[ Online ] 19/04/2024
 
দুর্নীতির কাছে ‘জিম্মি’ ব্যবসায়ীরা
চট্টগ্রামের এক কারখানায় বেশ কয়েক বছর উচ্চ পদে কাজ করার পর ২০১৭ সালে চাকরি ছেড়ে নিজেই রপ্তানিমুখী জুতা তৈরির কারখানা গড়ে উদ্যোক্তা হওয়ার স্বপ্ন পূরণের সিদ্ধান্ত নেন এক তরুণ।

তার কিছু সঞ্চয় ছিল। ব্যবসা শুরু করতে ঋণের জন্য ব্যাংকে আবেদনও করেছিলেন। যখন তিনি ঢাকা ও চট্টগ্রামে জমি খুঁজতে শুরু করেন, তখন তাকে চড়া দাম ও জমির নকল মালিকদের মুখোমুখি হতে হয়।

সর্বশেষ খবর দ্য ডেইলি স্টার বাংলার গুগল নিউজ চ্যানেলে।
প্রায় ছয় মাস পর, তিনি তার কারখানার জন্য উপযুক্ত জমি খুঁজে পান।

এরপর আসে আসল বাধা।

সরকারি দপ্তর থেকে নিবন্ধন, সনদ ও অনুমতির জন্য আবেদন করতে গিয়ে নানান বাধার মুখে পড়তে হয় তাকে।

রপ্তানিমুখী কারখানা খুলতে কমপক্ষে ৩২টি সনদের প্রয়োজন। উদ্যোক্তা হতে ইচ্ছুক ব্যক্তিদের সনদ পেতে তদবির করতে বা ঘুষ দিতে হয়। ইউটিলিটি সংযোগ পেতে অপেক্ষা করতে হয় দীর্ঘ সময়।


উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, একজন আমদানিকারকের নিবন্ধন অনুমোদনের জন্য যেখানে ১০ থেকে ১৫ দিন সময় লাগার কথা সেখানে সেই সনদটি পেতে তার দেড় মাসের বেশি লেগে যায়।

সব কিছু শেষ করতে তার দুই বছরেরও বেশি সময় লেগে যায়। ২০২০ সালে কারখানা করে পরীক্ষামূলক উৎপাদন শুরু করেন তিনি।

ক্রেতা খুঁজে মূল ব্যবসা শুরু করার আগেই এই তরুণ উদ্যোক্তার ওপর এসে যায় ব্যাংক ঋণের কিস্তি পরিশোধের চাপ। কারণ, ইতোমধ্যে এক বছরের গ্রেস পিরিয়ড শেষ হয়ে গেছে।

প্রথম প্রজন্মের এই ব্যবসায়ীর মতো প্রতিষ্ঠিত অধিকাংশ ব্যবসায়ীও বাংলাদেশে ব্যবসা পরিচালনায় দুর্নীতিকেই সবচেয়ে বড় বাধা বলে মনে করেন।

তাদের মতে, দুর্নীতির কারণে ব্যবসার খরচ বাড়ছে। এটি সুষ্ঠু ব্যবসায়িক কার্যক্রমকে বাধাগ্রস্ত করছে। ব্যবসায়ীদের আস্থা কমিয়ে দিচ্ছে।

'পোশাক খাতে সময় খুবই গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হওয়ায় বেশিরভাগ কারখানা মালিক এ ধরনের দুর্নীতির প্রতিবাদ করেন না। সময়মতো কাঁচামাল খালাসের জন্য তারাও ঘুষ দিয়ে কাজটি করিয়ে নিতে চান।'

'দ্য স্টেট অব দ্য বিজনেস এনভায়রনমেন্ট ইন বাংলাদেশ' শীর্ষক জরিপে দেখা গেছে, ২০২৩ সালে ব্যবসার জন্য সবচেয়ে বড় বাধা ছিল দুর্নীতি। জরিপে ৬৭ দশমিক ছয় শতাংশ উত্তরদাতা চরম দুর্নীতির অভিযোগ করেছেন।

ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামের সহযোগিতায় সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি) এই জরিপ পরিচালনা করে।

গত বছর সিপিডি পরিচালিত একই ধরনের জরিপে ৬৪ দশমিক ছয় শতাংশ উত্তরদাতা বলেছিলেন, দেশে ব্যবসা করার ক্ষেত্রে দুর্নীতি সবচেয়ে বড় বাধা।

দেশ অনেক ক্ষেত্রে ডিজিটাল উদ্যোগ গ্রহণ করা হলেও এর গতি ধীর। এখানে ফাঁকফোকরও আছে।

যেমন, ব্যবসার মালিকদের এখন ডিজিটাল পদ্ধতিতে স্থানীয় কেনাকাটার জন্য ভ্যাট পরিশোধের অনুমতি দেওয়া হয়েছে। তাদের ভ্যাট অফিসে যাওয়ার প্রয়োজন নেই।

