[ অনলাইন ] 18/04/2024
 
অর্থনীতিতে বিদ্যুৎ-গ্যাসের অবদান কমছে
বিদ্যুতের আওতায় এসেছে দেশের প্রায় শতভাগ পরিবার। চাহিদা মেটাতে স্থানীয়ভাবে সক্ষমতা থাকলেও বিদ্যুৎ আমদানি হচ্ছে। শিল্প-কারখানায় গ্যাসের সরবরাহ অব্যাহত রাখতে কয়েক বিলিয়ন ডলার ব্যয়ে উচ্চমূল্যের এলএনজি আমদানি করছে সরকার। তবে ডলার সংকটে বিদ্যুতের কাঁচামাল গ্যাস আমদানি সীমিত হয়ে পড়েছে। তাই দেশের অর্থনীতিতে বিদ্যুৎ ও গ্যাস এখন বড় ধরনের শঙ্কার নাম হয়ে দাঁড়িয়েছে। প্রয়োজনীয় এ দুই পণ্যের সরবরাহ সংকটে দেশের উৎপাদন ব্যাপক হারে কমে যাচ্ছে। এতে করে মোট দেশজ উৎপাদনে (জিডিপি) গ্যাস-বিদ্যুতের অবদানও তলানিতে ঠেকেছে।

২০২৩-২৪ অর্থবছরের অক্টোবর-ডিসেম্বর প্রান্তিকে জিডিপিতে বিদ্যুৎ, গ্যাস ও পানি সরবরাহের প্রবৃদ্ধি কমে দাঁড়িয়েছে শূন্য দশমিক ৩১ শতাংশে। যেটি আগের বছরের একই সময়েও ছিল ২ দশমিক ৯৯ শতাংশ। সম্প্রতি বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) যে প্রান্তিক হিসাব দিয়েছে, তাতে এ চিত্র উঠে এসেছে।

দেশের অর্থনীতির সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ এ খাতের অবদান কমায় প্রভাব পড়েছে শিল্প ও উৎপাদন খাতের প্রবৃদ্ধিতেও। উৎপাদন থমকে গিয়েছে। শুধু থমকে যাওয়াই নয়, সেটি এখন ঋণাত্মক ধারায় ঠেকেছে। দ্বিতীয় প্রান্তিকে (অক্টোবর-ডিসেম্বর) এ খাতের প্রবৃদ্ধি ঋণাত্মক শূন্য দশমিক ৪৫ শতাংশ, যেটি আগের প্রান্তিকেও ছিল ১১ দশমিক ৬ শতাংশ। এটি ২০২২-২৩ অর্থবছরের দ্বিতীয় প্রান্তিকে ছিল ১০ দশমিক ৮৮ শতাংশ।

চলতি ২০২৩-২৪ অর্থবছরের দ্বিতীয় প্রান্তিকে শিল্পের প্রবৃদ্ধিই সবচেয়ে কম। অক্টোবর থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত সময়ে শিল্পের প্রবৃদ্ধি কমে ৩ দশমিক ২৪ শতাংশে নেমেছে, যা দুই বছর আগেও ছিল ১৪ শতাংশের বেশি। ২০২২-২৩ অর্থবছরের একই সময়েও এ খাতের প্রবৃদ্ধি ছিল ১০ শতাংশ। তবে প্রবৃদ্ধি কমলেও চলতি অর্থবছরের দ্বিতীয় প্রান্তিকে শিল্প খাতের মূল্য সংযোজন বেড়ে ৩ লাখ ১২ হাজার ১০৭ কোটি টাকায় দাঁড়িয়েছে। আগের প্রান্তিকে তা ছিল ২ লাখ ৮৭ হাজার ৬৯৪ কোটি টাকা। অর্থাৎ তিন মাসের ব্যবধানে এ খাতের মূল্য সংযোজন বেড়েছে ২৪ হাজার ৪১৩ কোটি টাকা।

শিল্প খাতের উপখাত রয়েছে চারটি। এর মধ্যে বিদ্যুৎ, গ্যাস ও পানি সরবরাহ একটি। সর্বশেষ অক্টোবর-ডিসেম্বর প্রান্তিকে এ খাতের মূল্য সংযোজন ৯ হাজার ১৫৯ কোটি টাকা। অথচ তিন মাস আগেও এ খাতের মূল্য সংযোজন ছিল ১১ হাজার ২৯৭ কোটি টাকা। অর্থাৎ তিন মাসের ব্যবধানে এ খাতের মূল্য সংযোজন কমেছে ২ হাজার ১৩৮ কোটি টাকা।

কৃষি, শিল্প ও সেবা খাতের ১১টি উপখাত দিয়ে মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) হিসাব গণনা করা হয়। বিবিএস বলছে, চলতি অর্থবছরের দ্বিতীয় প্রান্তিক অক্টোবর-ডিসেম্বরে সব মিলিয়ে কলকারখানা উৎপাদন থেকে ১ লাখ ৯৯ হাজার ৮৭৫ কোটি টাকা অর্থনীতিতে যুক্ত হয়েছে, যা আগের অর্থবছরের একই প্রান্তিকে ছিল ২ লাখ ৭৭৫ কোটি টাকা। এক বছরের ব্যবধানে কলকারখানা উপখাত থেকে অর্থনীতিতে মূল্য সংযোজন কমেছে ৯০০ কোটি টাকা।

