[ অনলাইন ] 25/04/2024
 
সমিতির কোটি টাকা লোপাটের অভিযোগে মামলা
রাজশাহীতে একটি সমবায় সমিতির টাকা লোপাটের অভিযোগে এর নেতাদের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে। সমিতির এক সদস্যের করা মামলায় নিরীক্ষা প্রতিবেদনে বছরের পর বছর আয়-ব্যয়ের হিসাব সমান দেখিয়ে টাকা আত্মসাতের অভিযোগ আনা হয়েছে। ওই সদস্যের অভিযোগ, ভবন ভাড়া থেকে সমিতি প্রতিবছর বিপুল টাকা আয় করলেও তা নিরীক্ষা প্রতিবেদনে দেখানো হয় না।

রাজশাহী রিফিউজি কো-অপারেটিভ স’মিল লিমিটেড নামের এই সমিতির বয়স ৭১ বছর। ভারত থেকে রাজশাহীতে আসা তৎকালীন মুহাজির বা রিফিউজি কাঠ মিল ব্যবসায়ীদের গঠন করা সমিতিটি ১৯৫২ সালে নিবন্ধন (নম্বর-২২) পায়; আইডি নম্বর ৮১২২০০৩৯১। ১৯৬৬ সালে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান সরকারের জেলা প্রশাসক রাজশাহী নগরীর গোরহাঙ্গা এলাকায় প্রায় সাড়ে ১৪ কাঠা খাসজমি সমিতিটিকে ইজারা দেয়। ওই ইজারা এখনো চলছে। নিউমার্কেটসংলগ্ন প্রধান সড়ক লাগোয়া জমিটি এখন শহরের গুরুত্বপূর্ণ এলাকা।

সেই জমিতে দোকান ও কার্যালয় নির্মাণ করেছে সমিতিটি। প্রতিমাসে এসব দোকানপাট ও কার্যালয় থেকে ওঠা ভাড়ার টাকা লোপাটের অভিযোগে গত ১৫ এপ্রিল মামলা করেন সমিতির সহসভাপতি মো. সোবহান। রাজশাহীর বোয়ালিয়া থানার আমলী আদালতে করা মামলায় সমিতির সভাপতি আবদুল জাব্বার আনসারী, সাধারণ সম্পাদক আসলাম পারভেজ, সদস্য সারফারাজ আব্বাস ও জুলেখা আব্বাসকে আসামি করা হয়েছে। মামলাটি আমলে নিয়ে আদালত আগামী ৭ অক্টোবর তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করতে বোয়ালিয়া থানাকে নির্দেশ দিয়েছেন। বোয়ালিয়া মডেল থানার ওসি হুমায়ুন কবির জানান, আদালতের নির্দেশে মামলা তদন্তের জন্য কর্মকর্তা নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। নির্ধারিত সময়ের মধ্যেই প্রতিবেদন আদালতে দাখিল করা হবে।

মামলার আসামিরা সবাই একই পরিবারের সদস্য। আবদুল জাব্বার আনসারী ও আসলাম পারভেজ সম্পর্কে দুই ভাই। আর জুলেখা ও সারফারাজ হলেন জাব্বার আনসারীর সন্তান। ছয় সদস্যের কমিটির মধ্যে এই পরিবারটিই চারটি পদ দখল করে আছেন।

মামলার অভিযোগে বলা হয়, শুধু ২০২১-২২ ও ২০২২-২৩ দুই অর্থবছরেই মামলার আসামিরা দোকান ভাড়ার ১৪ লাখ ৮৮ হাজার টাকা ও জামানতের ১২ লাখ ৯৪ হাজার ৯০ টাকা আত্মসাৎ করেছেন। মামলা অনুযায়ী, সমিতি জিয়াউল হক নামে এক ভাড়াটিয়ার কাছ থেকে বছরে ৩৬ হাজার, খাজা বাবা নামের আরেকটি প্রতিষ্ঠান থেকে ১ লাখ ২০ হাজার, একটি দোকান থেকে ৩ লাখ ৩৬ হাজার, একটি বিরিয়ানির দোকান থেকে ২ লাখ ৪০ হাজার ও আরেক ব্যবসায়ীর কাছ থেকে ১২ হাজার টাকা ভাড়া আদায় করে থাকে। প্রতি অর্থবছরে সমিতি ভাড়া থেকে ৭ লাখ ৪৪ হাজার টাকা আদায় করে থাকে। তবে বার্ষিক নিরীক্ষা প্রতিবেদনে এর কোনো উল্লেখ দেখা যায়নি।