কিন্তু এরপরও কোনো কোনো কর্মকর্তা ব্যবসায়ীদের ভ্যাট পরিশোধের প্রিন্টেড কপি নিয়ে ভ্যাট অফিসে যেতে বলেন। শুধু ডকুমেন্ট প্রসেসের জন্য অতিরিক্ত টাকা দাবি করেন।

সরকারি দপ্তর থেকে অপারেটিং লাইসেন্স নিতেও ঘুষ দিতে হয়।

অনেক বেসরকারি ব্যাংকের বিরুদ্ধে আমানতকারীদের টাকা অযোগ্য ব্যক্তিদের ঋণ হিসেবে দেওয়ার অভিযোগ আছে। অন্যদিকে, ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প পরিচালনাকারী সৎ উদ্যোক্তারা নামমাত্র ঋণ পেতে হিমশিম খাচ্ছেন।

প্রিমিয়ার সিমেন্ট মিলস'র ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ আমীরুল হক দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'বাংলাদেশে দুর্নীতিমুক্ত কোনো সরকারি অফিস নেই।'

তার মতে, ট্রেড লাইসেন্স পাওয়া থেকে শুরু করে কর রিটার্ন দাখিল পর্যন্ত সবকিছুতেই দুর্নীতির মোকাবিলা করেন ব্যবসায়ীরা। প্রতিটি ক্ষেত্রেই সময়মতো ছাড়পত্র পেতে তাদের ঘুষ দিতে হয়।

তিনি আরও বলেন, 'নিয়ম অনুযায়ী বন্দর থেকে এক কনটেইনার কাঁচামাল খালাস করতে তিন দিন লাগে। যেহেতু খালাস পেতে অতিরিক্ত সময় লেগে গেলে ব্যবসায়ীদের প্রচুর আর্থিক ক্ষতির মুখে পড়তে হয় তাই তাদের কাছ থেকে আর্থিক সুবিধা পেতে কাস্টমস কর্মকর্তারা কনটেইনার খালাসে দেরি করেন।'

বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশে দুর্নীতি স্বাভাবিক বিষয় বলে মনে করলেও ধীরে ধীরে তা কমিয়ে আনার দাবি জানান তিনি।

ব্যবসায়ীরা নানা কারণে দুর্নীতিকে বড় চ্যালেঞ্জ মনে করেন। এটি অসম পরিস্থিতি তৈরি করে। আবার দুর্নীতিবাজ ব্যবসায়ীরা বাড়তি সুবিধা পেতে ঘুষ দিয়ে থাকেন।

সমস্যাটি স্থায়ী থেকে অনিবার্য হয়ে উঠেছে। বেশিরভাগ ব্যবসায়ীদের সময়মতো কিছু করার জন্য ঘুষ দেওয়া ছাড়া বিকল্প নেই।

এক পোশাক রপ্তানিকারক নাম প্রকাশ না করার অনুরোধ করে ডেইলি স্টারকে বলেছেন, 'পোশাক খাতে সময় খুবই গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হওয়ায় বেশিরভাগ কারখানা মালিক এ ধরনের দুর্নীতির প্রতিবাদ করেন না। সময়মতো কাঁচামাল খালাসের জন্য তারাও ঘুষ দিয়ে কাজটি করিয়ে নিতে চান।'

এভাবেই বেসরকারি খাতও দুর্নীতিগ্রস্ত হয়ে পড়ছে।

কোনো ব্যবসায়ী যদি সব কাগজপত্র সঠিকভাবে তৈরি করেন, কোনো অনিয়ম না করেন, তাহলে তিনি দুর্নীতিবাজ সরকারি কর্মকর্তাকে তার কাজের বিষয়ে চাপ দিতে পারেন। কিন্তু, অধিকাংশ ক্ষেত্রেই দুর্নীতির কাছে মাথা নত করাই সহজ উপায়।

দেশের বেসরকারি ব্যাংকিং খাতেও দুর্নীতি বাড়ছে।

অনেক বেসরকারি ব্যাংকের বিরুদ্ধে আমানতকারীদের টাকা অযোগ্য ব্যক্তিদের ঋণ হিসেবে দেওয়ার অভিযোগ আছে। অন্যদিকে, ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প পরিচালনাকারী সৎ উদ্যোক্তারা নামমাত্র ঋণ পেতে হিমশিম খাচ্ছেন।

বেসরকারি বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোতেও খেলাপি ঋণ বাড়ছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সর্বশেষ তথ্যে জানা গেছে, ২০২৩ অর্থবছরের জুলাই থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত বেসরকারি ব্যাংকগুলোয় খেলাপি ঋণ বেড়েছে সাত হাজার ৯০২ কোটি টাকা।

শীর্ষ ব্যবসায়ী নেতারা মনে করেন, দুর্নীতি প্রতিরোধে সরকারি-বেসরকারি খাতে সুশাসন নিশ্চিত করার বিকল্প নেই।

সুশাসন নিশ্চিত করতে সরকারের শীর্ষ পর্যায় থেকে রাজনৈতিক অঙ্গীকার অপরিহার্য বলেও তারা মনে করেন।