[ পাতা ১ ] 29/04/2024
 
পাঁচ জেলার ভূমি জরিপ ৬১ জেলার টাকায়!
ডিজিটাল পদ্ধতিতে ভূমি জরিপের জন্য ২০২০ সালে একটি প্রকল্পের কাজ শুরু করে ভূমি জরিপ ও রেকর্ড অধিদপ্তর। এরপর সাড়ে তিন বছরেও শুরু হয়নি সেই কাজ। এ কারণে ‘ডিজিটাল জরিপ পরিচালনার সক্ষমতা বৃদ্ধিকরণ’ শীর্ষক প্রকল্পটি সংশোধনের জন্য পাঠানো হয়। তবে সম্ভাব্যতা যাচাই না করেই প্রকল্প গ্রহণ এবং হতাশাজনক অগ্রগতির কারণে গত ডিসেম্বরে প্রকল্পটি সমাপ্ত ঘোষণা করে সম্পূর্ণ নতুন প্রস্তাব পাঠাতে বলে পরিকল্পনা কমিশন।

কিন্তু নতুন প্রকল্প গ্রহণের পরিবর্তে প্রকল্পটি সংশোধনের প্রস্তাব পুনর্বিবেচনার আবদার করে ভূমি জরিপ ও রেকর্ড অধিদপ্তর। পরবর্তী সময়ে সংশোধনী প্রস্তাব যাচাই-বাছাই শুরু করে পরিকল্পনা কমিশন। এতে দেখা যায়, মূল প্রকল্পে ৬১টি জেলায় জরিপ কার্যক্রম পরিচালনার কথা থাকলেও সংশোধিত প্রস্তাবের আওতায় জেলার সংখ্যা মাত্র পাঁচ। কিন্তু মূল প্রকল্পে যে পরিমাণ অর্থ বরাদ্দ ছিল, নতুন প্রস্তাবে চাওয়া হয়েছে প্রায় পুরোটাই। অর্থাৎ সংশোধিত প্রস্তাবে জরিপ কাজের পরিধি অনেক কমে গেলেও টাকার পরিমাণ না কমানোর ‘মামাবাড়ির আবদার’ করেছে ভূমি জরিপ ও রেকর্ড অধিদপ্তর।

ভূমি জরিপ ও রেকর্ড অধিদপ্তরের সংশোধনী প্রস্তাব পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, মূল প্রকল্পটি ১ হাজার ২১২ কোটি ৫৫ লাখ টাকা ব্যয়ে পাঁচ বছর মেয়াদে ২০২০ সালে প্রকল্পটি অনুমোদন দেওয়া হয়। মূল প্রকল্পে ৬১ জেলার ৪৭০টি উপজেলায় ২ লাখ ৬০ হাজার ৩৬৯টি জিওডেটিক কন্ট্রোল পিলার স্থাপনসহ পটুয়াখালী ও বরগুনা জেলার ১৪টি উপজেলায় পূর্ণাঙ্গ ডিজিটাল ভূমি জরিপ কার্যক্রম অন্তর্ভুক্ত ছিল।

সংশোধনী প্রস্তাবে পিলার স্থাপন বাদ দিয়ে নতুন করে ১৮টি উপজেলাসহ পাঁচটি জেলার ৩২ উপজেলা প্রকল্প এলাকা হিসেবে নির্বাচন করা হয়েছে। এতে ৫৬ জেলার ৪৩৮টি উপজেলা বাদ গেলেও ব্যয় কমানো হয়েছে মাত্র ১৭ কোটি ৮ লাখ টাকা। অর্থাৎ প্রায় একই টাকায় ৬১ জেলার পরিবর্তে পাঁচ জেলার জরিপ কাজ হবে। প্রকল্প এলাকার পরিধি কমলেও সে তুলনায় ব্যয় না কমায় প্রশ্ন উঠেছে।

এ বিষয়ে ভূমি জরিপ ও রেকর্ড অধিদপ্তরের যুক্তি, প্রকল্প এলাকার পরিধি কমলেও কাজের পরিধি বেড়েছে। আগে ৬১ জেলায় ৪৭০টি উপজেলায় পিলার স্থাপন এবং ১৪টি উপজেলায় জরিপ কাজ করার কথা ছিল। কিন্তু সেটা ঝুঁকিপূর্ণ হওয়ায় পিলার স্থাপন বাদ দিয়ে আগের ১৪টি উপজেলাসহ নতুন করে ১৮টি যুক্ত করে পাঁচ জেলার ৩২টি উপজেলায় পূর্ণাঙ্গ ডিজিটাল জরিপ কাজ করা হবে।