আন্তর্জাতিক বাজারে শিল্পের কাঁচামালের দাম অনেক কমে এলেও এর সুবিধা নিতে পারেনি দেশের শিল্প-কারখানাগুলো। জ¦ালানি সংকট ও আমদানি সীমাবদ্ধতার কারণে শিল্প তার সক্ষমতা অনুযায়ী উৎপাদন করতে পারছে না। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে ডলারের উচ্চমূল্য। এমন নানা সংকটের মুখে শিল্পের প্রবৃদ্ধি তলানিতে নেমে এসেছে। যে শিল্পের ওপর ভর করে দেশের জিডিপি এগিয়ে যাচ্ছিল তা এখন নিম্নমুখী।

দেশের অর্থনীতিতে সবচেয়ে বেশি অবদান রাখে সেবা খাতে। এরপরই শিল্প খাতের অবস্থান। গত কয়েকটি অর্থবছরে অর্থনীতিতে শিল্পের অবদান ধারাবাহিকভাবে বাড়ছিল। সর্বশেষ ২০২২-২৩ অর্থবছরে জিডিপিতে শিল্পের অবদান ছিল ৩৭ দশমিক ৬৫ শতাংশ। জিডিপিতে এক-তৃতীয়াংশের বেশি অবদান রাখা এ খাতের প্রবৃদ্ধি মারাত্মক হারে হ্রাস পাওয়ায় কর্মসংস্থানে নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে।

শিল্প খাতের মধ্যে উৎপাদন খাতের প্রাণ হলো দেশের ৪৬ হাজারের বেশি ছোট-বড় কলকারখানা। এসব কলকারখানার মূল জ¦ালানি হলো বিদ্যুৎ ও গ্যাস। চাহিদা অনুযায়ী বিদ্যুৎ ও গ্যাসের সরবরাহ না থাকায় উৎপাদন খাতে ইতিমধ্যেই নেতিবাচক অবস্থানে চলে গেছে। দ্বিতীয় প্রান্তিকে উৎপাদন খাতের প্রবৃদ্ধি ঋণাত্মক শূন্য দশমিক ৪৫ শতাংশ। বিভিন্ন সংকটের মধ্যেও এর আগে ২০২১-২২-এ ছিল ৩৬ দশমিক ৯২ শতাংশ, ২০২০-২১-এ ছিল ৩৬ দশমিক শূন্য এক শতাংশ।

ইতিমধ্যেই বাংলাদেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধি কমবে বলে পূর্বাভাস দিয়েছে বিশ^ব্যাংক ও এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক (এডিবি)।

চলতি অর্থবছরের দ্বিতীয় প্রান্তিকে (অক্টোবর-ডিসেম্বর) মোট দেশজ উৎপাদন প্রবৃদ্ধি (জিডিপি) আরও কমল। ডিসেম্বর শেষে দেশের জিডিপির প্রবৃদ্ধি কমে দাঁড়িয়েছে ৩ দশমিক ৭৮ শতাংশ। প্রথম প্রান্তিকে জিডিপির প্রবৃদ্ধি ছিল ৬ দশমিক শূন্য এক শতাংশ। দ্বিতীয় প্রান্তিকে শিল্প ও সেবা খাতের প্রবৃদ্ধি আশঙ্কাজনক হারে কমেছে। সম্প্রতি প্রান্তিক জিডিপির এ তথ্য প্রকাশ করেছে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস)।

বিবিএসের তথ্য বলছে, পয়েন্ট-টু-পয়েন্ট ভিত্তিতে স্থির মূল্যে ২০২৩-২৪ অর্থবছরের দ্বিতীয় কোয়ার্টারে প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৩ দশমিক ৭৮ শতাংশ। ২০২২-২৩ অর্থবছরের দ্বিতীয় প্রান্তিকে প্রবৃদ্ধি ছিল ৭ দশমিক শূন্য ৮ শতাংশ এবং ২০২১-২২ অর্থবছরের দ্বিতীয় কোয়ার্টারে প্রবৃদ্ধি ছিল ৯ দশমিক ৩০ শতাংশ।

অন্য বছরের সঙ্গে এবারের জিডিপির এত পার্থক্য থাকার ব্যাখ্যা দিয়েছে বিবিএস। সংস্থাটি বলছে, আইএমএফের কোয়ার্টারলি ন্যাশনাল অ্যাকাউন্টস ম্যানুয়াল অনুযায়ী, কোনো প্রান্তিকের জিডিপির প্রথম প্রাক্কলনের সময় হালনাগাদ সব তথ্য-উপাত্ত বিদ্যমান থাকে না বিধায় পরবর্তীকালে তা সংশোধনের প্রয়োজন হয়। ফলে পূর্ববর্তী প্রান্তিকের প্রবৃদ্ধিতে কিছুটা পার্থক্য পরিলক্ষিত হয়।