[ পাতা ১ ] 26/04/2024
 
বেনজীরের সম্পদের তথ্য চেয়ে চিঠি, তলব করবে দুদক
পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক (আইজিপি) বেনজীর আহমেদ ও তাঁর পরিবারের সদস্যদের অবৈধ সম্পদ অনুসন্ধানে তোড়জোড় শুরু করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। এরই মধ্যে দেশের ব্যাংকগুলোতে বেনজীর আহমেদ ও তাঁর পরিবারের সদস্যদের অতীত ও বর্তমান চলতি ও সঞ্চয়ী হিসাব, এফডিআর, ডিপিএসসহ যাবতীয় আর্থিক লেনদেনের তথ্য চাওয়া হয়েছে। এর জন্য বাংলাদেশ ব্যাংকের ফিন্যানশিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিটে (বিএফআইইউ) চিঠি পাঠানো হয়েছে। এ ছাড়া সাবরেজিস্ট্রার অফিস, জয়েন্ট স্টক কম্পানি, স্টক এক্সচেঞ্জ, সিটি করপোরেশনসহ সরকারের বিভিন্ন দপ্তরেও তথ্য চেয়ে চিঠি পাঠানো হয়েছে।

গতকাল বৃহস্পতিবার ও গত বুধবার দুদক থেকে এসব চিঠি পাঠানো হয়। দুদক সূত্র কালের কণ্ঠকে এসব তথ্য নিশ্চিত করেছে। চিঠিতে মে মাসের প্রথম সপ্তাহের মধ্যে তথ্য সরবরাহ করতে বলা হয়েছে। এ ছাড়া বিদেশে পাচার করা সম্পদের তথ্য সংগ্রহের জন্য আগামী সপ্তাহে বিএফআইইউতে পৃথক আরেকটি চিঠি পাঠানো হবে।
এসব তথ্য সংগ্রহ ও পর্যালোচনার পর বেনজীর আহমেদকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য তলব করা হবে বলে জানিয়েছে দুর্নীতি দমন কমিশন।

জানতে চাইলে দুদক কমিশনার (তদন্ত) মো. জহুরুল হক কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘সুষ্ঠু অনুসন্ধানের স্বার্থে তথ্য চেয়ে বিভিন্ন দপ্তরে চিঠি দেওয়া হচ্ছে। তথ্যগুলো পাওয়া গেলে তা বিশ্লেষণ করে অনুসন্ধান দল প্রতিবেদন দাখিল করবে। মামলা করার মতো উপাদান পাওয়া গেলে অনুসন্ধান দল কমিশনে মামলার প্রস্তাব করবে।
এরপর কমিশন সিদ্ধান্ত নেবে।’

তিনি আরো বলেন, ‘যাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ, তাঁকে অবশ্যই জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে। বিভিন্ন তথ্য-উপাত্ত পাওয়ার পর অনুসন্ধান দল তাঁকে জিজ্ঞাসাবাদ করবে। তাঁর বক্তব্যও অনুসন্ধান দল পর্যালোচনা করবে।’

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক দুদকের একজন কর্মকর্তা কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘বেনজীরের বিদেশে অর্থপাচারের প্রাথমিক বিভিন্ন তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করা হচ্ছে।
এসব তথ্য পর্যালোচনাও করা হচ্ছে। আগামী সপ্তাহে বিদেশে থাকা অর্থের তথ্য চেয়ে ফের বিএফআইইউতে পৃথক আরেকটি টিঠি দেওয়া হবে। চিঠিতে বেনজীর আহমেদের পরিবারের ফরেন কারেন্সি ট্রানজেকশনের তথ্যও চাওয়া হবে। ফরেন কারেন্সি ট্রানজেকশনের তথ্য পাওয়ার পর সেখান থেকেও বেনজীর আহমেদ কী পরিমাণ অর্থ বিদেশে পাচার করেছেন তার বিভিন্ন ক্লু পাওয়া যাবে।’ যথাসময়ে অনুসন্ধান প্রতিবেদন দাখিলের জন্য কমিশনের তাগিদ রয়েছে বলেও জানান তিনি।