মো. আলমগীর নামে সমিতির এক সদস্যের অভিযোগ ২০১৪ সাল থেকে সমিতির টাকা লোপাট করা হচ্ছে। তিনি জানান, সমিতিতে মোট সদস্য আছেন ৪৫ জন। সমিতির আয় সদস্যদের কল্যাণে তাদের মাঝে বণ্টনের নিয়ম রয়েছে। কিন্তু কার্যনির্বাহী কমিটির সভাপতি-সম্পাদক তা করেন না। সমিতির আয়-ব্যয় ব্যাংক হিসাবের মাধ্যমে করার নিয়ম থাকলেও সেটিও করা হয় না।

নথিপত্র ঘেঁটে দেখা গেছে, নিরীক্ষা প্রতিবেদন ২০২২-২৩ অর্থবছরে সব মিলিয়ে ৪ লাখ ১৬ হাজার ৩৪৩ টাকা আয় দেখানো হয়। খরচও দেখানো হয় ৪ লাখ ১৬ হাজার ৩৪৩ টাকা। সভাপতি-সম্পাদক স্বাক্ষরিত এই আয়-ব্যয় হিসাব বিবরণী অনুমোদন দেন নিরীক্ষা কর্মকর্তা ও রাজশাহী মেট্রোপলিটন থানা সমবায় কর্মকর্তা নাছিমা খাতুন। এর আগে ২০২১-২২ অর্থবছরেও ৩ লাখ ৭৪ হাজার ৬০৩ টাকা আয় এবং একই পরিমাণ টাকা ব্যয় দেখানো হয়। এই নিরীক্ষা প্রতিবেদনেও সমিতির সভাপতি-সম্পাদকের স্বাক্ষর করা হিসাব বিবরণী অনুমোদন দেন নিরীক্ষক ও মেট্রোপলিটন থানা সমবায় কার্যালয়ের সহকারী পরিদর্শক বিউটি রানী সাহা।

সভাপতি-সম্পাদকের দাখিল করা হিসাব বিবরণী যাচাই-বাছাই করে অনুমোদন করা হয় বলে দাবি করেন মেট্রোপলিটন থানা সমবায় কর্মকর্তা নাছিমা খাতুন। তিনি বলেন, ‘এর বেশি কোনো আয় হয়ে থাকে কিনা তা জানি না।’

সমবায় কর্মকর্তাকে ম্যানেজ করে এসব নিরীক্ষা প্রতিবেদন প্রস্তুত করে অনুমোদন করানো হয় বলে অভিযোগ করেন মামলার বাদী মো. সোবহান। তিনি বলেন, ‘বাস্তবে ব্যয়ের চেয়ে আয় অনেক বেশি। এই টাকা সমিতির সভাপতি-সম্পাদকসহ কয়েকজন আত্মসাৎ করেন।’

আনসারী পরিবারের চার সদস্য অনিয়ম করে সমিতিতে তাদের শেয়ারের সংখ্যা বাড়িয়ে নিয়েছেন বলেও অভিযোগ আছে। ২০২১-২২ অর্থবছরে সভাপতি আনসারীর শেয়ারের সংখ্যা ছিল ৫৮০টি। ২০২২-২৩ অর্থবছরে তা বাড়িয়ে ৪ হাজার ৬৮০টি করে নেওয়া হয়। একইভাবে ছেলে সারফারাজ ও মেয়ে জুলেখার ১৩০টি করে শেয়ার ছিল। তা বাড়িয়ে বাড়িয়ে ১ হাজার ২৩০টি করে নেওয়া হয়েছে। জামাতা সাব্বির আহমেদের কোন শেয়ার ছিল না। হঠাৎ কাগজ-কলমে তার শেয়ার ১ হাজার ২০০টি করে নেওয়া হয়। কীভাবে তাদের পরিবারের শেয়ার রাতারাতি বেড়ে গেছে তা সমিতির অন্য সদস্যরা কিছুই জানেন না। এ ক্ষেত্রে গঠনতন্ত্র ও নিয়মনীতির তোয়াক্কা করা হয়নি বলে অভিযোগ সমিতির অন্য সদস্যদের।

তবে পরিবারের সদস্যদের শেয়ার নিয়ম মেনে বাড়ানো হয়েছে বলে দাবি করেন সমিতির সভাপতি আবদুল জাব্বার আনসারী। তিনি বলেন, ‘আত্মসাতের অভিযোগ সঠিক না। সহসভাপতি মামলা করেছেন ঠিক; কিন্তু সব কিছু তো তাকে নিয়েই করা হয়েছে।’ আর সমিতির সাধারণ সম্পাদক আসলাম পারভেজের ভাষ্য, ‘বোঝেনই তো; সব হিসাবই তো অডিট রিপোর্টে দেওয়া যায় না। নিজেদের মধ্যে বণ্টন করতে হয়।’