[ পাতা ১ ] 2025-02-05
 
ট্রাম্পের বাণিজ্যযুদ্ধের প্রভাব
মূল্যস্ফীতিতে আরও আঘাতের শঙ্কা
বিশ্বব্যাপী মূল্যস্ফীতি ঘটলে এর প্রভাব থেকে বাংলাদেশও রক্ষা পাবে না * স্বল্পমেয়াদে সুবিধা এলেও দীর্ঘমেয়াদে ক্ষতির শঙ্কা * কানাডা ও মেক্সিকোর উপর শুল্কারোপের ঘোষণা স্থগিত
 
ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত ২৭ দেশ ও চীনের পণ্যে যুক্তরাষ্ট্রের বাড়তি শুল্ক আরোপের নেতিবাচক প্রভাব পড়বে বিশ্ব অর্থনীতিতে। যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন পণ্যের ওপর চীন পালটা শুল্কারোপের ঘোষণা দেওয়ায় বৈশ্বিক মূল্যস্ফীতি বাড়বে। ইইউভুক্ত দেশগুলোও যুক্তরাষ্ট্রের ওপর শুল্কারোপের হুমকি দিয়েছে। সব মিলে পালটাপালটি এই বাণিজ্যযুদ্ধে বিশ্বজুড়ে অর্থনীতির গতি কমবে, বাড়বে ডলারের দাম। এর প্রভাবে পণ্যের মূল্য বাড়বে। এসবের বিরূপ প্রভাব পড়তে পারে দেশের অর্থনীতিতেও। বিশেষ করে বিশ্বব্যাপী মূল্যস্ফীতি ঘটলে এর প্রভাব থেকে বাংলাদেশও রক্ষা পাবে না। বিদেশ থেকে বছরে গড়ে সাড়ে ছয় হাজার কোটি মার্কিন ডলারের পণ্য আমদানি করছে বাংলাদেশ। শুল্ক আরোপের ফলে বাড়তি মূল্যে পণ্য আমদানিতে ব্যয় বাড়বে। যা দেশের বিদ্যমান উচ্চ মূল্যস্ফীতিকে আরও উসকে দেবে। এদিকে কানাডা ও মেক্সিকোর ওপরও নতুন শুল্ক আরোপের ঘোষণা দিয়েছিল যুক্তরাষ্ট্র। কিন্তু পরে তা এক মাসের জন্য স্থগিত করেছে।

বিগত ২ বছর ধরে টানা মূল্যস্ফীতির কশাঘাতে জর্জরিত দেশের সাধারণ মানুষ। নতুন করে মূল্যস্ফীতি দেখা দিলে তা বহন আরও কঠিন হয়ে পড়বে। বিদ্যমান ভঙ্গুর অর্থনীতির অবস্থা আরও খারাপ হবে বলে শঙ্কা প্রকাশ করছেন বিশ্লেষকরা।

অর্থনীতিবিদদের মতে, বিশ্বের বিভিন্ন দেশের পণ্যের ওপর ট্রাম্প প্রশাসনের শুল্ক আরোপের ফলে স্বল্পমেয়াদে রপ্তানিতে কিছু সুবিধার সম্ভাবনা তৈরি হলেও দীর্ঘমেয়াদে বাংলাদেশ ক্ষতির মুখে পড়তে পারে।

বৈদেশিক বাণিজ্যের তথ্যমতে, বাংলাদেশ প্রতিবছর গড়ে ৫ হাজার কোটি মার্কিন ডলারের বেশি পণ্য রপ্তানি করছে। বিপরীতে বিদেশ থেকে পণ্য আমদানি করছে ৬ থেকে সাড়ে ৬ হাজার কোটি ডলারের। বিশেষ করে খাদ্য, নিত্যপণ্য, সার ও জ্বালানি তেল আমদানিতে বেশি ব্যয় হচ্ছে। ফলে সুবিধা রপ্তানিতে থাকলেও ক্ষতির প্রভাব বেশি পড়বে আমদানিতে।

বৈশ্বিক বাণিজ্যযুদ্ধ শুরু হয় যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট হিসাবে ডোনাল্ড ট্রাম্প দায়িত্ব নেওয়ার পরপরই। সর্বশেষ ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) দেশগুলো থেকে যুক্তরাষ্ট্রে আমদানি করা পণ্যে ‘খুব শিগগির’ শুল্ক আরোপ করা হবে বলে জানিয়েছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। এর আগে চীনের পণ্যে বাড়তি ১০ শতাংশ এবং কানাডা ও মেক্সিকোর পণ্যে ২৫ শতাংশ শুল্ক আরোপের ঘোষণা দিলেও পরে কানাডা ও মেক্সিকোর ক্ষেত্রে ১ মাসের জন্য স্থগিত করেছেন তিনি। আলোচনার সুযোগ দিতে এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।