এর আগে গত রবিবার বেনজীর আহমেদ ও তাঁর পরিবারের সদস্যদের অবৈধ সম্পদ অনুসন্ধান করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে দুদক চেয়ারম্যান বরাবর আবেদন করেন হবিগঞ্জ-৪ (মাধবপুর-চুনারুঘাট) আসনের সংসদ সদস্য ব্যারিস্টার সৈয়দ সায়েদুল হক সুমন। এরপর গত সোমবার দুদকসচিব খোরশেদা ইয়াসমীন এক সংবাদ সম্মেলনে বেনজীর আহমেদ ও তাঁর পরিবারের সদস্যদের অবৈধ সম্পদ অনুসন্ধান শুরুর তথ্য জানান। তিনি বলেন, ‘গত ১৮ এপ্রিল কমিশনের সভায় বেনজীর আহমেদের বিরুদ্ধে অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগ অনুসন্ধানের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। এদিকে গত মঙ্গলবার বিচারপতি মো. নজরুল ইসলাম তালুকদার ও বিচারপতি কাজী ইবাদত হোসেনের হাইকোর্ট বেঞ্চ আগামী দুই মাসের মধ্যে দুদকের অনুসন্ধান কমিটির কার্যক্রমের অগ্রগতি প্রতিবেদন দাখিলের নির্দেশ দিয়েছেন।

দৈনিক কালের কণ্ঠে ‘বেনজীরের ঘরে আলাদীনের চেরাগ’ এবং ‘বনের জমিতে বেনজীরের রিসোর্ট’ শিরোনামে গত ৩১ মার্চ ও ২ এপ্রিল পৃথক দুটি অনুসন্ধানী প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। প্রতিবেদন দুটি প্রকাশের পর দেশে-বিদেশে ব্যাপক সাড়া ফেলে। মূলত এর পরই দুদক বেনজীর ও তাঁর পরিবারের সদস্যদের অবৈধ সম্পদ অনুসন্ধানের সিদ্ধান্ত নেয়।

অবৈধ সম্পদ অনুসন্ধানে দুদকের উপপরিচালক হাফিজুল ইসলামের নেতৃত্বে তিন সদস্যের একটি কমিটি গঠন করা হয়েছে। কমিটির অন্য দুজন সদস্য হলেন—সহকারী পরিচালক নিয়ামুল হাসান গাজী ও সহকারী পরিচালক জয়নাল আবেদীন।

কালের কণ্ঠে প্রকাশিত গত ৩১ মার্চ ও ২ এপ্রিলের পৃথক অনুসন্ধানী প্রতিবেদনে সাবেক আইজিপি বেনজীর আহমেদ ও তাঁর পরিবারের সদস্যদের অবৈধ সম্পদের বিস্তর তথ্য তুলে ধরা হয়েছে।

সাভানা ইকো রিসোর্ট

গোপালগঞ্জের সাহাপুর ইউনিয়নের বৈরাগীটোল গ্রাম। নিভৃত ওই গ্রামে বেনজীর আহমেদ ও তাঁর পরিবার গড়ে তুলেছে সাভানা ইকো রিসোর্ট। সেখানে এক রাত থাকতে হলে গুনতে হয় ১৫ হাজার টাকা। রিসোর্টের ভেতরে ঘুরে দেখা গেছে, বিশাল আকৃতির ১৫টি পুকুরের চারপাশে রয়েছে গার্ড ওয়াল, দৃষ্টিনন্দন ঘাট, পানির কৃত্রিম ঝরনা ও আলোর ঝলকানি। আর পুকুরের পার ঘেঁষে গড়ে তোলা হয়েছে বিলাসবহুল ডুপ্লেক্স কটেজ। প্রায় এক হাজার ৪০০ বিঘা জমির ওপর নির্মিত ওই ইকো রিসোর্টে বিভিন্ন জায়গায় মাটি ভরাট করে তৈরি করা হয়েছে কৃত্রিম পাহাড়। সাগরের কৃত্রিম ঢেউ খেলানো সুইমিংপুলও রয়েছে। রিসোর্টের নিরাপত্তায় বসানো হয়েছে ‘বিশেষ’ পুলিশ ফাঁড়ি। যাতায়াতের জন্য সরকারি খরচে তৈরি করা হয়েছে সাত কিলোমিটারের বেশি পাকা সড়ক।

