[ অনলাইন ] 25/04/2024
 
দুর্নীতির বিরুদ্ধে চাই সামাজিক আন্দোলন
চুরি, ছ্যাঁচড়ামি, হাইজ্যাকিং, প্রতারণা, জালিয়াতি, দুর্নীতি আমাদের সমাজের নিত্যদিনের ঘটনা। এসব নিয়ন্ত্রণে বিশেষ বাহিনী ও সংস্থারও অভাব নেই। কিন্তু কিছুতেই এসব অপরাধকে বাগে আনা যাচ্ছে না।

বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের অধীনে রয়েছে নিজস্ব পরিদর্শন ও নিরীক্ষা অধিদপ্তর। সেগুলোতে নিয়োজিত শত শত পরিদর্শক। সার্বিক দুর্নীতি দমনের জন্য তৈরি দুর্নীতি দমন কমিশন-দুদকের আগে তাদেরই নিজ নিজ বিভাগের অনিয়ম-দুর্নীতি খুঁজে বের করে উপযুক্ত প্রতিকারমূলক পদক্ষেপ সুপারিশ করার কথা। কিন্তু বাস্তবতা হলো, কোনো মন্ত্রণালয়েরই নিজস্ব নিরীক্ষা ও পরিদর্শন বিভাগ আজ পর্যন্ত বলার মতো কোনো তৎপরতা দেখাতে পারেনি।

যেমন– শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের রয়েছে স্কুল-কলেজ পরিদর্শন শাখা-উপশাখা। সহকারী শিক্ষা পরিদর্শকরা মাঠ পর্যায়ে শিক্ষা-সংক্রান্ত কর্মসূচি তদারক করে থাকেন। এ জন্য তাদের ট্যুর প্রোগাম নির্ধারণ করা হয়। সংবাদমাধ্যমে দেখা গেছে, এই ট্যুর প্রোগাম নাকি কেনা-বেচা হচ্ছে। এসব প্রোগাম বেশ লাভজনক বিধায় এই উদ্বেগজনক পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। অভিযোগ আছে, এখানে ‘না’কে হ্যাঁ বা ‘মন্দ’কে ভালো বলে রিপোর্ট দিলেই আর্থিকভাবে লাভবান হওয়া যায়। ফলে কর্মস্থলে অনুপস্থিত থেকেও চাকরি করা যায় অথবা নির্দিষ্ট পরিমাণ জমি, ভবন, খেলার মাঠ, ল্যাব সুবিধা না থাকলেও কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয় খোলার অনুমতি মেলে। এসব অনুমতির খেলায় অবৈধ অর্থের বিনিময়ে মূল ভূমিকা রাখে ধরাছোঁয়ার ঊর্ধ্বে থাকা দুর্নীতিবাজ দায়িত্বশীলরা।

দেশে ভাগবাটোয়ারার মাধ্যমে বহুলাংশে পরিচালিত হচ্ছে বড় বড় নির্মাণকাজ। অনেক ঠিকাদারের ঠিকাদারি লাইসেন্সই নেই। অনেকের তা থাকলেও হয় জাল অথবা ধার করা। এখানে কার্যাদেশপ্রাপ্তির আগেই সংশ্লিষ্ট মহলকে খুশি করতে হয়; তবেই কাজ বাগানো যায়। অভিজ্ঞ একজনের নাম ভাঙিয়ে অনভিজ্ঞ আরেকজন বা বহুজন সেসব কাজের অংশীদার সেজে কাজ করতে গিয়ে আর্থিক ক্ষতির পরিমাণ বাড়িয়ে তোলে এবং নির্দিষ্ট সময়ে কাজ সমাপ্ত করতে না পেরে সরকারি অর্থের অপচয় ঘটিয়ে বাজেট বাড়িয়ে দেওয়ার আন্দোলনের নামে কাজ বন্ধ করে রাখে। এটা আমাদের দেশের বিশেষত সরকারি নির্মাণকাজের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হয়ে উঠেছে। এ জন্য জাপান, মালয়েশিয়া তো বটেই, এমনকি প্রতিবেশী ভারতের চেয়েও আমাদের দেশে নির্মাণকাজে খরচ বেশি গুনতে হচ্ছে।

এখনও নতুন পাসপোর্টের জন্য পুলিশ ভেরিফিকেশনের নামে কালক্ষেপণ সমস্যা টাকা ছাড়া সমাধানের নজির নেই। সরকারি চাকরি পেতে পুলিশ ভেরিফিকেশনের নামে হেনস্তার ঘটনা আমাদের দেশে প্রায় স্থায়ী রূপ লাভ করেছে। এ জন্য একজন বিসিএস ক্যাডারকেও প্রমোশনের জন্য ভেরিফিকেশন রিপোর্ট পেতে অবৈধ অর্থ খরচ করার নজির রয়েছে।