তবে যুক্তরাষ্ট্রের আরোপ করা ১০ শতাংশ শুল্ক ৪ ফেব্রুয়ারি কার্যকর হওয়ার কয়েক ঘণ্টার মধ্যে পালটা ব্যবস্থা নিয়েছে চীন। মার্কিন পণ্যগুলোতেও ১০-১৫ শতাংশ শুল্ক আরোপের ঘোষণা দিয়েছে। বেইজিং জানিয়েছে, মার্কিন কয়লা ও তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাসের (এলএনজি) আমদানির ওপর ১৫ শতাংশ শুল্ক বসানো হবে। এছাড়া ক্রুড অয়েল, কৃষি যন্ত্রপাতি, পিকআপ ট্রাক ও বড় ইঞ্জিনযুক্ত গাড়ির ওপর ১০ শতাংশ শুল্ক আরোপ করা হবে। চীন জানিয়েছে, অর্থনৈতিক স্বার্থ রক্ষা করতে ও মার্কিন শুল্কনীতির বিরুদ্ধে প্রতিক্রিয়া জানাতেই পালটা এই শুল্ক বসানো হয়।

বিশ্লেষকদের মতে, ট্রাম্পের এ ধরনের নীতির ফলে বিশ্বব্যাপী ব্যবসা-বাণিজ্যে অনিশ্চয়তা দেখা দেবে। যা দীর্ঘমেয়াদে বৈশ্বিক অর্থনীতিতে নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে। তার এই নীতি বাস্তবায়িত হলে বাণিজ্য বাধাগ্রস্ত হবে এবং বিনিয়োগ কমে যাবে, যা অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে।

এদিকে বৈশ্বিক অর্থনীতির সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে জড়িত বাংলাদেশ। শুল্ক যুদ্ধের প্রভাব নিয়ে সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি) গবেষণা পরিচালক ড. খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম যুগান্তরকে জানান, বিশ্বব্যাপী একজন আরেকজনের প্রতিপক্ষ হিসাবে পণ্যের শুল্ক বৃদ্ধি করলে সংশ্লিষ্ট দেশের অভ্যন্তরীণ বাজারে অস্থিরতা দেখা দেবে। পণ্যের মূল্য বেড়ে যাবে। এতে জনগণ ও ভোক্তা ক্ষতিগ্রস্ত হবে। অভ্যন্তরীণ মূল্যস্ফীতির হার বেড়ে যাবে। শ্লথ হয়ে পড়বে অর্থনীতির প্রবৃদ্ধি। এর প্রভাবে বৈশ্বিক অর্থনীতির প্রবৃদ্ধিতেও মন্থরগতি চলে আসবে। যা বাংলাদেশের মতো দেশের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে।

গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, মূল্যস্ফীতি হলে সংশ্লিষ্ট দেশের ভোক্তাদের ক্রয়ক্ষমতা কমবে। তাদের আমদানি করা পণ্য ব্যবহারের সুযোগ কমে যাবে। এতে আমাদের মতো রপ্তানির ওপর নির্ভরশীল দেশ তাদের কাছে পণ্য ও সেবা বিক্রি করতে পারবে না। আবার তাদের কাছ থেকে বেশি মূল্যে পণ্য আমদানি করতে গিয়ে আমদানিজনিত মূল্যস্ফীতি ঘটবে দেশের ভেতর।

এই গবেষক মনে করেন, স্বল্পমেয়াদে হয়তো বাংলাদেশের কিছু সুবিধা আসতে পারে। কিন্তু দীর্ঘমেয়াদে ক্ষতির সম্ভাবনা রয়েছে। পরিস্থিতি যেদিকে মোড় নিচ্ছে তা বিবেচনায় নিয়ে সরকারের কৌশল নির্ধারণের দিকে নজর দেওয়া দরকার। নিজেদের সুরক্ষার জন্য বিশেষ করে পণ্য বিক্রি অব্যাহত থাকে, রপ্তানি বাধাগ্রস্ত না হয়, এসব বিষয়ে অভ্যন্তরীণ প্রস্তুতি রাখা দরকার।