অনুমোদিত প্রকল্প এবং সংশোধিত প্রকল্পের ব্যয়ের পর্যালোচনায় দেখা গেছে, ১৯৮টি খাতের ক্রয় প্রস্তাব করা হয়েছে। সংশোধনী প্রস্তাবে এসব খাতের মধ্যে আসবাপত্র এবং কম্পিউটার সামগ্রী কিনতে আকশচুম্বি ব্যয় দাবি করা হয়েছে। এ ছাড়া যন্ত্রপাতি ক্রয় এবং যানবাহন রক্ষণাবেক্ষণেও দ্বিগুণ অর্থ প্রস্তাব করা হয়েছে। প্রচার ও বিজ্ঞাপন, আপ্যায়ন এবং বিদেশ প্রশিক্ষণের নামেও অত্যধিক ব্যয় ধরা হয়েছে।

ব্যয় পর্যালোচনায় দেখা গেছে, মূল ডিপিপিতে প্রচার ও বিজ্ঞাপন ব্যয় ১০ লাখ টাকা ধরা হলেও সংশোধনীতে ৮৪ লাখ টাকা প্রস্তাব করা হয়েছে। অর্থাৎ এই এক খাতেই ৭৪ লাখ টাকা বেশি প্রস্তাব করা হয়েছে। এ ছাড়া মূল ডিপিপিতে চারজনের আপ্যায়ন ভাতা ছিল ১ লাখ ৬২ হাজার টাকা। কিন্তু সংশোধনী প্রস্তাবে একজনের আপ্যায়ন ভাতা ধরা হয়েছে ১ লাখ ২৬ হাজার টাকা। অর্থাৎ আরডিপিপিতে তিনজন কমলেও ব্যয় কমেছে মাত্র ৩৬ হাজার টাকা।

সংশোধনী প্রস্তাবে এরিয়াল ফটোগ্রাফিক ওয়ার্ক স্টেশন খাতে খরচ ধরা হয়েছে ৩৫ লাখ, যা আগে ছিল ৬ লাখ টাকা। কোর রাউটার প্রতিপিস ৭০ লাখ টাকা ধরা হয়েছে, অথচ মূল ডিপিপিতে প্রতিটির দাম ধরা ছিল ২ লাখ ৯৫ হাজার টাকা, কোর সুইচ প্রতিটি ২০ লাখ টাকা ধরা হয়েছে, যা মূল ডিপিপিতে ছিল প্রতিটি ৬৭ হাজার টাকা। কোর ফায়ারওয়াল প্রতিটি ৯০ লাখ টাকা ধরা হয়েছে, যা আগে ছিল সাড়ে ১২ লাখ টাকা।

এ ছাড়া প্রতিটি জিপিএস সিস্টেমের ব্যয় ধরা হয়েছে ৯৫ লাখ টাকা, অথচ মূল ডিপিপিতে প্রতিটির দাম ধরা ছিল ৫৫ লাখ টাকা, সংশোধনীতে প্রতিসেট টোটাল স্টেশন ও অন্যান্য যন্ত্রণাংশ খাতে খরচ ১৫ লাখ টাকা, আগে ছিল প্রতিসেট ৯ লাখ টাকা। মূল ডিপিপি যে ডিএলএসএস খাতে খরচ ধরা হয়েছিল ২ কোটি ৪৩ লাখ টাকা, সেই একই খাতে সংশোধনী প্রস্তাবে ধরা হয়েছে ১০ কোটি টাকা।

পর্যালোচনায় দেখা গেছে, ওয়ার্ক স্টেশনের জন্য আনুষঙ্গিক যন্ত্রপাতি একেকটি কম্পিউটারের দাম ধরা হয়েছে সাড়ে ৫ লাখ টাকা, অথচ মূল ডিপিপিতে প্রতিটির দাম ধরা ছিল ১ লাখ ৬১ হাজার টাকা। প্রতিটি সাধারণ কম্পিউটারের দাম ধরা হয়েছে ১ লাখ ২০ টাকা, মুল ডিপিপিতে ছিল ৮০ হাজার টাকা। ল্যাপটপের দাম ধরা হয়েছে প্রতিটি ১ লাখ ৬০ হাজার টাকা। মূল ডিপিপিতে না থাকলেও একেকটি ১ লাখ টাকা ধরে ৬টি মিনি ট্যাব কেনার প্রস্তাব করা হয়েছে।