ছয়টি কম্পানিসহ অঢেল সম্পদ

শুধু ইকো রিসোর্টই নয়, পুলিশের সাবেক এই আইজি তাঁর স্ত্রী ও দুই মেয়ের নামে গড়ে তুলেছেন সম্পদের পাহাড়। কালের কণ্ঠ’র অনুসন্ধানে দেশের বিভিন্ন এলাকায় তাঁদের নামে অন্তত ছয়টি কম্পানির খোঁজ পাওয়া গেছে। এর বাইরে রাজধানীর অভিজাত এলাকাগুলোয় রয়েছে বেনজীর আহমেদের অঢেল সম্পদ। দামি ফ্ল্যাট, বাড়ি আর রাজধানীর কাছেই বিঘার পর বিঘা জমি। দুই মেয়ের নামে বেস্ট হোল্ডিংস ও পাঁচতারা লা মেরিডিয়ান হোটেলের রয়েছে দুই লাখ শেয়ার। পূর্বাচলে রয়েছে ৪০ কাঠার সুবিশাল জায়গাজুড়ে ডুপ্লেক্স বাড়ি, যার আনুমানিক মূল্য অন্তত ৪৫ কোটি টাকা। একই এলাকায় রয়েছে ২২ কোটি টাকা মূল্যের আরো ১০ বিঘা জমি।

বনের জমিতে বেনজীরের রিসোর্ট

গাজীপুর সদর উপজেলার ভাওয়ালগড় ইউনিয়নের নলজানী গ্রামে ১৬০ বিঘা জমির ওপর গড়ে তোলা হয়েছে ভাওয়াল রিসোর্ট। ২০১৮ সালের ৬ এপ্রিল প্রায় ১০৬ বিঘা জমির ওপর রিসোর্টটির যাত্রা শুরু। পরে এতে যোগ হয় আরো ৫৪ বিঘা জমি। কালের কণ্ঠ’র অনুসন্ধানে দেখা গেছে, এই রিসোর্টের বড় অংশ গড়ে তোলা হয়েছে বনের জমি দখল করে। এর নেপথ্যে সহায়তা করেছেন পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক (আইজিপি) বেনজীর আহমেদ। কারণ, রিসোর্টটির এক-চতুর্থাংশ শেয়ারের মালিক তিনি।

পাচারের টাকায় বিদেশে সম্পদের পাহাড়

পুলিশের সাবেক আইজি বেনজীর আহমেদের দুবাই, সিঙ্গাপুর, থাইল্যান্ড ও মালয়েশিয়ায় বিপুল বিনিয়োগের তথ্য পাওয়া গেছে। অনুসন্ধানে দেখা গেছে, পুলিশের ঊর্ধ্বতন পদে চাকরির সুবাদে বিভিন্ন উৎস থেকে অবৈধ উপার্জনের টাকা পাচার করে বিনিয়োগ করেছেন তিনি। অনুসন্ধানে পাওয়া তথ্যানুযায়ী, বেনজীর আহমেদের দুবাইয়ে রয়েছে শতকোটি টাকার হোটেল ব্যবসা। সিঙ্গাপুরে অর্ধশত কোটি টাকারও বেশি বিনিয়োগে প্রতিষ্ঠা করেছেন সোনার ব্যবসা। এ ছাড়া থাইল্যান্ড ও মালয়েশিয়ায় জমি কিনেছেন বলে তথ্য পাওয়া গেছে।