এদিকে বাংলাদেশ বছরে ছয় থেকে সাড়ে ছয় হাজার কোটি ডলারের পণ্য আমদানির মধ্যে এক-চতুর্থাংশ আসে চীন থেকে। বছরে গড়ে ১৫০০ কোটি মার্কিন ডলারের পণ্য চীন থেকে আমদানি করছে বাংলাদেশ। পাশাপাশি যুক্তরাষ্ট্র থেকে গড়ে আড়াইশ কোটি মার্কিন ডলারের পণ্য আমদানি করা হয়। যদিও যুক্তরাষ্ট্রে আমাদের পণ্য রপ্তানি বেশি। ফলে বাণিজ্যযুদ্ধে সংশ্লিষ্ট দেশের অভ্যন্তরীণ বাজারে অস্থিরতা সৃষ্টি হয়ে পণ্যের দাম বাড়তে পারে। আর সেখান থেকে বাংলাদেশ বাড়তি মূল্যে পণ্য আমদানি করতে হবে। ওই দেশে বাড়তি মূল্যের কারণে তাদের ক্রয়ক্ষমতা কমে গেলে বাংলাদেশের রপ্তানি পণ্য বিক্রি হ্রাস পেতে পারে।

এ প্রসঙ্গে পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউট অব বাংলাদেশ (পিআরআই) গবেষণা পরিচালক ড. মোহম্মাদ আব্দুর রাজ্জাক যুগান্তরকে জানান, ডোনাল্ড ট্রাম্পের উদ্যোগে বিশ্বব্যাপী বাণিজ্য নীতিতে এক ধরনের অনিশ্চয়তা তৈরি হতে পারে। এটি হলে বিশ্বব্যাপী প্রথমে মার্কিন ডলারের মূল্য বেড়ে যাবে। সেদিক থেকে আমাদের টাকার ওপর চাপ পড়বে। আর ডলারের মূল্যবৃদ্ধির কারণে বিশ্ববাজারে আবারও পণ্যের দাম বাড়বে। এছাড়া সংশ্লিষ্টসহ অন্যান্য দেশ পণ্যের ওপর শুল্ক বৃদ্ধি করলে মূল্যস্ফীতির হার বাড়তে পারে। এর নেতিবাচক প্রভাবে বাংলাদেশে মূল্যস্ফীতি ঘটবে।

ড. রাজ্জাক মনে করেন, এ উদ্যোগে বাংলাদেশ সুবিধা পাবে এমনটি মনে করছেন অনেকে, আবার নাও হতে পারে। চীন ও মেক্সিকোর ওপর বাড়তি শুল্ক আরোপে আমাদের রপ্তানি কিছুটা বাড়তে পারে। কিন্তু ডোনাল্ড ট্রাম্পের পদক্ষেপ বিশ্ব অর্থনীতি মন্থর হয়ে পড়তে পারে। এর আগের মেয়াদেও তাই হয়েছিল। কিন্তু সেটি যদি ঘটে তাহলে আমরা রপ্তানি খাতে ভালো করতে পারব না।

এদিকে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের হিসাবে চলতি অর্থবছরে বিশ্বব্যাপী মূল্যস্ফীতি কমে আসবে এমনটি ধারণা নিয়ে তাদের পূর্বাভাস রিপোর্ট প্রকাশ করেছিল। সেখানে বলা হয়, ২০২২ সালে বৈশ্বিক মূল্যস্ফীতি ছিল ৮ দশমিক ৬ শতাংশ, যা ক্রমান্বয়ে কমে আসছে। একই সময়ে উন্নত অর্থনীতির দেশগুলোর মূল্যস্ফীতি ছিল ৭ দশমিক ৩ শতাংশ, যা চলতি অর্থবছরে আশা করা হচ্ছে ২ শতাংশে নেমে আসবে। একইভাবে ইউরোপীয় ইউনিয়নের দেশগুলোর মূল্যস্ফীতি ২০২২ সালে ৯ দশমিক ৩ শতাংশ হলেও সেটি চলতি অর্থবছরে ২ দশমিক ৩ শতাংশে নেমে আসবে বলে আভাস দিয়েছে সংস্থাটি। কিন্তু সম্প্রতি এ উদ্যোগে আইএমএফের হিসাব পালটে যেতে পারে।

পরিসংখ্যান ব্যুরোর হিসাবে ডিসেম্বরে মূল্যস্ফীতির হার দাঁড়িয়েছে ১২ দশমিক ৯২ শতাংশ। অন্তর্বর্তী সরকার জুনে মূল্যস্ফীতির হার ৮ শতাংশে নামিয়ে আনার পরিকল্পনা নিয়েছে। অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ মঙ্গলবারও জানিয়েছেন ৩ মাসের মধ্যে নিয়ন্ত্রণে আসবে মূল্যস্ফীতি। কিন্তু শঙ্কা হচ্ছে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের সব উদ্যোগ ভেস্তে যেতে পারে ট্রাম্প প্রশাসনের বাণিজ্যযুদ্ধের কাছে।
Print Close  
Print Close  
News Source
            Top
            Top
 
Home / About Us / Benifits /Invite a Friend / Policy
Copyright © Hawker 2009-2010, Allright Reserved