[ অনলাইন ] 2024-12-26
 
সমুদ্রগামী জাহাজ শিল্পে ২৭.৫% আয়কর ও সাড়ে ৭ শতাংশ মূসক পরিশোধ করতে হবে
 
সমুদ্রগামী জাহাজ পরিবহন শিল্পে ২০৩০ সাল পর্যন্ত আয়কর ছাড়ের সুবিধা ঘোষণা করেছিল সরকার। সম্প্রতি এক এসআরও জারির মাধ্যমে এ সুবিধা বাতিলের ঘোষণা দিয়েছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। এতে শিল্পটিতে আয়কর দাঁড়িয়েছে সাড়ে ২৭ শতাংশে। এর আগে ১৫ ডিসেম্বর জারি করা আরেক আদেশে শিল্পটিতে সাড়ে ৭ শতাংশ মূসক আরোপের ঘোষণা দেয়া হয়।

বিষয়টিকে সমুদ্রগামী জাহাজ ব্যবসা বিকাশের অন্তরায় হিসেবে দেখছেন খাতসংশ্লিষ্ট উদ্যোক্তারা। তারা বলছেন, খাতটির বিকাশ হয়েছে কর সুবিধাকে কাজে লাগিয়ে। এ ব্যবসায় যুক্ত হয়ে উৎপাদনমুখী শিল্পের কাঁচামাল আমদানিতে যুক্ত বড় শিল্পগোষ্ঠীগুলো নিজেদের সক্ষমতাও বাড়িয়ে তুলেছে। কিন্তু হঠাৎ করে বিদ্যমান কর সুবিধা বাতিলের পাশাপাশি নতুন করে মূসক আরোপ দেশের সমুদ্রগামী জাহাজ ব্যবসা পরিচালনায় স্থানীয় উদ্যোগগুলোকে মারাত্মকভাবে বাধাগ্রস্ত করবে।

একই সঙ্গে আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে পণ্য পরিবহন বাবদ বৈদেশিক মুদ্রা সাশ্রয়ের বড় ধরনের সুযোগকেও হাতছাড়া করবে বলে দাবি করছেন তারা। এ অবস্থায় বাংলাদেশ ওশান গোয়িং শিপ ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের পক্ষ থেকে বিষয়টি নিয়ে অর্থ উপদেষ্টা বরাবর এনবিআরের আদেশ দুটি পুনর্বিবেচনার অনুরোধ জানিয়ে চিঠি দেয়া হয়েছে।

চিঠিতে সমুদ্রগামী জাহাজ মালিকদের এ সংগঠনের পক্ষ থেকে উল্লেখ করা হয়, বাংলাদেশের বন্দরে বছরে পাঁচ হাজার জাহাজের আগমন হয়। যেখানে জাহাজ ভাড়া হিসেবে গড়ে ১২ থেকে ১৫ বিলিয়ন ডলার পর্যন্ত ব্যয় হয়। বিশেষ করে বিশ্বজুড়ে সরবরাহ চেইনে অস্থিতিশীলতার প্রেক্ষাপটে জাহাজে পণ্য পরিবহনের ব্যয় ব্যাপক মাত্রায় বেড়েছে। সমুদ্রগামী জাহাজ মালিকানায় স্থানীয় উদ্যোক্তাদের মালিকানা খুব ছোট পরিসরে হওয়ায় জাহাজ ভাড়ার প্রায় পুরোটাই মূলত দেশের বাইরে চলে যায়। করছাড়ের সঙ্গে সরকারি প্রণোদনা এবং দেশী জাহাজে পণ্য পরিবহনে বাড়তি সুবিধা দেয়ার সুযোগ ফলে গত অর্থবছরে স্থানীয় জাহাজ মালিকদের মাধ্যমে ৭৬০ মিলিয়ন ডলার জাহাজ ভাড়া ও আড়াই হাজার নাবিকের বেতনসহ প্রায় দেড় বিলিয়ন ডলার সাশ্রয় হয়েছে। এ অবস্থায় সরকার যদি সর্বশেষ সিদ্ধান্ত দুটি পুনর্বিবেচনা না করে, তাহলে বিপুল সম্ভাবনাময় জাহাজ শিল্পের অগ্রগতি ব্যাপক মাত্রায় বাধার সম্মুখীন হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।

এর আগে বাংলাদেশ ব্যাংকের বৈদেশিক মুদ্রা আয় বাড়ানোর সুযোগ সৃষ্টি এবং লেনদেনে অপচয়ের খাত চিহ্নিতকরণ-সংক্রান্ত একটি প্রতিবেদনে বাংলাদেশের পতাকাবাহী জাহাজে পণ্য পরিবহনের মাধ্যমে বৈদেশিক মুদ্রা আয় বাড়ানোর সুপারিশ তুলে ধরা হয়েছিল।