মূল ডিপিপি যে সেক্রেটারিয়াল টেবিলের দাম ধরা হয়েছিল ২৫ হাজার টাকা, সংশোধনীতে তার দাম ধরা হয়েছে ১ লাখ ২০ হাজার টাকা। প্রতিটি হাফ সেক্রেটারিয়াল টেবিলের দাম ধরা হয়েছে ১ লাখ টাকা। ২০ হাজার টাকার প্রতিটি এক্সিকিউটিভ টেবিল ধরা হয়েছে ৯০ হাজার টাকা। ১২ হাজার টাকার এক্সিকিউটিভ চেয়ার ধরা হয়েছে ৩৭ হাজার টাকা। ২ হাজার টাকার সাধারণ টেবিলের দাম ২০ হাজার টাকা এবং ৮ হাজার টাকার সাধারণ চেয়ারের দাম ধরা হয়েছে ২০ হাজার টাকা। মূল ডিপিপির ৩০ হাজার টাকার লকারের দাম নতুন প্রস্তাবে ধরা হয়েছে ১ লাখ ১৫ হাজার টাকা। একইভাবে ১০ হাজার টাকার প্রিন্টার টেবিলের দাম প্রস্তাব করা হয়েছে ৩০ হাজার টাকা।

জানা গেছে, ভূমি অধিদপ্তরের সংশোধনী প্রস্তাবের বিভিন্ন খাতে অতিরিক্ত ব্যয় প্রস্তাবের বিষয়টি পরিকল্পনা কমিশনের পর্যবেক্ষণেও উঠে এসেছে। সম্প্রতি অনুষ্ঠিত সংশোধনী প্রস্তাবটির ওপর প্রকল্প মূল্যায়ন কমিটির সভায় এসব বিষয় উত্থাপন করা হয়েছে। এ ছাড়া নিজস্ব জনবলের পরিবর্তে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে জরিপ কাজের যৌক্তিকতা এবং কাজ কমলেও বিভিন্ন অঙ্গের পরিমাণ বৃদ্ধির বিষয়ে জানতে চাওয়া হয়েছে।

পরিকল্পনা কমিশনের পর্যবেক্ষণে বলা হয়েছে, ‘আলোচ্য প্রকল্পের সংশোধনী প্রস্তাবে অফিস ভাড়া, পেট্রোল, অয়েল ও লুব্রিকেন্ট, আসবাবপত্র, কম্পিউটার খাতগুলোর ব্যয় অত্যাধিক প্রতীয়মান হয়। এ সব অঙ্গগুলোর ব্যয় যৌক্তিক পর্যায়ে হ্রাস করা যেতে পারে। এ ছাড়া প্রকল্প এলাকা কমানো হলেও আসবাবপত্রের সংখ্যা ও ব্যয় বেড়েছে। এসব অঙ্গের পরিমাণ ও ব্যয় আনুপাতিক হারে কমানো প্রয়োজন।’

জানতে চাওয়া হলে পরিকল্পনা কমিশনের কৃষি, পানিসম্পদ ও পল্লী প্রতিষ্ঠান বিভাগের প্রধান মো. ছায়েদুজ্জামান কালবেলাকে বলেন, ‘ভূমি জরিপ প্রকল্পের বিভিন্ন বিষয়ে আলোচনা হয়েছে। তারা ফিজিবিলিটি স্ট্যাডি করে সংশোধনী প্রস্তাব করেছে। এখনো এটি যাচাই-বাছাই পর্যায়ে রয়েছে।’

অতিরিক্ত ব্যয় প্রস্তাবের বিষয়ে তিনি বলেন, ‘দাম যাচাই করার কাজ আমাদের নয়, সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের। তার পরও যাচাই-বাছাই করে কোনো প্রস্তাব অতিরিক্ত প্রতীয়মান হলে বা কোনো অসংগতি থাকলে সংশোধন করতে বলা হবে।’

প্রকল্পটির পরিচালক হিসেবে সম্প্রতি দায়িত্ব পেয়েছেন মোহম্মদ আশরাফুল ইসলাম। প্রকল্প এলাকা পরিবর্তন এবং অতিরিক্ত ব্যয় প্রস্তাবের বিষয়ে তিনি বলেন, ‘মূল ডিপিপির তুলনায় এলাকা কমলেও কাজের পরিধি কমেনি। বরং জরিপ কাজের পরিধি বেড়েছে। এ ছাড়া এখন সবকিছুর দাম বৃদ্ধি পেয়েছে। আমার জানা মতে, বাজার দর অনুযায়ী ব্যয় নির্ধারণ করা হয়েছে। প্রকল্পটি সংশোধনের প্রস্তাব এখনো অনুমোদন হয়নি। আরও কয়েকটি মিটিং হবে। সেসব মিটিংয়ে অতিরিক্ত ব্যয়ের বিষয়ে প্রশ্ন উঠলে যাচাই-বাছাই করে যৌক্তিক পর্যায়ে নির্ধারণ করা হবে।’