[ অনলাইন ] 18/04/2024
 
দুর্গম পাহাড়ে আত্মগোপনে কেএনএফ সদস্যরা
পাহাড়ের আলোচিত বিচ্ছিন্নতাবাদী সশস্ত্র সংগঠন কুকি-চিন ন্যাশনাল ফ্রন্টের (কেএনএফ) বিরুদ্ধে একের পর এক অভিযান চালানো হচ্ছে। কিন্তু অভিযানে সংগঠনটির প্রধানসহ বড় নেতারা ধরা পড়ছে না। দুর্গম পাহাড়ি অঞ্চল হওয়ায় অভিযান যেমন বাধাগ্রস্ত হচ্ছে, তেমনি যথাযথভাবে চালানোও যাচ্ছে না। এই সুযোগে কেএনএফের সক্রিয় সদস্যরা আত্মগোপনে চলে গেছেন।

পুলিশ কর্মকর্তারা বলেছেন, গত মঙ্গলবার রাত পর্যন্ত অভিযানে কেএনএফের ৭৩ সদস্যকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। অন্যদের চিহ্নিত করার পর আটক করতে ড্রোন ব্যবহার করা হচ্ছে। হঠাৎ করে কেএনএফের সন্ত্রাসী তৎপরতা নিয়ে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী বিচার-বিশ্লেষণ অব্যাহত রেখেছে।

আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী বলছে, ইতিমধ্যে যাদের আটক করা হয়েছে, তাদের কাছ থেকে নানা তথ্য পাওয়া যাচ্ছে। তবে কেএনএফের শীর্ষ নেতারা এখনো আটক না হওয়ায় পাহাড়ি জনপদে এখনো উদ্বেগ আছে।

জানতে চাইলে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘কেএনএফকে নির্র্মূল না করা পর্যন্ত বিশেষ অভিযান চলবে। ইতিমধ্যে কয়েকজন নেতাসহ একাধিক সদস্যকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। সংগঠনটির অন্য নেতাদেরও ধরা হবে। তাদের যারা আশ্রয়-প্রশ্রয় দিচ্ছে, তাদের বিষয়েও খোঁজ নেওয়া হচ্ছে। কাউকে আমরা ছাড় দেব না।’

পুলিশ সূত্র জানায়, ঈদের ছুটির কারণে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অভিযানের মাত্রা কিছুটা কমেছে। সোমবার থেকে অফিস-আদালতের কার্যক্রম শুরু হলে শীর্ষ কর্তারা সর্বশেষ পরিস্থিতি নিয়ে বৈঠক করেছেন। এর আগে ব্যাংকে হামলার পর স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, আইজিপি, বিজিবির এবং র‌্যাব মহাপরিচালকসহ গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর শীর্ষ কর্তারা দফায় দফায় বৈঠক করেছেন। সরকারের হাইকমান্ড থেকে কড়া হুঁশিয়ারি দেওয়া হয়েছে কেএনএফের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে। কেএনএফের সন্ত্রাসী কর্মকা- কঠোরভাবে নির্মূল করার নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।

নাম প্রকাশ না করে পুলিশ সদর দপ্তরের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা গত মঙ্গলবার দেশ  রূপান্তরকে বলেন, শান্তিচুক্তি বানচাল করতে তৃতীয় পক্ষ কেএনএফকে ইন্ধন দিচ্ছে। ব্যাংক, বাজার, মসজিদ ও থানায় হামলা চালানোর আগে সংগঠনটির সদস্যরা কিছুটা শান্ত ছিল। কোনো একটি পক্ষের আশকারা পেয়ে বেপরোয়া হয়ে উঠছে তারা; বিশেষ করে মিয়ানমারের আরাকান আর্মি ও আসামের একটি সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর সঙ্গে কেএনএফের সম্পর্ক থাকার বিষয়টি নিশ্চিত হয়েছে তদন্তকারী সংস্থাগুলো। গত বছর জঙ্গিদের সঙ্গে সম্পর্কের বিষয়টি নিশ্চিত হওয়ার পর আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী অভিযান চালায় পাহাড়ে। ধরা পড়ার ভয়ে বমদের কেউ কেউ সীমান্ত পাড়ি দিয়ে ভারতের মিজোরামে চলে গেছে বলে তথ্য রয়েছে।