২০১৯ সাল থেকে এ পর্যন্ত ২৫টি সমুদ্রগামী জাহাজ নামিয়েছে মেঘনা গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রিজ। এর সবই খোলা বা বাল্ক জাহাজ।

মেঘনা গ্রুপের চেয়ারম্যান মোস্তফা কামাল বণিক বার্তাকে বলেন, ‘দেশের আমদানি-রফতানি বাণিজ্য পরিচালনায় বৈদেশিক মুদ্রার বড় অংশ ব্যয় হচ্ছে পণ্যের জাহাজীকরণে। দেশে আমদানি-রফতানির যে ভলিউম তাতে দেশের সমুদ্রবন্দরে বছরে সাড়ে চার থেকে পাঁচ হাজার জাহাজ আসে। আর এসব জাহাজের ভাড়া বাবদ বছরে গড়ে ১২ থেকে ১৪ বিলিয়ন ডলার দেশের বাইরে বিদেশী জাহাজ মালিকদের হাতে চলে যাচ্ছে শুধু স্থানীয় উদ্যোক্তাদের সম্পৃক্ততা কম হওয়ার কারণে। এ খাতে প্রণোদনা পেয়ে আমরা যখন বিনিয়োগ করতে শুরু করলাম, তাতে এখন জাহাজ ভাড়া ও নাবিকের বেতনাদি মিলিয়ে অন্তত দেড় বিলিয়ন ডলার আয় সম্ভব হয়েছে। সামনে আরো বিনিয়োগের যে পরিকল্পনা, তাতে জাহাজ ভাড়া বাবদ বৈদেশিক মুদ্রা দিনে দিনে আরো সাশ্রয় হয়ে আয় বাড়ার কথা। যদিও সে সম্ভবনার জায়গাটুকু এখন বড় ধরনের চ্যালেঞ্জের মধ্যে পড়েছে। সর্বশেষ আদেশ দুটির কারণে বিপুল সম্ভাবনাময় সমুদ্রগামী জাহাজ পরিবহন শিল্পের অগ্রগতির যে ধারা তৈরি হয়েছিল তা প্রচণ্ড বাধার সম্মুখীন হতে চলেছে। এমন পদক্ষেপে সমুদ্রগামী জাহাজের নতুন বিনিয়োগ যেমন নিরুৎসাহিত হবে, আবার আমরা যারা এরই মধ্যে বড় বিনিয়োগ করে ফেলেছি তারাও একটা বড় চ্যালেঞ্জের মধ্যে পড়ে গেলাম। সমুদ্রগামী জাহাজ মালিক উদ্যোক্তাদের পক্ষ থেকে এরই মধ্যে বিষয়টি নিয়ে অর্থ মন্ত্রণালয়ে লিখিতভাবে জানানো হয়েছে ।’

এখন পর্যন্ত মেঘনা গ্রুপেরই সর্বোচ্চসংখ্যক জাহাজ দেশের বাইরে সমুদ্রপথে পণ্য আনা-নেয়ার কাজে নিয়োজিত রয়েছে। এদিক থেকে দ্বিতীয় ও তৃতীয় অবস্থানে রয়েছে যথাক্রমে কেএসআরএম ও আকিজ গ্রুপ। বেসরকারি খাতের উদ্যোক্তাদের পাশাপশি সমুদ্রগামী জাহাজ পরিবহন খাতে বিনিয়োগ আছে রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠান শিপিং করপোরেশনেরও।

সহযোগী প্রতিষ্ঠান এসআর শিপিংয়ের মাধ্যমে সমুদ্রপথে বাল্ক জাহাজ চলাচল পরিচালনা করছে কেএসআরএম গ্রুপ। দেশে সমুদ্রগামী জাহাজ খাতে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ বিনিয়োগকারী গ্রুপটির উপব্যবস্থাপনা পরিচালক শাহরিয়ার জাহান বণিক বার্তাকে বলেন, ‘বিদেশী পণ্য পরিবহন করে একদিকে যেমন বৈদেশিক মুদ্রা আয় হচ্ছে, অন্যদিকে দেশের দক্ষ নাবিকদেরও কর্মসংস্থান হচ্ছে। অন্যভাবে বললে গার্মেন্ট খাত প্রচুর রফতানি আয় করলেও তাদের ব্যাক টু ব্যাক এলসিতে অনেক অর্থ চলে যায়। কিন্তু আমাদের এ খাতে দেশে একেবারে নিট ইনকাম। সব বিবেচনায় আমরা অনেক বিনিয়োগ করেছি। আশা করছি দেশের আমদানি-রফতানির ভলিউম অনুযায়ী জাহাজ ভাড়া এবং দেশের নাবিকদের সম্পৃক্ততার মতো বিষয়গুলো উপযুক্তভাবে পর্যালোচনা করা হলে বৈদেশিক মুদ্রায় হওয়া আয় সরাসরি কেন্দ্রীয় রিজার্ভে যোগ হয়ে আরো শক্তিশালী হবে।’