পুলিশের সাবেক আইজি, ওয়াসার এমডি, কতিপয় প্রাক্তন ভিসি, মহাপরিচালক ইত্যাদির দুর্নীতি ও স্বজনপ্রীতির খবর বেশ চাউর হলেও সেগুলোর বিরুদ্ধে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণে খুবই ধীরগতি লক্ষণীয়।

দেশের সিংহভাগ আমলা ও রাজনীতিবিদ সন্তানদের বিদেশে পড়াশোনার জন্য পাঠান। স্কলারশিপ ছাড়া বিদেশে পড়ার এত টাকা একজন সরকারি চাকরিজীবী কীভাবে জোগাড় করেন?

এক সময় রেলে কালো বিড়াল ছিল বলে তৎকালীন মন্ত্রী সতর্ক করে দিয়েছিলেন। সেই কালো বিড়ালের অস্তিত্ব ডিজিটাল টিকিটসহ গোটা রেল পরিবহন ব্যবস্থাপনায় বিদ্যমান। এখন বলা হচ্ছে, ‘কালো বিড়াল বনের মধ্যে বসতি গেড়েছে।’

কিন্তু আমার তো মনে হয়, কালো বিড়াল দেশের সব জায়গায় ওত পেতে থেকে গোঁফে তা দিচ্ছে। তাদের গায়ে ঢিল ছোড়ার কেউ নেই। কারণ এই দেশে যে যত বড় অপরাধী, তার নেটওয়ার্ক তত বেশি শক্তিশালী। পদবিধারী ‘হোয়াইট কলার ক্রিমিনালরা’ চটকদার কথা বলে। নানা কায়দায় জাল বিস্তার করে ভয়ভীতি দেখিয়ে অসহায় মানুষের সম্পদ কুক্ষিগত করে নিজেদের ভোগবিলাসের পথ প্রশস্ত করছে। বিপদ আঁচ করলে এসব মাফিয়া আত্মপক্ষ সমর্থনের জন্য আরও বেশি প্রচারে অর্থ খরচ করে মেগা দুর্নীতির পথ খুলে রাখে।

দুর্নীতির বিষয়ে সাবেক এক মন্ত্রিপরিষদ সচিব বলেছেন, ‘আইন সবার জন্য সমান। কেউ যদি জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদ অর্জন করেন, দুদক তদন্ত করে তাঁর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে পারে। … আইনে প্রভাবশালী নিয়ে কিছু বলা নেই। সাবেক একজন প্রধানমন্ত্রীরও দুর্নীতির বিচার হয়েছে। সুতরাং যে কারও দুর্নীতির বিষয়ে দুদক চাইলে অনুসন্ধান করে ব্যবস্থা নিতে পারে।’ কিন্তু কে শোনে কার কথা?

আসলে ছোট-বড়, ভদ্র, স্মার্ট– সব দুর্নীতিবাজ অবৈধ উপায়ে অর্থ অর্জন বিষয়ে একাকার হয়ে গেছে। স্বজনপ্রীতি, ঘুষ, চাঁদাবাজি, জালিয়াতি, চুরি, খাদ্যসহ সব সামগ্রীতে ভেজাল দেওয়া যেন মজ্জাগত। দুর্নীতির বিরুদ্ধে সংবাদ শিরোনাম যতই চওড়া হোক, দুদকের খুব একটা হেলদোল নেই। জনমতের চাপে কিছু ঘটনায় সংস্থাটি তদন্তে নামলেও তা শামুকের গতিকে হারা মানায়। একই সঙ্গে ‘হোয়াইট কলার ক্রিমিনালদের’ পক্ষে রাজনৈতিকভাবে একচোখা ও দলকানা নীতিও সাড়ম্বরে চালু আছে। দলবাজ অপরাধীরা দলের কৃপা ও দয়া পেয়ে পেয়ে নিজেদের আইন-আদালতের ঊর্ধ্বে ভাবতে শুরু করেছে। এই হতাশাজনক পরিস্থিতি থেকে মুক্তির এখন একটাই পথ– দুর্নীতির বিরুদ্ধে সামাজিক আন্দোলন।

মো. ফখরুল ইসলাম: রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকর্ম বিভাগের অধ্যাপক ও সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের প্রাক্তন ডিন