পুলিশ নিশ্চিত হয়েছে, কেএনএফপ্রধান নাথান বম রাজধানীর বাসাবো এলাকার একটি বাসায় দীর্ঘদিন অবস্থান করেছেন। ওই বাসাটি ঠিক করে দিয়েছেন নতুন জঙ্গি সংগঠন জামাতুল আনসার আল ফিল হিন্দাল শারক্বীয়ার আমির আনিসুর রহমান মাহমুদ। এমনকি নাথান বমের মাধ্যমে কেএনএফ থেকে ১৭ লাখ টাকায় বিভিন্ন ধরনের অস্ত্র কেনেন আনিসুর রহমান। এই জঙ্গি নেতা ২০১৬ সালের বিভিন্ন সময় বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ির বিভিন্ন মসজিদে গিয়ে সংগঠনের পক্ষে দাওয়াতি কার্যক্রম পরিচালনা করতেন। ২০২০ সালে প্রশিক্ষণের উদ্দেশ্যে বান্দরবানের গহিন এলাকায় যান। সেখানে আসলাম নামে এক ব্যক্তির কাছে প্রায় এক মাস সামরিক বিভিন্ন কৌশল, অস্ত্র চালনা ও প্রতিকূল পরিবেশে টিকে থাকাসহ বিভিন্ন ধরনের প্রশিক্ষণ নেন। ওই সময় কেএনএফ সদস্যরা তাদের সহায়তা করে। পার্বত্য অঞ্চলে অবস্থানের সময় তার সঙ্গে কেএনএফ সদস্যদের পরিচয় হয় এবং সংগঠনটির প্রধান নাথান বম ও সেকেন্ড ইন কমান্ড বাংচুংয়ের সঙ্গে সম্পর্ক হয় তার। ২০২১ সালে কেএনএফের ছত্রচ্ছায়ায় বান্দরবানের গহিন পাহাড়ে জামাতুল আনসারের সদস্যদের সশস্ত্র প্রশিক্ষণের বিষয়ে চুক্তি হয় তাদের মধ্যে। চুক্তি অনুযায়ী ২০২৩ সাল পর্যন্ত শারক্বীয়ার সদস্যদের সশস্ত্র প্রশিক্ষণ দেয় কেএনএফ। এ জন্য প্রতি মাসে কেএনএফকে প্রশিক্ষণ ও খাবার খরচ বাবদ ৪ লাখ টাকা দিতেন শারক্বীয়ার আমির মাহমুদ। এই অর্থ দেশে এবং দেশের বাইরে থেকে সংগ্রহ করা হতো।

পুলিশের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা দেশ রূপান্তরকে বলেন, পাহাড়ের গহিনে কেএনএফের সদস্যরা আত্মগোপন করে আছে। তা ছাড়া পাহাড়ে অভিযান চালানো খুবই কষ্টকর হয়ে পড়েছে। সন্ত্রাসীরা ঘাপটি মেরে থাকে ওই সব স্থানে। লামা, রুমা, আলীকদম, থানচি, রোয়াংছড়ি, বিলাইছড়ি, জুরাইছড়ি, বরকলসহ আশপাশের এলাকায় কেএনএফের সদস্যরা পাহাড়ের আনাচকানাচে অবস্থান করছে বলে তারা নিশ্চিত হয়েছেন। ড্রোন ব্যবহার করে তাদের অবস্থান চিহ্নিত করার পর গ্রেপ্তারের চেষ্টা চলছে।

ওই কর্মকর্তা বলেন, কেএনএফের কোনো সদস্য যদি আত্মসমর্পণ করতে চায় তাদের স্বাগত জানানো হবে। এমনকি তাদের আইনি সহায়তা দেওয়া হবে।

৩ এপ্রিল বান্দরবানের রুমা ও থানচি উপজেলায় কয়েক ঘণ্টার ব্যবধানে সোনালী ও কৃষি ব্যাংকের তিনটি শাখায় হামলা চালায় সশস্ত্র সন্ত্রাসীরা।

গোয়েন্দা সূত্র জানায়, কেএনএফ মূলত পার্বত্য চট্টগ্রামের বান্দরবানকেন্দ্রিক আঞ্চলিক সশস্ত্র সংগঠন। পার্বত্য তিন জেলা বান্দরবান, রাঙ্গামাটি ও খাগড়াছড়ির প্রায় অর্ধেক আয়তনের লামা, রুমা, আলীকদম, থানচি, রোয়াংছড়ি, বিলাইছড়ি, জুরাইছড়ি, বরকলসহ আশপাশের এলাকা নিয়ে একটি মনগড়া রাজ্যের মানচিত্র তৈরি করেছে ওরা। পাহাড়ের বম নৃ-গোষ্ঠী ছাড়াও পাঙ্খুয়া, খুমি, ম্রো এবং খিয়াং জাতি গোষ্ঠীর লোকজন নিয়ে কেএনএফ গঠন করা হয়েছে। কেএনএফের নেটওয়ার্ক পার্বত্য রাঙ্গামাটি, বান্দরবান ও মিয়ানমার সীমান্তজুড়ে। রুমা ও রোয়াংছড়ির শিল্পী পাহাড়, সাইজামপাড়া, রনিনপাড়া, কেওক্রাডংয়ের সীমান্তবর্তী পাদদেশ, রাইক্ষ্যং লেকসহ বিভিন্ন এলাকায় এই গোষ্ঠীর সাংগঠনিক বিস্তার।