নাম অপ্রকাশিত রাখার শর্তে জাহাজ নিবন্ধনকারী সংস্থা নৌ-বাণিজ্য অফিসের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা বলেন, ‘সমুদ্রগামী জাহাজ নিবন্ধন বাড়তে শুরু করেছে মূলত ২০১৯ সালের পর। স্থানীয় উদ্যোক্তারা এগিয়ে এসে বাংলাদেশের পতাকাবাহী জাহাজের বহর বড় হতে শুরু করেছে মূলত সরকারি নীতিসহায়তা ও ব্যবসার সুরক্ষা আইন বাস্তবায়নে। বাংলাদেশের পতাকাবাহী জাহাজ (স্বার্থরক্ষা) আইন, ২০১৯-এর আওতায় বিভিন্ন রকম অনুকূল নীতি-সমর্থন দেয়া হয়েছে। তাতে বেশকিছু শিল্পগোষ্ঠী সমুদ্রগামী জাহাজের ব্যবসায় আসতে উৎসাহী হয়। এরপর মহামারীর সময় জাহাজ ভাড়া বাড়তে শুরু করে। তখন জাহাজের দামও ছিল তুলনামূলক কম। এরও সুযোগ নেন স্থানীয় উদ্যোক্তারা।’

‘বাংলার জ্যোতি’ দিয়ে প্রথম বাংলাদেশী পতাকাবাহী জাহাজ সাগরে ভাসায় রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ শিপিং করপোরেশন। তবে বর্তমানে যেসব জাহাজ সাগরে বাংলাদেশের পতাকা নিয়ে চলাচল করছে, তার বেশির ভাগেই বেসরকারি উদ্যোক্তাদের মালিকানাধীন। ২০১৮ সালে দেশে সমুদ্রগামী জাহাজের সংখ্যা ৩৭ থাকলেও ২০১৯ সালে ৪৭টি নিবন্ধনের পর ২০২০ সালে জাহাজের সংখ্যা বেড়ে এক লাফে ৬৪টিতে পৌঁছায়। এরপর ২০২১ সালে জাহাজের সংখ্যা আরো বেড়ে হয় ৭৩টি। ২০২২ সালে জাহাজের সংখ্যা ১৫টি যোগ হয়ে মোট দাঁড়ায় ৮৮টিতে। ২০২৩ সালে দুটি জাহাজ যোগ হয়ে এ সংখ্যা বেড়ে হয় ৯০টি। সর্বশেষ ২০২৪ সালে জাহাজের সংখ্যা ১০১-এ উন্নীত হয়েছে। এ খাতে বিনিয়োগের পরিমাণও দাঁড়িয়েছে প্রায় ২ হাজার কোটি ডলারে। বাংলাদেশী পতাকাবাহী সমুদ্রগামী জাহাজের বেশির ভাগই ৫০-৫৫ হাজার টন পণ্য পরিবহন সক্ষমতার। এর বাইরে রয়েছে কনটেইনারবাহী ফিডার জাহাজ, যা চট্টগ্রাম বন্দর থেকে সিঙ্গাপুর ও শ্রীলংকার মধ্যে কনটেইনার পরিবহনে নিয়োজিত।’

বাংলাদেশ শিপিং এজেন্ট অ্যাসোসিয়েশনের পরিচালক খায়রুল আলম সুজন বণিক বার্তাকে বলেন, ‘পণ্যবাহী সমুদ্রগামী জাহাজ পণ্য পরিবহনে বাংলাদেশের পতাকাবাহী জাহাজের সংখ্যা ১০১-এ উন্নীত হলেও একেবারেই অপ্রতুল। সাগরে পণ্য পরিবহনে বিদেশী জাহাজ ভাড়া করা ছাড়া কোনো উপায় থাকে না। তাই স্থানীয় উদ্যোক্তাদের এ খাতে বিনিয়োগের যে উৎসাহ তৈরি হয়েছে, সেটা দেশের অর্থনীতির স্বার্থে ধরে রাখাটা জরুরি।’
Print Close  
Print Close  
News Source
            Top
            Top
 
Home / About Us / Benifits /Invite a Friend / Policy
Copyright © Hawker 2009-2010, Allright Reserved