিরুদ্ধে অভিযোগ করেছেন শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কারিগরি ও মাদ্রাসা শিক্ষা বিভাগে। চেয়ারম্যানের বিরুদ্ধে আরেকটি অনিয়মের অভিযোগ জমা পড়েছে মন্ত্রণালয়েও।

বোর্ডের অনিয়ম দুর্নীতির প্রসঙ্গে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কারিগরি ও মাদ্রাসা শিক্ষা বিভাগের সচিব ড. ফরিদ উদ্দিন আহমদ আমাদের সময়কে বলেন, কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের দুইটি বিষয়ে তদন্ত হচ্ছে। একটি হচ্ছে চেয়ারম্যানের নামে যে অভিযোগ পেয়েছি- সেটির জন্য। আরেকটি তদন্ত হচ্ছে-বোর্ডের সিস্টেম অ্যানালিস্ট শামসুজ্জামানের বিষয়ে। দুটি কমিটিকে দ্রুততার সঙ্গে রিপোর্ট দিতে বলা হয়েছে। রিপোর্ট পেয়ে আমরা ব্যবস্থা নেব।

অভিযোগ প্রসঙ্গে কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান মো. আলী আকবর খান গতকাল মঙ্গলবার আমাদের সময়কে জানান, আমার বিরুদ্ধে উত্থাপিত অভিযোগের বিষয়ে মন্ত্রণালয় জানতে চেয়েছিল, আমি সেখানে ব্যাখ্যা দিয়েছি। আসলে ওই প্রতিষ্ঠানের পছন্দমতো পরীক্ষা কেন্দ্র না দেওয়ায় এ ধরনের অভিযোগ তুলছে।

কিন্তু সূত্র প্রাপ্ত তথ্য বলছে ভিন্ন কথা। জানা গেছে, বেসরকারি কারিগরি প্রতিষ্ঠান ন্যাশনাল প্রফেশনাল ইনস্টিটিটের (এনপিআই) অভিযোগ হচ্ছে- তাদের প্রতিষ্ঠানের ঠিকানা পরিবর্তনের জন্য কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যানকে দুই দফায় ২০ লাখ টাকা ঘুষ দিতে হয়েছে। এনপিআইয়ের রেজিস্ট্রার মো. সাইদুর রহমান স্বাক্ষরিত অভিযোগপত্রেও এ তথ্য উল্লেখ করা হয়েছে।

অপর দিকে, কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের পরিচালনা পর্ষদ সদস্য সুফি ফারুক ইবনে আবুবকর বোর্ড চেয়ারম্যানের প্রতি অনাস্থা জানিয়ে সচিবের কাছে চিঠিতে বলেছেন- ‘চেয়ারম্যান দায়িত্বপ্রাপ্ত হওয়ার পর কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের পরিচালনা বিষয়ক আইন, নীতিমালা ও গেজেট অমান্য করে নিজের খুশিমতো চালাচ্ছেন। পরিচালনা পর্ষদ আইন অনুযায়ী প্রতি তিন মাসে একবার বোর্ড সভা হওয়ার কথা। কিন্তু গত আট (ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত) মাসে কোনো সভা ডাকা হয়নি। মনে করিয়ে দেওয়ার পরও চেয়ারম্যান এ ব্যাপারে কান দেননি। পরিচালনা পর্ষদের সুপারিশে চিহ্নিত দুর্নীতিবাজ ও দায়িত্ব পালনে অনিচ্ছুক কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বিরুদ্ধে তিনি কোনো ব্যবস্থা না নিয়ে কৌশলে কালক্ষেপণ করেন। ওই কর্মকর্তাদের সঙ্গে তার পরিবারের লোকজনের বিশেষ সম্পর্ক বিষয়ে জনশ্রুতি অত্যন্ত অস্বস্তিকর। সভায় আলোচনা যাই হোক, নিজের ইচ্ছেমতো রেজুল্যুশন তৈরি করেন চেয়ারম্যান এবং তা অনুমোদনের জন্য চাপ দেন। বোর্ড ও অর্থ কমিটির সভার বিবরণীতে তিনি এ কাজ অনেকবার করেছেন।’